খালেদাকে মুক্তি দিন, ভোটের মাঠে আসতে দিন: সরকারকে ড.কামাল

কারান্তরীণ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘যেহেতু একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এতোদিন পরে হতে যাচ্ছে তাতে একটা দলের নেত্রী সরকারের প্রধান থাকবেন আর আরেক দলের নেত্রীকে সেই সেন্ট্রাল জেলে রেখে অপমান করা হবে এটা একদমই মেনে নেয়া যায় না।’

ড. কামাল বলেন, ‘ওনাকে (খালেদা জিয়া) মুক্ত করা দরকার। যাতে উনি তার নেতাদের নিয়ে দেশের মানুষের কাছে গিয়ে নির্বাচনে ভোট চাইতে পারেন। আমি সরকারকে বলবো- প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে সরে এসে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন, তাকে ভোটের মাঠে আসতে দিন।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘শুধু তো খালেদা জিয়া জেলে নাই। হাজার হাজার লোককে জেলে রাখা হয়েছে। আমি প্রতিদিনই শুনছি গ্রেফতারের কথা। এভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করে গণতন্ত্র ফিরে আসবে না, সাংবিধানিক শাসনও থাকবে না। দেশ একটা অরাজকতার মধ্যে পড়বে। এজন্য বেগম জিয়াকে মুক্তি দেয়া দরকার।’

শনিবার (১৭ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রাঙ্গণে জাতীয় আইনজীবী ঐক্যফ্রন্ট আয়োজিত আইনজীবীদের মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন তিনি।

পরিস্থিতি যা-ই হোক আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জন না করার ঘোষণা দেন ড.কামাল।

তিনি বলেন, ‘সবাইকে হাতজোড় করে বলবো, এবার আর বয়কট ঠয়কট আমরা করবো না। একবার ভোট বয়কট করে আমাদের যে খেসারত দিতে হয়েছে এটা যাতে আর না হয়।’

সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ভোট নিয়ে সরকার যত রকমের দশ নম্বরি আছে করুক, আমরা ভোট দেবো। আপনারা তৈরি হোন। আমরা হাজারে হাজারে গিয়ে ভোট দেবো।’

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘দ্রুত আমরা নির্বাচন চাই। অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠ নির্বাচন চাই।’

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে তিনি বলেন, ‘এটা খুবই ন্যায়সঙ্গত। দেশের একটি বিরোধী দলের প্রধান ছিলেন তিনি। তাকে এভাবে কারাগারে বন্দি করে রাখা যায় না।’

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে এমপি পরিচয় দেয়া ভাওতাবাজি।’

নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সকলের মতামত উপেক্ষা করে কোটি কোটি টাকা ব্যবহার করে কেন ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এই সরকারের বড় ঘাটতি হলো দেশ ১৬ কোটি মানুষের, কিন্তু এরা পাঁচজন মিলে যা মনে করেন তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। জাতীয় নীতির তোয়াক্কা না করে তারা এসব করছে।’

সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘৭ জন বিচারপতি মিলে একটা রায় দিলেন, কিন্তু কথা শুনতে হলো সিনহা সাহেবকে। এতো লজ্জা আমি জীবনে পাইনি, যেদিন দেখেছি কোনও একজন মন্ত্রী হবে কিনা জানিনা- যিনি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে বলেছিলেন ‘তোকে কে নিয়োগ দিয়েছিল?’’

ড. কামাল বলেন, ‘‘তোকে কে নিয়োগ দিয়েছিল’-একজন প্রধান বিচারপতিকে কেউ এভাবে বলতে পারে না। সে যেই হোক। যে এসব কথা বলেছে তার আদালত অবমাননা এখনো হতে পারে।’

যে ব্যক্তি এসব কথা বলেছে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করতে পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে হালকাভাবে নেওয়া উচিত না। আজ হোক কাল হোক এসব বলে কেউ পার পাবে না।’

ঐক্যফ্রন্টের এই শীর্ষ নেতা আরও বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্যি, গত ৫ বছর দেশ যেভাবে শাসিত হয়েছে এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, আমি জানি না।’

তিনি বলেন, ‘২০১৪ তে একটা নির্বাচন হয়েছিল। পরে এ যখন কোর্টে আসলো অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে আমাকে ডেকেছিল। কোর্ট জিজ্ঞেস করেছিল আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন, আমি বললাম, মূল্যায়ন করলে তো দুই মিনিটেই বলা যায় যে এটা কোনো নির্বাচনই ছিল না। আরেকটা নির্বাচন করতে হবে। সরকার তো বলছে দ্রুত আরেকটা নির্বাচন করবে। সরকারের পক্ষের লোকই সেখানে বলেছে। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটা সরকার করে নেওয়া হয়েছে, আমরা সকলের সঙ্গে আলোচনা করছি যেন, দ্রুত একটা নির্বাচন করা যায়।’

ড. কামাল বলেন, ‘আমিও স্বাভাবিকভাবেই মনে করেছি সরকার যখন কোর্ট দাঁড়িয়ে এরকম একটা কথা বলছে তখন দ্রুতই আরেকটা নির্বাচন হবে। তখন আমি কোর্টকে বললাম আমার কিছু বলতে হবে না, তারা তো নিজেরাই বলছে যে, একটি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য করেছে, তারাও এটাকে ডিফাইন করতে পারছে না, বলছে দ্রুত আরেকটা নির্বাচন দিবে। কিন্তু দ্রুত মানে কি ৫ বছর?’

তিনি বলেন, ‘সরকার এত হালকা হয়ে গেছে যে, তারা নিজেরাই তাদের কথার অর্থ বোঝে না। নইলে দ্রুত নির্বাচন মানে কি পাঁচ বছর? আজ আমি জানতে চাই। যারা আজ সরকারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তারা দেখেন ২০১৪ তে দাঁড়িয়ে আপনারা কী বলেছিলেন। যদি কথাগুলো মনে না থাকে তাহলে কোর্টের অর্ডার বের করে দেখেন।’

গণফোরাম সভাপতি বলেন, ‘১৬ কোটি মানুষের দেশ। এই দেশে সরকার যদি কোনও কথা বলে তবে দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে হয়। ১৬ কোটি মানুষকে যা-তা বলে পাঁচ বছর ধরে তারা শাসন শোষণ বজায় রেখেছে।’

“সংবিধানের মৌলিক কথা হচ্ছে, জনগণ ক্ষমতার মালিক। কিন্তু জনগণ যদি তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে তাদের ক্ষমতা না প্রয়োগ করাতে পারে তাহলে স্বাধীনতার উপরে আঘাত দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন থাকে না। এই দেশটাকে পরাধীন দেশ বানাতে দিতে পারি না। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই স্বাধীনতার অর্থ হলো জনগণ এই ক্ষমতার মালিক”- যোগ করেন ড. কামাল।

আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করলাম। এটা খেলার কথা না। এবং আমরা তাদের উত্তরসূরি হিসেবে এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না, শহীদের রক্তের সাথে আমরা বেইমানি করতে পারি না। যারা আমাদের দেশের মালিক করে গেল, মালিক হিসেবে নিঃস্ব হয়ে, কেউ ক্ষমতা আত্মসাৎ করে যেনতেনভাবে আমাদের জনগণকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করছে, আমাদের সুশাসন থেকে বঞ্চিত করছে, সাংবিধানিক শাসন থেকে বঞ্চিত করে যেনতেনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। এটা কি আমরা মেনে নিতে পারি?’

সরকারের উদ্দেশ্যে ড. কামাল বলেন, ‘কাকে তোমরা সংবিধান দেখাচ্ছো? সংবিধানের প্রথম লাইনে সংবিধান লেখা আছে। এরপরে আর কোনো লাইন তারা যে পড়ে আমার তা মনে হয় না। পড়লে এভাবে সংবিধান সংবিধান সংবিধান করতো না। পড়লে দেখবে যে, তোমরা একেকটা বিধান লঙ্ঘন করছো।’

‘মন্ত্রী যে বলা হচ্ছে এরা কারা? উপদেষ্টা, এরা কারা? তারপর যাদেরকে মেম্বার বলা হচ্ছে তারা কারা?’- এসময় এমন প্রশ্নও তোলেন এ সংবিধান প্রণেতা।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জাতীয় আইনজীবী ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক জয়নুল আবেদীনের সভাপতিতত্বে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, গণফোরামের মহাসচিব সুব্রত চৌধুরী, সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বারের সদস্যরা।

সমাবেশ থেকে ৭ দফা দাবি পেশ করেন সংগঠনের আহ্বায়ক জয়নুল আবেদীন।