যেভাবে সময় কাটছে যুবলীগের ‘দোর্দণ্ড প্রভাবশালী’ চেয়ারম্যানের

যুবলীগের একসময়কার ‘দুর্দণ্ড প্রভাবশালী’ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর প্রিয় স্থান ছিল নিজের প্রতিষ্ঠিত যুব গবেষণা কেন্দ্র। নিয়ম করে প্রতিদিন অন্তত একবার এই অফিসে আড্ডা দিতেন তিনি। এখানে বসেই সারাদেশের যুবলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। চেয়ারম্যানের পছন্দের জায়গা হওয়ায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাপিয়ে এই যুব গবেষণা কেন্দ্রই হয়ে উঠে নেতাকর্মীদের রাজনীতি চর্চার চারণভূমি।

ধানেমন্ডির সেই প্রিয়স্থানেই তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যান না যুবলীগ চেয়ারম্যান। এমনকি ২৪ দিন ধরে যান না দলীয় কার্যালয়েও। বাসার চার দেয়ালের মধ্যে গত ২৪ দিন ধরে সময় কাটাচ্ছেন তিনি। কার্যত নিজ বাড়িতে গৃহবন্দী হয়ে আছেন ওমর ফারুক।

রাজধানীতে মাদক-দুর্নীতি-টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পরও ভোকাল ছিলেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। সভা সমাবেশে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। শুরুতেই ‘শুদ্ধি অভিযান’ নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দেয়ায় যুবলীগ চেয়ারম্যান সমালোচনার মুখে পড়েন। অবশ্য বাস্তবতা বুঝতে পেরে দ্রুত নিজেই অবস্থান বদল করেন। অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে ওমর ফারুক বলেন, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে ক্যাসিনোর পেছনে যুবলীগের অনেকে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। সংগঠনের সভাপতি হিসেবে এটি তার ব্যর্থতা বলে তিনি মনে করেন।

১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ওরফে ক্যাসিনো খালেদ গ্রেফতার হওয়ার পর ধাক্কা খান ওমর ফারুক। এরপর আরেক যুবলীগ নেতা জি কে শামীম গ্রেফতার হন। তাদের জবানবন্দি থেকে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল।

পরে দিন পনের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও যুবলীগের দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান। এরা দুজনই ওমর ফারুকের আশির্বাদপুষ্ট। তাকে রাজনৈতিক গুরু মানে এই দুজনই। ওমর ফারুক চূড়ান্ত বেকায়দায় পড়েন ক্যাসিনো সম্রাট গ্রেফতার হওয়ার পর।

যুবলীগের প্রভাবশালী নেতারা ওমর ফারুকের আশকারায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন বলে অভিযোগ উঠে। গ্রেফতার যুবলীগ নেতারা ক্যাসিনোর অবৈধ আয় থেকে ওমর ফারুককে নিয়মিত মাশোয়ারা দিতেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক হিসাব তলব করা হয় ওমর ফারুকের। বিদেশ যেতে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। এরপর থেকে অনেকটাই গৃহবন্দি যুবলীগ চেয়ারম্যান। বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। সাড়া দিচ্ছেন না ফোনে। রয়েছেন গ্রেফতার আতংকেও। এই আতঙ্ক নিয়েই সময় কাটছে তার।

তবে আতঙ্কে থাকলেও দেশ ছাড়বেন না ওমর ফারুক। দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার খবরের পর ওমর ফারুক চৌধুরী একটি গণমাধ্যমকে টেলিফোনে বলেন, আমি দেশ ছেড়ে পালাব কেন? আমি দেশেই আছি, দেশেই থাকব। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।

আমি যদি কোনো অপরাধ করি তাহলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আমি পালিয়ে যাওয়ার লোক নই। রাজনীতি করি। রাজনীতি করতে গেলে ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। আমি এমন কোনো অপরাধ করিনি যে, আমাকে পালিয়ে যেতে হবে।

আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাকে গ্রেফতার করলে আমার কাজ হবে আদালতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করা। অপরাধ হচ্ছে প্রমাণের বিষয়।

সর্বশেষ গত ২০ সেপ্টেম্বর উত্তরায় যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের একটি ওয়ার্ড কমিটির সম্মেলনে দেখা গিয়েছিল ওমর ফারুক চৌধুরীকে। এর পর থেকে কেটে গেছে ২৪ দিন। এই সময়ে তার দেখা পাননি নেতাকর্মীরা। শুক্রবার যুবলীগের গুরুত্বপূর্ণ প্রেসিডিয়াম সভায়ও হাজির হননি ওমর ফারুক চৌধুরী। কাউন্সিলের আগে অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকে তার অনুপস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। যুবলীগের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তাকে দায়ী করা হয়। তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ভার দেয়া হয়। শোনা যাচ্ছে যুবলীগের আসন্ন কংগ্রেসে তাকে সভাপতিত্ব করতে দেয়া হবে না।

গত বুধবার যুবলীগের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ২৩ নভেম্বর যুবলীগের ৭ম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। কংগ্রেসের তারিখ ঘোষণার পর চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে যুবলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে। পদপ্রত্যাশীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। নেতাকর্মীদের অনেকে ধারণা করেছিলেন, ওমর ফারুক চৌধুরী সংগঠনের কার্যালয়ে আসবেন। তবে গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অসংখ্য নেতাকর্মী অপেক্ষা করেও তার দেখা পাননি। ফোনেও তাকে পাচ্ছেন না তারা।

ব্যাংক হিসাব তলব ও অনুমতি ছাড়া বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারির পর ওমর ফারুক চৌধুরী প্রকাশ্যে আসছেন না। ধানমণ্ডির ৫ নম্বর সড়কে তার প্রতিষ্ঠিত যুব গবেষণাকেন্দ্রের কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। ধানমণ্ডির ৮/এ সড়কে তার বাসায় অবস্থান করছেন।

ওমর ফারুক চৌধুরী যে বাসায় থাকেন, ‘ইস্টার্ন হেরিটেজ’ নামের সেই বাসার দারোয়ান মেহেদি বলেন, গণমাধ্যমকর্মী বা দলীয় নেতাকর্মী কারোরই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। ওমর ফারুক চৌধুরী বাসায় আছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি তো আমি বলতে পারব না।’

এদিকে ওই বাসার আশপাশের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে সেখানে প্রায়ই নেতাকর্মীদের লাইন লেগে থাকত। অভিযান শুরুর পর প্রথম দিকে অনেক নেতাকর্মী যুবলীগ চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সেখানে গেছেন। কিন্তু কয়েক দিন হলো সেখানে কারও দেখা মিলছে না।

তামাকের বিকল্প ‘টেন্ডু পাতা’ বিক্রির মাধ্যমে তার পেশাগত জীবন শুরু হয়। বিড়ি শ্রমিক লীগ, জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন যুব সংহতির রাজনীতি করে আসা ওমর ফারুক ২০০৯ সালে যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। ২০১২ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার পর সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটি নয়, সব বিষয়ে তার সিদ্ধান্তই শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়। তার দাপটে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারাও টু শব্দটি পর্যন্ত করার সাহস পাননি।

অভিযোগ রয়েছে, যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিজের অনুগতদের বসিয়েছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। ঢাকা মহানগর ও দেশব্যাপী জেলা কমিটিগুলোও হয়েছেন তার পকেটের লোক দিয়ে।

নিজেকে তরুণ ভাবাপন্ন ৭১ বছর বয়সী ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই একক ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। শুরুতে সাবেক নেতাদের পরামর্শ ছাড়াই একটি ঢাউস কমিটি গঠন করেন তিনি। অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি অনেক নেতাকে কমিটিতে স্থান দিয়েছেন। পদভেদে ১০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। ফ্রিডম পার্টি ও যুবদলের অনেকে টাকার বিনিময়ে ঠাঁই পেয়েছেন যুবলীগে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।

যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা জানান, বিগত সাত বছরে তারা চেয়ারম্যানের ভয়ে তটস্থ ছিলেন। মুখ বুজে সব অপকর্ম সহ্য করেছেন। সংগঠনে সব সিদ্ধান্ত তিনি এককভাবে নিয়েছেন। আমাদের শুধু সম্মতি দিতে হয়েছে। তার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মত দিলেই তাৎক্ষণিক বহিষ্কার, অফিসে আসতে বারণ পর্যন্ত করা হয়েছে। তারা বলেন, তার সব অপকর্ম জায়েজ করার মেশিন ছিল যুব জাগরণ প্রকাশনা। এখান থেকে নানা বই ও প্রকাশনা বের করে সবার কাছে ভালো সাজার চেষ্টা করতেন। পুরো সাত বছরে যুবলীগ বলতে আমরা শুধু তাকেই বুঝতাম।

প্রসঙ্গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় চাঁদা দাবির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে অপসারণের নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি যুবলীগ নেতাদের বিষয়েও চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, যুবলীগের এক নেতা অস্ত্র উঁচিয়ে চলে। আরেকজন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে বেড়ায়।

এর পর গণমাধ্যমে যুবলীগ নেতাদের সংশ্লিষ্টতায় ঢাকার ৬০টি জায়গায় ক্যাসিনো পরিচালনার খবর প্রকাশ হয়। ১৮ নভেম্বর ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস, ওয়ান্ডারার্স এবং গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম, বিপুল পরিমাণ মদ ও ৪০ লাখের বেশি টাকা উদ্ধার করে র্যা ব। ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে ওই দিনই যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়, যিনি ইয়াংমেনস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন।

পাশের ওয়ান্ডারার্স ক্লাব থেকেও জুয়ার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ ক্লাব পরিচালনার নেতৃত্বে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার। এর পর ধানমণ্ডির কলাবাগান ক্রীড়াচক্রে অভিযান চালিয়েও ক্যাসিনো চালানোর প্রমাণ পায় র্যা ব। অস্ত্র-গুলি ও ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয় ক্লাবের সভাপতি কৃষক লীগের সহসভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে।

এর মধ্যে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি করা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীমকে গ্রেফতার করা হয়। পরে গ্রেফতার করা হয় মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বিসিবির পরিচালক লোকমান ভূঁইয়াকে।

দুবাই থেকে গ্রেফতার করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে। পরে গ্রেফতার করা হয়েছে ক্যাসিনো সম্রাট যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানকে ‘শুদ্ধি অভিযান’ নাম দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সন্ত্রাস, চাঁদবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের ভাসানচরে পাঠানো হবে।

ক্যাসিনো ব্যবসায় যুবলীগ নেতাদের মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তলব করা হয়েছে ব্যাংক হিসাব।