“সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম”

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভায় মেয়র আব্দুল কাদের মির্জা। তিনি দেশজুড়ে একটি আলোচিত নাম। কাদের মির্জা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। ওবায়দুল কাদের এর ভাই বলেই তিনি দেশের মানুষের কাছে আলোচিত ও পরিচিত নাম নয়। তিনি পরিচিতি পেয়েছেন তাঁর নিজগুণে। ওবায়দুল কাদেরের অন্য আরো ভাইদের নাম দেশের মানুষ জানেও না। চেনেও না। মির্জা কাদেরকে চেনে কারণ ২০২১ সালে পৌর নির্বাচনে প্রচারণার সময় তিনি “সত্য বচন নামে” রাজনৈতিক মঞ্চ কাঁপানো কথা বার্তা বলেছেন, যেটা এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন, পদে আছেন, এমন কেউই এসব কথা বার্তা বলেন না। সাধারণত বলার কথাও না। কখনো বলেনি। তাঁর বক্তব্যগুলো মূহুর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। লাখ লাখ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সেই বক্তৃতা দেখতে থাকে। “সুষ্ঠু ভোট হলে অনেক এমপি পালাবার পথ পাবেন না” বলে নিজ দলের সংসদ সদস্যদের কটাক্ষ করেন। বৃহত্ততর নোয়াখালী অঞ্চলের তিনজন সংসদস্যদের নিয়ে নানা বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে চাকরির দেয়ার কথা বলে ঘুষ নেয়া, দলে বিএনপি জামায়াত কর্মীদের অনুপ্রবেশ করানো এবং আওয়ামী লীগ কর্মীদের অবহেলা করার অভিযোগ আনেন। তাঁর মতো শেকড় থেকে আওয়ামী লীগ না করলেও টাকার জোরে ওইসব ব্যক্তিরা নেতা হয়েছেন বলে অভিযোগ তোলেন।

এ নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ আবদুল কাদের মির্জার সমালোচনা করেন। কাদের মির্জা কেন্দ্রীয় নেতাদেরও একহাত দেখে নেন। তাঁর বক্তৃতা নিয়ে ব্যপক উত্তেজনা তৈরি হয়, রাজনৈতিক মহলে।

তাঁর বক্তৃতার ধরণ অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা। নিজ ঢং এ কথা বলেন চলতি ভাষায়, তবে মাঝে মাঝেই নোয়াখালী অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেন। যেটা স্রোতাদের অকৃষ্ট করে। বক্তৃতায় হাস্যরস তৈরী করতে পারেন। আবার তাঁর উপর শিবিরের হামলা, বিএনপির মিথ্যা মামলা কিংবা ১৫ আগস্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে মানুষের চোখে পানিও আনতে পারেন। তাই শুধু উপস্থিত দর্শক নয়, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তৃতা শুনেছেন, তারাও ব্যপকভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন। ইতিহাসের উপর তাঁর বেশুমার দখল আছে। সেই ইতিহাসের অলিগলি ঘুরিয়ে এনে পাশের বাড়ির বছির মিয়ার কথাও বলে ফেলেন।

আলোচনায় কাদের মির্জা:

এজন্য নির্বাচনের তিন দিন আগে একাত্তর টেলিভিশনেের পক্ষ থেকে বসুরহাট পৌরসভায় আমাকে পাঠানো হয় নির্বাচন কাভার করতে। একটা পৌরসভার নির্বাচনে শত শত মানুষকে নির্বাচনী জনসভায় যোগ দিতে দেখেছি। পিন পতন নীরবতা বিরাজ করতো বক্তৃতা দেয়ার সময়। বিএনপি বা জামায়াতের নেতা কর্মীদের কাছে থেকেও তাঁর কোনো অনিয়মের তথ্য বা অভিযোগের কথা বের করতে পারিনি। এমনকি ব্যক্তগত পর্যায়েও আলাপ করেও কাদের মির্জাকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য কেননি কেউ। বসুরহাট ছোট্ট জায়গার মধ্যে আব্দুল কাদের মির্জা নেতা। নায়ক। অভিভাবক। তাকে ঘিরে মানুষ আর নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস আমাকে সত্যিই অবাক করেছে। তাঁর নির্দেশ কর্মীরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এতো সুশৃংঙ্খল আগে আমি খুব কমই দেখেছি।

২০২০ সালে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে আমেরিকায় গিয়েছিলেন কাদের মির্জা। ভেবেছিলেন মারা যাবেন। কিন্তু বেঁচে গেছেন। সেখান থেকেই সিধান্ত নিয়েছেন যা কিছু সত্য হিসেবে জাননে ও মানেন সব বলে দেবেন। এতে যে বিরাগভাজন হবার হবে। কিন্তু তিনি সত্য বলা থামাবেন না। জেল ফাঁস যা-ই হয় হোক।

কিন্তু বাঙালি মানেই সন্দেহ বাতিক আর ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসী। বিশ্বাস করতে চাই না কাদের মির্জার এসব কথা। তাই অনুসন্ধানে নামলাম ভেতরের রহস্য খুঁজে বের করতে। নিশ্চয়ই কিছু পেতে চান, নিশ্চয় ওবাদুল কাদেরকে হেয় করতে চান উল্টাপাল্টা বলে। তাই অনুসন্ধানে নামি। জানতে পারি বড় ভাই ওবায়দুল কাদের এর স্ত্রী সাথে কিছু একটা নিয়ে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই তাকে বাসা থেকে চলে যেতে বলেছিলেন ভাবী। তাই রাগ ভাবির উপর! এগুলো উড়ো খবর জানতে পারি। সত্য মিথ্যা যাচাই করা যায়নি।

কিন্তু এমপিদের বিষয়ে? জাতীয় ইলেকশন নিয়ে কেনো বির্তকিত মন্তব্য করলেন? তাই নির্বাচন কভার করতে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা শুরু করি৷ তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে তথ্য বের করার চেষ্টা করি। পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয় স্বজন বহু মানুষের সাথে কথা বলি৷ তাঁর ঘরের মানুষ, বাইরের মানুষ। না তেমন কিছু বের করতে পারি না। এমপি একরামুল হক চৌধুরী ও নিজাম হাজারী। যাদের বিরুদ্ধে “গড ফাদার ও সন্ত্রাসের মদদদাতা” বলে অভিযোগ দেগেছেন তাদেরও ইন্টারভিউ নিলাম। তারাও অবাক কেনো এতো অভিযোগ করছেন তারাও নিশ্চিত নয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে হলে ধরে নেয়া যেতো তিনি এমপি হতে মনোনয়ন চান। ৪৮ বছরের রাজনীতি করছেন সেটা চাইতেই পারেন। কিন্তু সেটাও তো নয়। যা হোক সাংবাদিক হিসেবে কিছুটা রহস্যই থেকে গেলো তবে, ২০০১ সালে ওবায়দুল কাদের এর বিরুদ্ধে নির্বাচন করা একরামুল হক চৌধুরীকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরাতে পারাটা হয়ত তাঁর সফলতা ধরা যেতে পারে। কিন্তু তিনি নিজেও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি থেকে উপজেলার সদস্য পদে নেমে গেছেন। এটাকে ‘সত্য বচন’ আন্দোলনের সফলতা বলা যাবে কিনা জানি না। তবে ওই আলোচিত বক্তৃতাগুলোর পর বড় ভাই ওবায়দুল কাদের এর সাথে আয়োজন করে দেখা করেছেন বা বৈঠক করেছেন।

আত্মজীবনী:

খবর পেলাম আব্দুল কাদের মির্জা আত্মজীবনী লিখেছেন। নাম ” সত্য যে কঠিন”। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “রূপ-নারানের কুলে” কবিতার একটি লাইন থেকে তিনি নামটি নিয়েছেন।

রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম;
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম-
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন-
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে।

হঠাৎ “সত্য বচনের” রহস্য উৎঘাটন করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত সমাপ্তি টেনছিলাম এভাবে যে জীবনের সাথে হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা মানুষের চিন্তা ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন আনতে পারে। যে কারণে রক্তের স্রোত দেখে রাজা অশোকা রাজ্য ছেড়ে অহিংস বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক হয়েছিলেন।

আরো যদি কিছু জানা যায়, তাই আব্দুল কাদের মির্জার বই এর প্রতি আগ্রহী হলাম। কারণ নোয়াখালীর রাজনীতিকদের মধ্যে বই এ সত্য লেখার নজির আছে। বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদও তার লিখিত বই এ ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করায় তাঁর দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রুচি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কাদের মির্জার আত্মজীবনীতে কি লিখেছেন সেটা জানার আগ্রহ হলো।

ইন্তমিন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটির প্রাক কথনে তিনি লিখেছেন, “শিক্ষা হলো জীবন ব্যাপী প্রক্রিয়া, জীবনের শিক্ষা সিলেবাসে বন্ধি থাকে না।” তিনি তাঁর ৪৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনব্যাপি পাওয়া শিক্ষা আর বাস্তব ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন বইটিতে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়েছে ও হিলারী কিলিংন্টনের living history পড়েছি। শেখ হাসিনার সবুজ মাঠ পেরিয়ে বইটি পড়েছি। এরবাইরেও আবুল মনসুরের আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর বইটি পড়েছি। এখানকার রাজনীতিকদের সংসদের বক্তৃতা শুনে তাদের প্রাজ্ঞতার পরিধি নিয়ে প্রশংসা করি কিন্তু একেবারে পেরি ফেরিতে, গ্রামে গঞ্জে রাজনীতি করা মানুষদের মধ্যে কারো কারো জানা শোনার পরিধি অনেক বড় নেতার চেয়ে কম থাকে না। তাদের কথা খুব কমই জানা হয়। বইটিতে তেমন একজন রাজনীতিকে পাওয়া যাবে।

দেশের যত গণতকন্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, আমরা সেটার শহরের অংশটুকু দেখি, গণমাধ্যমের কল্যাণে। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে, একই আন্দোলন হয়। গ্রামের নেতাদের হাত ধরেই আন্দোলন ছড়ায় ঘরে ঘরে। আব্দুল কাদের মির্জার এই আত্মজীবনী যেনো আওয়ামী লীগের সেই সব কর্মীর কণ্ঠস্বর। অবহেলিত কর্মীদের মিথ্যা মামলার বোঝা নিয়ে মাসের পর মাস জেলের ঘানি টানা, টাকা পয়সার অভাবে ছোট্ট কন্যা শিশুর দুধ কিনতে না পারা, স্ত্রী, সন্তানদের সময় দিতে না পারা এমন নানা হাহাকারের কথা ওঠে এসেছে বইটিতে। যে হাকাকার একা কাদের মির্জার নয়। তিনি লিখেছেন, “নোয়াখালী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ পিন্টু একরাম চৌধুরীর বাচ্চা ছেলের ছবি বুকে লাগিয়ে ঘুরে, এগুলো দেখলে দুঃখ লাগে লজ্জা লাগে। নির্বাচনে নমিনেশন পাওয়ার জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারীর ছেলের তোষামোদি করতে হবে এর চেয়ে দুর্দিন কি রাজনীতিতে আসতে পারে?” প্রশ্ন রেখেছেন তিনি। প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগের পুরো মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে!

মুক্তিযুদ্ধের তাঁর পিতার ভূমিকা:

স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবাকে নিয়ে বইটি শুরু হয়েছে। তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুর সাথে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়ালেখা করেছেন। বেকার হোস্টেলে পাশাপাশি কক্ষে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু পরিবারকে রাজাকার বাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছেন। দুইভাই মুক্তিযোদ্ধা। এরমধ্যে ওবায়দুল কাদের ছিলেন কোম্পানীগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তবে তাঁর জ্যাঠা (চাচা) এরফান মিয়া রাজাকার ছিলেন। যাকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে তাঁর ভাই হত্যা করেছে বলে তিনি লিখেছেন। তাঁর পিতাকে নিয়ে রাজনীতি ও মিথ্যাচারের বিচার কার কাছে দেবেন সেই প্রশ্ন রেখেছেন। ( সত্য যে কঠিন, পৃষ্ঠা : ১৪)

ছোট বেলার কথা:

হূমায়ূন আজাদ এমন একটা কথা লেখেছেন যে, বাঙালি আত্মজীবনী লিখতে পারে না। আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে আত্মপ্রশংসা লিখে ফেলে। কারণ গোপনে সে যে অপরাধ করে সেটা লিখে না। তবে কাদের মির্জা নিজের প্রসংশা নয়, নিজের বদনামও নিজেই লিখেছেন। ১৯৭৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগের রাতে একবন্ধুর পাল্লায় পরে গাঁজা খেয়েছিলেন, সিগারেট খেয়ে শিক্ষকের হাতে মারও খেয়েছেন, পাছার লুঙ্গি তুলে পিটিয়েছে শিক্ষক, আগে গাঁজা খাননি, ওই দিনই প্রথম, তাই মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন। যে কারণে একটি পরীক্ষা দিয়ে আর পরীক্ষাই দিতে পারেনি, সে বছর। পরের বছর ১৯৭৮ সালে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। এমন বহু গোপন সত্যও নিজে গোপন রাখেন নি। সেটাও বলে দিয়েছেন।

বইটিতে স্বাধীনতার আগের ও পরের বাংলাদেশের গ্রামীন জীবনের বর্ণনা। গরুর গাড়িতে চেপে মায়ের সাথে নানা বাড়ি যাওয়া, লুঙ্গি পরে, স্যাল্ডেল ছাড়া, হাতে বই নিয়ে কলেজ করা, ১/২টি শার্ট দিয়েই বছরের পর বছর পার করে দেয়া, মেলা, জারি গান, সারি গান, পালা গানের চাক্ষুষ বর্ণনা আছে। যার সব কিছু এখন হারিয়ে গেছে। লুঙ্গি পরে কলেজ করা এখনকার ছেলে মেয়েরা কল্পনাও করতে পারে না। সন্ধ্যার পরপরই গ্রামের মানুষ ঘুমিয়ে পড়তে, কুপি বাতি জ্বালানোর পয়সা ছিলো না। এসব কিছুর নিখুত বর্ণনা আছে। ২০০০ সালের আগে যারা গ্রামে বেড়ে ওঠেছে তাদের নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা বইটিতে পাওয়া যাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, মোবাইল, ল্যাপটপ নিয়ে থাকা এখনকার ছেলে মেয়েরা অবাক হবে এই ভেবে যে এমনটা ছিলো গ্রাম! অর্থিক অনটন, অভাব, হাড্ডিষাড় মানুষ, কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীদের প্রতি সখ্যতা ছিলো। আত্মীয়দের মধ্যেও খুব ভাব ছিলো। এখন যেটা কমে গেছে।

রাজনীতিতে হাতে খড়ি, জেল জুলুম:

১৯৬৯ সালে স্কুলে থেকেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। আব্দুল কাদের মির্জার। আয়ূব বিরোধী আন্দোলনে, “শেখ মুজিববের মুক্তি চাই, ১১ দফা মানতে হবে মানতে হবে” স্লোগান দিতে দিতে বড় হয়েছেন। ৯ম শ্রেনীতে স্কুল ছাত্রলীগের কোষাদক্ষ হোন। তারপর থেকে রাজনীতির মাঠে ছিলেন। ” বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর উজানের কৈ মাছের মতো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে ছাত্র শিবির (সাবেক ছাত্রসংঘ) মুক্তিযুদ্ধের সময় লুটপাট আর বাঙ্গালী নিধণে ব্যস্ত থাকা (সাবেক ছাত্রসংঘের কর্মীরা) শিবির কর্মীরা ১৯৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত জাসদের সাথে মিশে তান্ডব চালায়।” পৃষ্ঠা ৪৯। এইখানে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির সহিংস অধ্যায়ের বর্ণনা আছে। ” জাসদ কোম্পানীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা কামাল ভাইকে হত্যা করে, জাসদের ভয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাড়িতে ঘুমাতে পারতো না।” জাসদের অত্যাচারের বিষয়ে খুব কমই লিখা পাওয়া যায়। গ্রামীন জনপদে জাসদের তাণ্ডবের কথা পাওয়া যায় বইটিতে। সেজন্যই কাদের মির্জার মতো পোড় খাওয়া নির্যাতিত আওয়ামী লীগের কর্মীরা, জাসদকে আওয়ামী লীগের সাথে একই থালায় ভাত খেতে দেখলে বিরক্ত হোন।

শিবিরকে রগকাটা পার্টি বলা হয়। যেটার শিকার হয়েছিলেন মির্জা কাদের নিজে৷ “সত্য যে কঠিন বইটিতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বর্ণনা পাওয়া যাবে। প্রথম জেলের ভাত এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে, ১৯৮২ সালের ২৮ মার্চ। তারপর ১৯৯১ সালে বিএনপি পরে, ২০০১ সালে আরেকবার বিএনপি ক্ষমতা নেয়ার পর মিথ্যা মামলার খড়গ নেমে এসেছিলো আব্দুল কাদের মির্জার উপর। ভিন্ন উপজেলায় গণপিটুনিতে ডাকাত মারা যাওয়ার আসামী করা হয়েছে, ভ্যান চালক হত্যা মামলার আসামী হয়েছে। ২০০১ সালে নির্বাচনের ২ দিন আগে বসুরহহাট পৌরসভা থেকে গ্রেফতার হোন সেনা বাহিনীর হাতে। ১৮ টি মামলা মোকাবেলা করতে হয়েছে। যেগুলোকে ” আইন মন্ত্রী মওদুদ সাহেবের প্রতিহিংসার রাজনীতির ষড়যন্ত্র” বলেছেন কাদের মির্জা। সোনা গাজির ফোর মার্ডার মামলার আসামী করা হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেমে নেই। এখনো অনেকে সেই প্রতিহিংসার শিকার হয়৷ জেলের ঘানি টানছেন। সেই সাথে বইটিত আছে জেলা জীবনের অসহনীয় বর্ণনা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারগারের রোজনামচা বই এর মতো তিনি কারাগারে খাবারের মান উন্নত করার কথা বলেছেন। ” অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষ কোনো দোষ না করেও কারা ভোগ করছে। প্রতিহিংসা কিংবা পুলিশের অপারদর্শীতায় প্রকৃত অপরাধীকে রেখে নিরাপরাধ মানুষকে ফাঁসানো হয়।” তাই জেল জীবনে থেকে তাঁর উপলব্ধি কোনো নিরাপরাধ মানুষকে যেনো জেল জুলুমের শিকার না হয।”

ত্মজীবনীতে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে নিজ জীবনের প্রেম, বিয়ে এবং সন্তানদের কথা। বড় ভাই ওয়বাদুল কাদেরর কথায় নিজে পাত্রী না দেখেই বিয়ে করেন মির্জা কাদের। এমনকি তাঁর স্ত্রী আখতার জাহান বকুলও তাকে দেখেননি। নানা চাড়াই উৎরাই পেরিয়ে তাদের সংসার। বারবার জেলে গেছেন। একদিনের মেয়ে ফার্সাকে হাসপতাল থেকে ঘরে আনতে পারেননি, মিথ্যা মামলায় জেলে নিয়ে গেছে পুলিশ। এমন ঘটনা শুধু একার আব্দুল কাদের মির্জার ক্ষেত্রেই ঘটেনি। আওয়ামী লীগের হাজার হাজার কর্মীর জীবনেই ঘটেছে। যাদের সেই ত্যাগের বিনিময়েই ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু তেমন কর্মীদের দলে মূল্যায়ন হয় না। উড়ে এসে কিছু লোক জুড়ে বসে। সেই আক্ষেপের গল্পও পাওয়া যাবে বইটিতে। মহামারী করোনা আর তাঁর ছোট বেলায় দেখা গুটি বসন্ত, ওলাওঠা বা কলেরার কথা। পৌর মেয়র হিসেবে কিভাবে মানুষের জন্য কাজ করেছেন সেই বর্ণনা দিয়েছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে ১২ অক্টোবর ২০২১ কুমিল্লাতে পূজামন্ডপে কোরআন রেখে হিন্দুদের উপর হামলার বিষয়টি। যা ছড়িয়ে পরে দেশের বেশ কিছু জেলায়।

নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক হামলা নতুন নয়। বিশদ বর্ণানা আছে ১৯৪৬ সালের নোয়াখালী ও ত্রিপুরার দাঙ্গার। তিনি লিখেছেন, “জুমআ নামাজের পর বসুরহাট বঙ্গবন্ধু চত্ত্বরে বিএনপি, জামাত, হেফাজত মিছিলের নামে সন্ত্রাসী মহড়া দেয়ার চেষ্টা করে। তারা মন্দিরে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের নিয়ে তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেই। তখন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলো পুলিশ ও RAB”।

নোয়াখালীর চৌমুহীনসহ বিভিন্ন জায়গায হামলা হয়েছে, জবাই করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বসুরহাটে সেটা হয়নি। একজন কাদের মির্জা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন৷ নেতা কর্মীদের নিয়ে। কোথাও যদি আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে,কাদের মির্জার মতো জনপ্রিয় নেতা থাকে তাহলে সেখানে সাম্প্রদায়িক হামলা হবে না। হতে পারে। না। তারই প্রমান দিয়েছেন কাদের মির্জা। বইটিতে ১/১১ সরকারের সময়ে তৃণমূূলের কোনো কোনো নেতার কিংস পার্টিতে যোগ দেয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। একই সাথে ভ্রমনের গল্পও পাওয়া যাবে আত্মজীবনীতে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব এবং আমিরিকা ভ্রমণের নিখুত বর্ণনা দিয়েছেন। বইটি পড়লে মনে হবে যেনো নিজোর চোখেই সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে দেখছি কিংবা নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ।

সত্য বচন:

শেষ দিকে আবার কিছু জ্বালাময়ী অপ্রিয় সত্য কথা লিখেছেন আবদুল মির্জা কাদের। জমির রেজিস্ট্রি ও নামজারিতে দুর্নীতি, চিকিৎসক ও শিক্ষকদের দুর্ণীতি। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের দুর্ণীতি। তিনি মনে করেন, রাজনীতিবিদের দুর্ণীতি নিয়ে কথা হয় কিন্তু আমলা থেকে যায় ধরা ছোয়ার বাইরে। ” দুর্নীতি ও ঘুষের কারণে বাজেটের ৫০ শতাংশ কাজও হয় না। ১০ টাকা বাজেট হলে, গ্রামে যেতে ১ টাকা হয়ে যায়।” (পৃষ্টাঃ ১৮৮)

এমন সাহসী উচ্চারণ সত্য বচনে প্রতিজ্ঞা নেয়া ব্যাক্তিই কেবল করতে পারেন। তবে দুর্নীতির জন্য জনগণকেই দায়ী করেছেন। বলেছেন, জনগণ অবৈধ উপায়ে কার্য উদ্ধার করতে চায়, তখনই সরকারী কর্মচারীরা দুর্নীতির সুযোগ পায়। তবে দুর্নীতির দায়ে আমলাদের শাস্তি না হওয়ায় খেদ দেখিয়েছন, তার ভাষায়, ” আমলারাই রাজনীতিবিদের দুর্নীতি শেখায়। সরকার পরিবর্তন হলে সচিবরা খোলস পাল্টে সরকারের খাস লোক বনে যায়।” (পৃষ্টাঃ ১৯২)

বইটি পড়ে মনে হয়েছে, যখন যে বিষয়ে মাথায় এসেছে সেটা লিখেছেন লেখক। ঘটনার পরিক্রমা ধরে লিখেন নি। তবুও পড়তে গিয়ে আগ্রহ হারাবে না পাঠক। বক্তৃতার ঢং এ লিখে গেছেন আত্মজীবনী। বানানে তেমন ভুল চোখে পড়েনি, ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ আছে এমন পাঠকদের কাছে ভালো লাগবে।