কোর্ট প্রাঙ্গণে অ্যাটর্নি জেনারেলকে চীর বিদায়ী শ্রদ্ধা

দীর্ঘদিনের কর্মস্থল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে প্রিয় সহকর্মী, স্বজন, শুভাকাঙ্খীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা স্নিগ্ধ ফুলের সৌরভে চীর বিদায় জানালেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে।

সোমবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রাঙ্গণে ফুলেল শ্রদ্ধায় তাকে শেষ বিদায় জানানো হয়।

তার আগে বেলা সাড়ে ১১টায় সেখানেই তার জানাজা হয়। জানাজার নামাজ পরিচালনা করেন সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের খতিব আবু সালেহ মো. সলিমুল্লাহ।

জানাজা শেষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয় মাহবুবে আলমের কফিনে।

শ্রদ্ধা জানাতে আসা সমবেতদের উদ্দেশে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, “মাহবুবে আলম নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে গেছেন আইন পেশা ও আইনজীবীদের প্রতি দায়বদ্ধতা রক্ষার জন্য। সেই দায়বদ্ধতা রক্ষা করতে গিয়ে যদি কোনো ভুল করে থাকেন, তবে আপনারা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর যদি কারো কোনো ধরনের পাওনা থেকে থাকে তাহলে তার (মাহবুবে আলমের) কন্যা আইনজীবী শিশির কনার সাথে, অথবা আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।”

মাহবুবে আলমের ছেলে সুমন মাহবুব বলেন, “কোনোভাবে যদি আমার বাবার দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমার বোন আইনজীবী সমিতির সদস্য, তার প্রতি আপনারা খেয়াল রাখবেন। আমার আর কিছু বলার নাই।”

এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, আইন সচিব মো. গোলাম সারওয়ার শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেলের কফিনে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সোমবার সুপ্রিম কোর্ট নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রমে বসেনি।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “মাহবুবে আলমের আদর্শেই তরুণ আইনজীবীরা পেশাদারী হয়ে উঠবেন। তার আদর্শ আইনজীবীদের পদ দেখাবে।”

ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, “মাহবুবে আলমের আদর্শ ও পেশাদারিত্ব অনুসরণীয়। আইন পেশায়, আইনজীবীদের মধ্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”

জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মাহবুবে আলমের কফিন নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থনে। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন।

রোববার সন্ধ্যায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মাহবুবে আলম। তার বয়স হয়েছিলো ৭১ বছর ৬ মাস। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন তিনি।

গত ৪ সেপ্টেম্বর জ্বর নিয়ে ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি হয়েছিলেন মাহবুবে আলম। সেখানে নমুনা পরীক্ষায় তার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে।

তবে সর্বশেষ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষায় ফল নেগেটিভ এসেছিল বলে জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

মাহবুবে আলম ২০০৯ সালে অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে নিয়োগ পান। পদাধিকার বলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।

অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সর্বোচ্চ আদালতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন মাহবুবে আলম।

এছাড়া সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনী মামলা পরিচালনাও করেন তিনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মামলায়ও যুক্ত ছিলেন মাহবুবে আলম। আলোচিত বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

মাহবুবে আলমের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৬৯ সালে লোক প্রশাসনে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। পরে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন।

ছাত্র জীবনে বাম আন্দোলনে যুক্ত মাহবুবে আলম পরে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

১৯৭৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে এবং ১৯৮০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইন পেশা পরিচালনার অনুমতি পান মাহবুবে আলম। ১৯৯৮ সালে তিনি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ফাইল ছবিঅ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ফাইল ছবিআওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবে আলম। ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির আগে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন।

সেনা নিয়ন্ত্রিত ওই সরকার আমলে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হওয়ার পর শীর্ষ আইনজীবীদের অনেকে পিছুটান দিলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মাহবুবে আলম। দৃশ্যত সেই কারণেই তার উপর আস্থাবান ছিলেন শেখ হাসিনা।

প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমপ্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমএছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, ল’ রিপোর্টার্স ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি ফুলেল শ্রদ্ধায় বিদায় জানান মাহবুবে আলমকে।

সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন মাহবুবে আলম। তবে তাকে প্রার্থী না করে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বই চালিয়ে যেতে বলা হয়।