‘নিশ্চুপ’গাজীপুর; স্বস্তিতে আ.লীগ!

একদিন আগেও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা ছিল উৎসবের নগরী। জনসমাগমে চলত জমজমাট আড্ডা। দলবেঁধে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের ভোটপ্রার্থনার দৃশ্য সকাল থেকে চোখে পড়ত। সমর্থকদের মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয়েছে রাজপথ। অলিগলিতে মাইকের উচ্চস্বরে নির্বাচনী প্রচার চলত রাতঅবধি। উঠান বৈঠকে দেওয়া হচ্ছিল নানা প্রতিশ্রুতি। ব্যস্ত নগর ছিল পাল্টাপাল্টি অভিযোগে কোলাহলমুখর। উত্তপ্ত পরিস্থিতি কিছুটা আতঙ্কেরসৃষ্টি করে মাঝে মধ্যে।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় হঠাৎ ছেদ পড়েছে গত কয়েকদিনের প্রাত্যহিক নগরজীবনে। শহরের অলিগলি নিস্তব্ধ-নিশ্চুপ। প্রার্থীদের নির্বাচনী ক্যাম্পে নেই আনাগোনা। অলিগলিতে ঢুঁ মারেনি প্রচারগাড়ি। প্রার্থীদের কাছে কদর বেড়ে যাওয়া ভোটাররাও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। থেমে যায় সব কোলাহল। প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা ও ক্ষোভ।হাইকোর্টের নির্দেশে তিন মাস স্থগিত হওয়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় গতকাল সোমবার ছিল অনেকটা নীরব। আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল লোকজনের তেমন আনাগোনা নেই। দুদিন আগেও এখানে সকাল হলেই দলে দলে আসত লোক। গভীর রাতঅবধি চলত নানা কার্যক্রম। একই অবস্থা বিএনপির মেয়রপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের বাড়িতেও। দুই দলের অফিসগুলোও অনেকটা নীরব দেখা গেল। গতকাল অফিস খোলা থাকলেও লোকজনের উপস্থিতি তেমন একটা ছিল না। কয়েকজনকে অলস বসে থাকতে দেখা যায়।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কায় ছিল আওয়ামী লীগ। এ জন্য আদালতের রায়ে ভোট স্থগিত হওয়ায় পরাজয়ের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে স্বস্তিবোধ করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। তবে খুলনার ভোটে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে দলটি।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, গাজীপুর ও খুলনায় ভোটের আগে একাধিক জরিপ করে আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে গাজীপুরে জাহাঙ্গীর আলম ও খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রার্থীদের থেকে দুই স্থানেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পিছিয়ে ছিলেন। প্রচার শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সংস্থা পুনরায় জরিপ করে। এতে দেখা যায়, গাজীপুরে বিএনপির প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ব্যবধান রয়েই গেছে। আর খুলনায় ব্যবধান কমে এসেছে। এ জন্য খুলনার বিষয়ে আশাবাদ তৈরি হলেও গাজীপুরে পরাজয়ের শঙ্কা দেখা দেয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজধানীর অদূরে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি দলের নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় ফেলে।

প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল, গাজীপুর ও খুলনায় কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশি বেশি সফরে পাঠানো হবে না। অবশ্য গাজীপুরে কেন্দ্রীয় নেতাদের সফর বৃদ্ধির তাগিদ দিতে থাকেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত শনিবার রাতেও সভাপতিমণ্ডলীর দুজন সদস্য সিটি এলাকার বাইরে গাজীপুরের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। পরদিন রোববার আদালত ভোট স্থগিতের রায় দেন।

সরেজমিন সমর্থক ভোটার ও স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বললে অনেকে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এক কলেজ শিক্ষার্থী বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা তাদের নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। আমরা আশা করেছিলাম, নির্বাচিত মেয়র এলাকার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় আমার আশাভঙ্গ হয়েছে।নাওজাড় এলাকার মুদি দোকানি করিম জানান, নির্বাচনের জমজমাট পরিবেশে বিক্রি ভালোই চলছিল। প্রতিদিন কাউন্সিলর প্রার্থী, কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে দোকান গমগম করত। কিন্তু নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় এখন নেতাকর্মীদের ভিড় কমে গেছে। তবে আশা করছি, দ্রুত সময়ে নির্বাচন হবে।

পোশাক কারখানার শ্রমিক মিতু বলেন, নির্বাচনে মেয়রপ্রার্থীরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করে কারখানা শ্রমিকদের উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নির্বাচন হলে আমরা নতুন মেয়রের কাছে আমাদের সুযোগ-সুবিধা চাইতে পারতাম। কিন্তু এখন নির্বাচন না হওয়ায় আমরা হতাশ। একই কথা জানান অপর শ্রমিক হোসনে আরা।রিকশাচালক মেহেদি বলেন, আমরা খেটে খাই, নির্বাচন নিয়ে ভাবার সময় কই। তবে সময়মতো নির্বাচনটা হলে ভালোই হতো।কাউন্সিলর প্রার্থীরা বলছেন, নির্বাচনটি হয়ে গেলেই ভালো হতো, তারাও শতভাগ প্রস্তুত ছিলেন। পোস্টার, মাইকিংসহ প্রচারে তাদের একটি বিরাট অঙ্কের অর্থ খরচ হয়েছে। স্থগিত হওয়ায় তাদের আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি হয়েছে। তবে তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।১৩নং ওয়ার্ড থেকে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী ফাইজুল আলম দিলীপ জানান, জনগণের জন্য তিনি নির্বাচনের মাঠে ছিলেন এবং এখনো আছেন। স্থগিতের বিষয়টি আইনি পদক্ষেপ। এখানে আমার কিছু বলার নেই, আইনের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। এখানে নির্বাচন কমিশন যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তা আমাদের মানতে হবে।

বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা স্থগিতাদেশের ব্যাপারে সরকারের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। তারা বলছেন, নির্বাচনে পরাজয় জেনেই সরকার নির্বাচন স্থগিত করেছে। তবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলছেন, স্থগিতাদেশের বিষয়টি আদালতের। তাই আদালতের প্রতি সবার সম্মান দেখানো উচিত।