“মাগুরার ফয়সাল যেভাবে হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান”

মাগুরার ফয়সাল যেভাবে হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান

৬ আগস্ট ২০০৬, বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ে ৫ম ওয়ানডে ম্যাচ । অভিষেক হলো এক তরুণ খেলোয়াড়ের, নাম সাকিব আল হাসান । বল হাতে ১০ ওভারে ৩৯ রানের বিনিময়ে এলটন চিগাম্বুরার উইকেট এবং ব্যাট হাতে ৪৯ বলে অপরাজিত ৩০ রানের একটি ইনিংস । এভাবেই শুরু হয়েছিল সাকিবের আন্তির্জাতিক ক্যারিয়ার । এরপর দিন যত গড়িয়েছে সাকিব নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে গেছেন । মাগুরার ফয়সাল হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সাকিব । তিনিই আজ বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচাইতে বড় বিজ্ঞাপন । যে কোন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই বাংলাদেশ দলের অন্যতম নির্ভরতার নাম হচ্ছে সাকিব আল হাসান । তার একটি দায়িত্বশীল ইনিংস কিমবা একটি ঘূর্ণিজালের স্পেল দলের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে । তাইতো সাকিবের জন্য খেলার মাঠে প্লাকার্ড হাতে নিয়ে দর্শক দাঁড়িয়ে থাকে, তাতে লেখা থাকে ‘বাংলাদেশের জান, সাকিব আল হাসান’ ।

সাকিবের জন্ম ২৪ মার্চ, ১৯৮৭ । সারা দেশের কাছে তার পরিচয় সাকিব আল হাসান নামে হলেও জন্মস্থল মাগুরায় তার পরিচিতি ফয়সাল নামে । আজকে ক্রিকেটার সাকিবকে নিয়ে সারা দেশ জুড়ে যে উন্মাদনা সেই সাকিবের হয়তো কখনো ক্রিকেটই খেলা হত না ! সাকিবের বাবা মাশরুর রেজা যে চাইতেনই না তার ছেলে ক্রিকেটের পেছনে সময় নষ্ট করুক । সাকিবের বাবা যৌবনে মাগুরার জেলা দলের হয়ে নিয়মিত ফুটবল খেলেছেন । তিনি ছেলের ফুটবল খেলা মেনে নিতে পারতেন কিন্তু ক্রিকেট কখনোই না । ক্রিকেটটা সেই সময়ে এখনকার মত এতটা জনপ্রিয়ও ছিল না । একটা সময় অবশ্য সাকিব নিজেও চাইতেন ফুটবলার হতে । কিন্তু ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয় করে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ লাভ করলে দেশ জুড়ে যে ক্রিকেট জ্বর শুরু হয় তাতে সাকিবও আক্রান্ত হন । ক্রিকেটের প্রতি তার আগ্রহ এবং ভালবাসা দুটোই বাড়তে থাকে । তাই শেষ পর্যন্ত সাকিব ক্রিকেটকেই বেছে নিলেন । তার সিদ্ধান্ত যে ভুল যে মোটেও ভুল ছিল না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । লর্ডস, মেলবোর্ন, ইডেন গার্ডেন, মিরপুর মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো সাকিবের শুরুটা কিন্তু হয়েছিল আলোকদিয়ার মাঠে !

অনেক বছর পরে সেই মাঠে গিয়ে সাকিব নিজেই যেমন বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছিল এই মাঠ থেকেই সব শুরু হয়েছিল । এই মাঠের জন্যই এত দূর এসেছি ।’ ২০০১ সালের দিকে ক্লাস সেভেনে থাকা কালীন সময়ে আলোকদিয়ার ওই মাঠটাতে ‘খ্যাপ’ খেলতে গিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান । বিধ্বংসী ব্যাটিং আর পেস বোলিংয়ে নজর কেড়েছিলেন সবার । হ্যাঁ, সাকিব প্রথমে পেসারই ছিলেন ! সাকিবের ঐ দিনের পারফরমেন্স মুগ্ধ করেছিল সেই ম্যাচের আম্পায়ার সাদ্দাম হোসেন (গোর্কি) কে । পরবর্তীতে এই সাদ্দাম হোসেনের পরামর্শেই সাকিব মাগুরায় ইসলামপুরপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দেন । টেপড টেনিস বলে খেলা সাকিব সেখানেই প্রথম আসল ক্রিকেট বল হাতে পান । প্রথমে পেস বল করলেও পরে তার কোচ সাদ্দাম হোসেনের পরামর্শে সাকিব স্পিন বল করা শুরু করেন ।

সাকিব ২০০১ সালে বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষন কার্যক্রমে মাগুরা জেলার হয়ে নড়াইল ক্যাম্পের জন্য মনোনীত হন । নড়াইল ক্যাম্প থেকে ঢাকার বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য যে ২০ জন সুযোগ পায় তার মধ্যে সাকিবও ছিলেন । বিকেএসপির তৎকালীন ক্রিকেট প্রশিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বাপ্পী এবং সাকিবের কোচ সৈয়দ সাদ্দাম হোসেন গোর্কির পরামর্শে সাকিবের বাবা শেষ পর্যন্ত সাকিবকে বিকেএসপির ক্রিকেট বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেন । বিকেএসপিতে ভর্তির পর বাংলাদেশের হয়ে বয়সভিত্তিক দল গুলোতে অর্থাৎ অনূর্ধ-১৫, অনূর্ধ-১৭, অনূর্ধ-১৯ এর হয়ে খেলার সুযোগ পান এবং নিজের প্রতিভার সাক্ষর রাখেন । ২০০৬ তে ওয়ানডে অভিষেকের পর ২০০৭ তে ভারতের বিপক্ষে টেষ্ট অভিষেক হয় সাকিবের । শুরুটা সাকিব সুলভ না হলেও নিজের জাত চেনান সাকিব । একজন অলরাউন্ডার হওয়া সত্ত্বেও অক্টোবর ২০০৮ এর নিউজিল্যান্ডের বাংলাদেশ ট্যুরের আগ পর্যন্ত সাকিবকে বোলার নয়, ব্যাটসম্যান হিসেবেই গণ্য করা হত । পরের মাসেই বাংলাদেশ দল দুটি টেস্ট, তিনটি ওয়ানডে ও একটি টি-২০ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায় । দক্ষিণ আফ্রিকার শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপের বিপক্ষে ১ম টেস্টের দ্বিতীয় দিনেই পাঁচ-পাঁচটি উইকেট তুলে নেন সাকিব । দ্বিতীয় টেস্টে সাকিব আবারও এক ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেন । ঐ সিরিজে সাকিব ২০.৮১ গড়ে ১১টি উইকেট নেন । ২০০৯ সালটা সাকিবের ক্যারিয়ারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল ।

ধারাবাহিক পারফরমেন্স এর পুরস্কার পান সাকিব । ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারী সাকিব প্রথমবারের মত আইসিসি’র ওডিআই অলরাউন্ডার তালিকার ১ নম্বরে উঠে আসেন । তিনি আইসিসি ক্রিকেটার অফ দ্যা ইয়ার এবং আইসিসি টেষ্ট প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার এর জন্য মনোনয়ন পান । কিন্তু পুরষ্কার পাননি । তবে ঐ একই বছর শচীন টেন্ডুলকার, জ্যাক ক্যালিস, গৌতম গম্ভীরের মত খেলোয়াড়কে পিছনে ফেলে জিতে নেন উইজডেন টেষ্ট প্লেয়ার বর্ষসেরার পুরষ্কার ! ২০১১তে সাকিব সেরা টেষ্ট অলরাউন্ডারের তালিকায়ও ১ নম্বরে উঠে আসেন । বিশ্বের নম্বর ওয়ান অলরাউন্ডার, বিভিন্ন ফরম্যাটের ক্রিকেটে তাই সাকিবের চাহিদাও বাড়তে থাকে । বর্তমনে সাকিব বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে সকল দলের হয়ে খেলছেন তাদের মধ্যে অন্যতম দল গুলো হলো- কলকাতা নাইট রাইডার্স, ওর্চেস্টারশায়ার, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস, লিচেস্টারশায়ার, বার্বাডোজ ট্রাইডেন্ট, অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার্স ।

২০১২ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে সাকিব আল হাসান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী উম্মে আহমেদ শিশিরের সাথে জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেন । শিশির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এ স্নাতক, তিনি পড়াশোনা করেন মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে । এত এত খ্যাতির পরেও সাকিবকে মাঝেমাঝে অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে তার কিছু বিতর্কিত আচরনের জন্য । জরিমানা গুনতে হয়েছে এমনকি নিষিদ্ধ হয়েছেন জাতীয় দল থেকেও । তাকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে দেশ-বিদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে । তবে কোন কিছুই মাঠে সাকিবের পারফর্মেন্সের উপর প্রভাব ফেলতে পারে নি । সাকিবের প্রত্যাবর্তন প্রতিবারই ছিল সাকিবের মতই । তথ্যসূত্রঃবিডি২৪লাইভ