ডন ব্র্যাডম্যান: সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়

ডন ব্র্যাডম্যান: সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়

.

মনে করুন, দুজন শিক্ষার্থী প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত টানা দশ বছর তীব্র প্রতিযোগিতা করেছে। একজন ৭ বার প্রথম হয়েছে, অন্যজন ৩ বার। যে শিক্ষার্থী ৭ বার প্রথম হয়েছে, সে নিঃসন্দেহে অন্যজনের চেয়ে ভালো। কিন্তু যখন দেখবেন, প্রতি পরীক্ষায় তাদের প্রাপ্ত নাম্বারের পার্থক্য মাত্র ৫ থেকে ১০ নম্বর, তখন বুঝতে হবে যে, ৩ বার প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীটিও প্রায় একই সমান ভালো, হয়ত ভিন্ন কোনো কারণে প্রতিযোগিতায় সে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল।

এখন পরিস্থিতিটা একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করা যাক। ধরা যাক, এই দুজনের মাঝে ১০ বছরের প্রতিযোগিতায় একজন ১০ বারই প্রথম হয়েছে। এখানেও প্রতিবার নম্বরের ব্যবধান ৫ থেকে ১০। এখানে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীটি নিঃসন্দেহে বেশি ভালো। তবে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা শিক্ষার্থীটিও প্রতিযোগিতায় বেশ কাছাকাছি ছিল।

এবারে আরেকটি প্রেক্ষাপট দেখি, অনেকটা দ্বিতীয় পরিস্থিতির মতোই। তবে এই ক্ষেত্রে নম্বরের ব্যবধান ৫০-৭০। তার মানে, প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীটি এমন ব্যবধানে এগিয়ে যে, দ্বিতীয় অবস্থানে যে রয়েছে, সে প্রতিযোগিতার কথা ভাবতেও পারে না।

দ্বিতীয় স্থানের চেয়ে এতটা এগিয়ে থেকে প্রথম হওয়াটা সচরাচর সম্ভব হয় না। জীবনযুদ্ধে এমন পারফর্মেন্স হয়তো হাতে গোনা কয়েকজন মানুষই দেখাতে পারেন। কথাটা হয়ত কিছুটা ভুল হলো, যারা দেখাতে পারেন তাদেরকে শুধু মানুষ বলা বোধহয় ঠিক হবে না। এদের জন্যই হয়ত ‘সুপারম্যান’ কিংবা ‘অতিমানব’ কথাটির সৃষ্টি হয়েছে।

আজ আমরা এমনই একজন অতিমানবের গল্প শুনবো। সেই অতিমানবের নাম ‘স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান’।

.

সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কে? ক্রিকেট সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা আছে এমন যে কেউই উত্তরটা জানেন। তিনি হলেন ‘স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান’। টেস্ট ক্রিকেটে সাধারণত ৫০ এর উপরে গড় থাকা ব্যাটসম্যানদেরকে গ্রেট ধরা হয়। আর ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং গড় হচ্ছে ৯৯.৯৪! তার মানে হচ্ছে, ব্র্যাডম্যানের গড়ের সাথে গ্রেট ব্যাটসম্যানদের গড়ের পার্থক্যও যদি কোনো ব্যাটসম্যানের গড় হয়, তাহলেই তাকে গ্রেট বলে ফেলা যায়!

খেলেছেন মাত্র ৫২টি টেস্ট, ইনিংস ৮০টি। নূন্যতম ৫০টি টেস্ট খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মাঝে পরবর্তী সেরাগড় হচ্ছে স্টিভেন স্মিথের (৬১.০৫)। ৫০টির উপর টেস্ট খেলেও ৬০ এর উপর গড় ধরে রাখতে পেরেছেন আর একজন ব্যাটসম্যানই, হার্বাট সাটক্লিফ। জ্যাক হবসের সাথে ওপেনিং জুটি গড়ে তোলা এই ব্যাটসম্যানের গড় ৬০.৭৩।

মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি জীবনের প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে নামেন যখন, বোলার তখন হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে। যখন মাঠ ছেড়ে বের হন, তখন নামের পাশে লেখা ৫৫ রান, সেটাও অপরাজিত। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেকেই সেঞ্চুরি। পরের বছরেই টেস্ট দলে সুযোগ পাওয়া।

অথচ ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান প্রথম টেস্ট খেলেই দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। এখন ভাবতেও অবাক লাগে যে, স্বয়ং ব্র্যাডম্যানও পারফর্মেন্সের জন্য বাদ পড়েছিলেন। সেই সিরিজের পরের টেস্টগুলোতে সুযোগ পাওয়ার পর ৬৬.৮৬ গড়ে করেছিলেন ৪৬৮ রান। তবে এরপরেও সেই সিরিজ হেরেছিল ইংল্যান্ড। পরের সিরিজে ৫ ম্যাচের ৭ ইনিংসে করলেন ৯৭৪ রান। ১৯৩০ সালে ১ সিরিজে সবচেয়ে বেশি রান করার পর সেই কীর্তির ধারে-কাছেও পৌঁছুতে পারেনি আর কোনো ব্যাটসম্যান। এক টেস্ট সিরিজে ৯০০+ রান করেছেন আর একজনই। ওয়ালি হ্যামন্ডের ৯০৫ রান করতে দুটো ইনিংস বেশি খেলতে হয়েছিল।

টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক সিরিজে ৮০০+ রান করার কীর্তি রয়েছে মাত্র ৯টি। একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্র্যাডম্যান কাজটা করেছেন তিনবার। আর কোনো ব্যাটসম্যানের দু’বার এই কাজ করার রেকর্ড নেই। এর মাঝে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৯৩১/৩২ সালের সিরিজে ৫ ইনিংসে ৪টি সেঞ্চুরির সাহায্যে ২০১.৫০ গড়ে রান করেছিলেন ৮০৫। যা কিনা ৪ অথবা এর বেশি ম্যাচ খেলা সিরিজে সর্বোচ্চ গড়।

ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯২৮ সালে, শেষ হয়েছে ১৯৪৮ সালে। সময়ের বিচারে প্রায় ২০ বছর। তবে এরপরেও টেস্ট সংখ্যা মাত্র ৫২টি হবার কারণ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৬) কারণে ক্যারিয়ার থেকে ৮টি বছর ঝরে যাওয়া।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন অস্ট্রেলিয়া টেস্ট খেলতে নামলো, তখন বিশেষজ্ঞরা শঙ্কিত ছিলেন ৩৮ বছর বয়সী ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে। ব্র্যাডম্যান নিজেই সন্দিহান ছিলেন যে, আর টেস্ট খেলতে নামবেন কিনা। ১ম ইনিংসেই ১৮৭ রান করে সন্দেহ যা ছিল, সেটুকু উড়িয়ে দিলেন। পরের ম্যাচে করলেন ২৩৪। সেই সিরিজে করলেন ৯৭.১৪ গড়ে ৬৮০ রান। পরের দুই সিরিজের গড় ১৭৮.৭৫ আর ৭২.৫৭। এমন সব কীর্তি জানার পর ব্র্যাডম্যানের ‘সর্বকালের সেরা’ তকমার উপযুক্ততা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।

.

অনেকেই অভিযোগ করেন, এই যুগে খেললে হয়তো ব্র্যাডম্যান এখনকার গতিতে রান তুলতে পারতেন না। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যিনি গ্রেট তিনি সব যুগেই গ্রেট হতেন। তবুও কিছু বিষয় নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যাক।

ডি ভিলিয়ার্স ওয়ানডেতে ৩১ বলে সেঞ্চুরি করেছেন, সময়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যান বলে বিবেচিত গেইল ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে ৩০ বলে সেঞ্চুরিও করেছেন। বর্তমানে ব্র্যাডম্যান থাকলে কত স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করতেন? জানার উপায় নেই। তবে একটা কথা জানলে আপনি অবাক হতে পারেন যে, ১৯৩১ সালের একটি ম্যাচে ব্র্যাডম্যান সেঞ্চুরি করেছিলেন মাত্র ২২ বলে! ভুল পড়ছেন না, ২২ বলেই সেঞ্চুরি করেছিলেন ব্র্যাডম্যান।

টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম দিনেই লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরি করতে পেরেছেন মাত্র ৫ জন ব্যাটসম্যান, ব্র্যাডম্যান তাদের মাঝে একজন। এছাড়া এক সেশনে তিনিই সবচেয়ে বেশি বার (৬) সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন। ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে একদিনে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন ব্র্যাডম্যান।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আধুনিক যুগে ব্যাটসম্যানদের অনেক বেশি সুবিধা দেওয়া হয়। আগের যুগের বোলারদের চেয়ে এই যুগের বোলারদের রান রেট, গড় সবকিছুই বেশি। ব্যাটসম্যানদের হেলমেট, গার্ড এসব কিছুর প্রচলন হয়েছে অল্প কিছুদিন হলো। আগের যুগে উইকেট ঢেকে রাখার নিয়ম ছিল না, উইকেটের পরিচর্যা ঠিকভাবে না হওয়ায় ব্যাটসম্যানদের পক্ষে বলের মুভমেন্ট বোঝা কষ্টকর হতো। এছাড়া আগের যুগের ব্যাটের আকার দেখলেও আপনি চমকে যেতে বাধ্য। সবচেয়ে বড় কথা, আধুনিক যুগ রান দেখতে চায়।

যুক্তি বলে, এই যুগে এতসব সুবিধা নিয়ে মাঠে নামতে পারলে ব্র্যাডম্যানের গড় আরো বেশিই হতো।

.

ব্র্যাডম্যান টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন ২৯টি। একসময় টেস্টে এটিই সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির রেকর্ড ছিল। পরবর্তীতে সুনীল গাভাস্কার এই রেকর্ড ভেঙে ফেলার পর যখন তাকে অভিনন্দন জানালো হলো, তখন গাভাস্কার বললেন, “এটি শুধুই একটা অর্জন, কোনো রেকর্ড নয়। রেকর্ড সেদিনই ভাঙবে যেদিন কেউ ৫০ টেস্টে ৩০টি সেঞ্চুরি করতে পারবে।

কমপক্ষে ২০টি সেঞ্চুরি করেছেন এমন ব্যাটসম্যনদের মাঝে ব্র্যাডম্যান প্রতি ১.৭৯ ইনিংসে একটি করে সেঞ্চুরি করেছেন। পরের সেরা হেইডেনের তাতে লেগেছে ৩.৪৩ ইনিংস করে।

ব্র্যাডম্যান ক্যারিয়ারে যতগুলো টেস্ট ইনিংস খেলেছেন, তার ৩৬.২৫% ইনিংসকেই সেঞ্চুরিতে রূপান্তরিত করেছেন! টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান টেন্ডুলকারের এই রূপান্তরের হার মাত্র ১৫.৫০%।

ডাবল সেঞ্চুরিতে ব্র্যাডম্যানের রূপান্তরের হার ১৫%। ডাবল সেঞ্চুরি করার ক্ষেত্রে ব্র্যাডম্যানের পরেই যিনি আছেন, সেই সাঙ্গাকারার রূপান্তরের হার মাত্র ৪.৭২%।

ক্রিকেট ইতিহাসে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০টি ট্রিপল সেঞ্চুরি হয়েছে। চারজন ব্যাটসম্যান দুটো করে ট্রিপল করায় ট্রিপল সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানের সংখ্যা ২২। ব্র্যাডম্যান সেই মুষ্টিমেয় চারজনের একজন, যিনি কিনা দু’বার ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন। তবে এর মাঝেও ব্র্যাডম্যানের একটা ব্যতিক্রমী রেকর্ড আছে। ব্র্যাডম্যানই টেস্ট ক্রিকেটের একমাত্র ব্যাটসম্যান, যিনি ২৯৯ রান করে অপরাজিত ছিলেন।

৫.

একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে  ‘Wisden leading cricketer of the year’ এর পুরস্কার পেয়েছেন ১০ বার। সোবার্সের ৮ বার বাদে আর কোনো ক্রিকেটারের তিনবারের বেশি এই পুরস্কার পাওয়ার রেকর্ড নেই।

এছাড়া উইজডেন দ্বারা গত শতাব্দীর সেরা পাঁচজন ক্রিকেটারের নির্বাচনে ১০০ জন বিচারক দ্বারা একটা নির্বাচন হয়। সেখানে প্রত্যেক বিচারক তাদের মতে ৫ জন ক্রিকেটার বেছে নিতে পারবেন। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ব্র্যাডম্যান পান ১০০টি ভোট। সোবার্সের ৯৫টি ভোট বাদ দিলে আর কোনো খেলোয়াড়ই ৩০ জনের বেশি বিচারকের প্রথম পাঁচে থাকতে পারেননি।

৬.

টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে কম ইনিংসে দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় হাজার রান করার কৃতিত্ব ব্র্যাডম্যানের। সেগুলোও পরের ব্যাটসম্যান থেকে অনেক খানি এগিয়ে আছেন তিনি। ১,০০০ রানের রেকর্ডটা ভাঙতে পারেননি ১টি ইনিংসের জন্য। ১৩১ ইনিংসে ৭,০০০ রানের রেকর্ড ওয়ালি হেমন্ডের। ৮০ ইনিংসে ৬,৯৯৬ রান করা ব্র্যাডম্যান ৪ রানের জন্য সেটা ভাঙতে পারেননি। জীবনের শেষ ইনিংসে ৪ রান করতে পারলে তার টেস্ট গড় হতো ১০০। শেষ ইনিংসে শূন্য রান করে আউট হওয়াটাই হয়ত তার ক্যারিয়ারের একমাত্র ব্যর্থতা।

বর্তমান যুগে খেললে ব্র্যাডম্যানের গড় কেমন হতো?

এ নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। একবার এক অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক ব্র্যাডম্যানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, বর্তমান যুগে খেললে তার গড় কত হতো? ব্র্যাডম্যান সহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, ৭০। সেই সাংবাদিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ৯৯ নয় কেন? ব্র্যাডম্যানের জবাব ছিল, “একজন ৮০ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের জন্য এটাও যথেষ্ট ভালো পারফর্মেন্স।” সত্যি সত্যি আরো বেশি টেস্ট খেললে ব্র্যাডম্যানের গড় কত থাকতো?

সঠিক সম্ভাবনা বের করার কোনো উপায় নেই। তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপট দিয়ে আমরা কিছু অনুমান করতে পারি।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান খেলেছেন ৩৩৮টি ইনিংস। এখানে তার গড় ৯৫.১৪। সচরাচর সব গ্রেট ব্যাটসম্যানেরই টেস্ট আর প্রথম শ্রেণীর গড় কাছাকাছি থাকে। ব্র্যাডম্যান ১০০টি টেস্ট খেললেও তার গড় ৯০ এর নিচে নামতো বলে মনে হয় না। আরেকটি কথা মাথায় রাখতে হবে, ব্র্যাডম্যানের টেস্ট ক্যারিয়ারের যে সময়টা যুদ্ধের কারণে নষ্ট হয়েছিল, সচরাচর সেই সময়েই একজন ব্যাটসম্যান সবচেয়ে পরিণত থাকে।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ২২১টি ইনিংসে সেঞ্চুরি পাননি, সেই ইনিংসগুলোর গড় ৫৮.২০ যা কিনা শচীন, লারা, সাঙ্গাকারা, ভিভ রিচার্ডস, গাভাস্কারের মতো গ্রেটদের সেঞ্চুরি, ডবল সেঞ্চুরি সহ গড়ের চেয়েও বেশি।

‘পারফেক্ট রান মেশিন’ টার্মটা সম্ভবত ব্র্যাডম্যানের সাথেই যায়।

৭.

বল নিয়ে যত খেলা আছে তার মাঝে ব্র্যাডম্যানই সবার সেরা। কথা হচ্ছে, বিষয়টা আপনি কীভাবে নিশ্চিত হবেন?

অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী এবং লেখক চার্লস ডেভিডস ‘Athlete sport statistic standard deviation’ ব্যবহার করে সেরাদের সেরা নির্বাচন করার একটা চেষ্টা করেছেন। এখানে প্রতিটি সেক্টরে একজন খেলোয়াড় তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে কতটা এগিয়ে, সেটা আগে বের করা হয়েছে। তারপর প্রতিটা খেলার সেরাদের নিয়ে আরেকটা তুলনা করা হয়েছে। সেই তুলনার ক্রমটা লক্ষ্য করুন।

  • ব্র্যাডম্যান- ক্রিকেট – ৪.৪
  • পেলে  ফুটবল – ৩.৭
  • টাই কব- বেসবল – ৩.৬
  • জ্যাক নিকলাস- গলফ – ৩ ৩.৫
  • মাইকেল জর্ডান – বাস্কেট বল – ৩.৪

এই প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো খেলোয়াড়ই নিজ সেক্টরে ব্র্যাডম্যানের মতো এতটা প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেন নি।

এছাড়াও বিখ্যাত গণিতবিদ টমাস হার্ডি ‘ব্র্যাডম্যান ক্লাস’ নামে একটা টার্ম উদ্ভাবন করেন। এটা ছিল অতিমানবীয়কোনো কীর্তির মানদণ্ড। আইনস্টাইন, নিউটন, গ্যালিলিওরা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ‘ব্র্যাডম্যান ক্লাস’ বলে।

ব্র্যাডম্যান বহু আগেই নিজেকে ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে আরো দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

৮.

ব্র্যাডম্যান অধিনায়কত্ব করেছেন ৫টি সিরিজে; কোনোটিতেই হারেননি, ৪টিতে জিতেছেন আর ১টি সিরিজ ড্র হয়েছে।

ব্যাটসম্যান হিসেবে যেকোনো পজিশনেই ব্র্যডম্যান অনন্য ছিলেন। ৭ নম্বর পজিশনে নেমে খেলেছেন ২৭০ রানের ইনিংস, যা কিনা সেই পজিশনে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড। উইজডেন থেকে গত শতাব্দীর সেরা ১০০টি ইনিংসের একটি তালিকা করা হয়েছিল। সেই তালিকায় ইনিংসটি প্রথম স্থানে আছে।

ব্র্যাডম্যানের বদৌলতে তেমন আহামরি কিছু না করেও অনেক ক্রিকেটার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ৩০.২৭ গড়ে মাত্র ৪৪টি টেস্ট উইকেট নেওয়া এরিক হলিসকে মনে রাখার কথা না টেস্ট ক্রিকেটের। কিন্তু ক্রিকেটের মনোযোগী ছাত্ররা কেবলমাত্র একটা কীর্তির কারণে তাকে চাইলেও ভুলে যেতে পারে না। ব্র্যাডম্যানকে শেষ ইনিংসে শূন্য রানে আউট করা বোলারটা যে তিনিই।

মার্ক টেইলরের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কদের কাতারে প্রথম দিকেই থাকবেন তিনি। তবে টেইলরের চেয়েও ভালো অধিনায়ক অস্ট্রেলিয়া অনেকবার দেখেছে। কিন্তু তিনিও স্মরণীয় হয়ে আছেন ব্যতিক্রম ধর্মী আরেকটি কারণে। ৩৩৪ রানে অপরাজিত থেকেও তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড ৩৭৫ রান ভাঙার চেষ্টা না করে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দিয়েছিলেন। কারণ জানতে চাইলে বলেছিলেন, “ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ স্কোরও ৩৩৪। কেবল মাত্র এই একটি কারণেই ব্র্যাডম্যানের সাথে আমার নাম একসাথে উচ্চারিত হবে।

শুধুমাত্র ব্র্যাডম্যানকে আটকাতে ইংল্যান্ড বডিলাইন সিরিজের উদ্ভাবন করেন। ক্যারিয়ারে এই একটি সিরিজেই ব্র্যাডম্যান ব্যর্থ। কারণ সেই সিরিজে ব্র্যাডম্যানের গড় ছিল ৫৬.৫৭। এখানেও ব্র্যাডম্যান অনন্য। যে গড়ের অধিকারী হলেই অন্যান্য ব্যাটসম্যানদেরকে গ্রেট আখ্যা দেওয়া হয়, সেটাও যখন একজনের জন্য ব্যর্থতা বলে বিবেচিত হয়, তখন তিনি কোন স্তরের খেলোয়াড় তা প্রকাশ করার জন্য বিশেষন খুঁজে না পেলে, আপনাকে দোষ দেওয়া যাবে না।

মাঠের ক্যারিয়ার শেষ করার পর বোর্ড কর্মকর্তা আর নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ব্র্যাডম্যান। বলাই বাহুল্য, সেখানেও তিনি সফল ছিলেন।

৯.

ব্র্যাডম্যান তার ক্রিকেটিও সীমানা ছাড়িয়ে কতদূর যেতে পেরেছিলেন?

নেলসন ম্যান্ডেলার নাম শুনেছেন? প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী ১৯৮৬ সালে কেপটাউনের কারাগারে ম্যান্ডেলার সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, “ব্র্যাডম্যান কি এখনো জীবিত আছেন?

তখনো ব্র্যাডম্যান জীবিত ছিলেন, তিনি মারা যান ২০০১ সালে। তবে সেটা শুধুই কাগজে কলমে মৃত্যু। এ ধরনের মানুষ ইতিহাসে সবসময় অমর হয়েই থাকেন।

টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন শচীন টেন্ডুলকার। যদি টেন্ডুলকারের মতো ৩২৯টি ইনিংস খেলতে পারতেন, তাহলে গড় অনুযায়ী তার টেস্ট রান হতো ৩২,৮৮০। ব্র্যাডম্যান যদি টানা আরো ৫২টি ইনিংসে শূন্য রান করতেন তাহলে তার গড় শচীন লারাদের সমান হতো। তথ্যসূত্রঃroar.media