সালমান এফ রহমানের সাথে ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

হঠাৎ করে নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় চলমান কাজসমূহের মূল্য সমন্বয় এবং নতুন রেট সিডিউলের দাবিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সাথে এক মতবিনিময় সভা করেছে বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদ।

রবিবার ( ২৬ জুন ) দুপুরে আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)’য় এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেন, উন্নয়নবান্ধব বর্তমান সরকারের দুরদর্শিতা এবং কার্যকর পদক্ষেপসমূহের কারণে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাতারে সমাসীন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক ও সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর জন্য সরকার বদ্ধ পরিকর। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামোসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহায়ক হিসেবে সারাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের ঠিকাদারবৃন্দ সাফল্যের সাথে বাস্তবায়ন করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বিগত এক বছরের অধিক সময় ধরে নির্মাণ প্রকল্পের মূল উপকরণসমূহ যেমন- লৌহ ও লৌহজাতীয় দ্রব্য, সিমেন্ট, পাথর, ইট, বিটুমিন, ডিজেল, অ্যালুমিনিয়াম, বিল্ডিং ফিনিশিং আইটেম ইত্যাদি দ্রব্যাদিসহ এ খাতের প্রায় সকল প্রকার নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক ও লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়ে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

তারা জানায়, বর্তমানে প্রতিটন রডের বর্তমান মূল্য ৯০ হাজার টাকা থেকে ৯৫ হাজার টাকা হয়েছে যা ২০২১ সালের মার্চ মাসে ছিল ৫৫-৬০ হাজার টাকা। অর্থ্যাৎ শতকরা বৃদ্ধির হার ৬০ শতাংশ এর অধিক। পানি সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, ইলেক্ট্রো ম্যাকানিক্যাল দ্রব্য সমূহের মূল্যও ৪০-৯৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও এ শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক, সুপারভাইজার ও দক্ষ জনবলের মজুরিও শতকরা ৬০-৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেলের মূল্য ৬৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ টাকা হওয়ার ফলে নির্মাণ সামগ্রি পরিবহন ও যন্ত্রপাতি চালন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি, চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমদানীকৃত সকল নির্মাণ মালামালের ও যন্ত্রপাতির মূল্যও ক্রমান্বয়ে আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া নির্মাণ প্রকল্পে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুত বিল চুক্তিকৃত Rate এর সাথে সন্নিবেশিত না থাকায় ঠিকাদারকে তা পরিশোধ করতে হয়। গত অর্থ বছরে দরপত্র দাখিলের সময় ৫% হারে AIT ধার্য্য ছিল এখন তা ৭% করা হয়েছে এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পের অগ্রগতিতে অতি মন্থরতা দেখা দিয়েছে, বাস্তব অগ্রগতি খুবই হাতাশাব্যঞ্জক। কাজের স্বাভাবিক অগ্রগতি অর্জিত না হওয়ার ফলে ঠিকাদারগণ বিল পাচ্ছেন না। ফলে গৃহীত ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বিধায় ব্যাংক হতে আর্থিক সহায়তা প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে এবং ঠিকাদার গণের আর্থিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। নির্মাণ সামগ্রীর সীমাহীন অসহনীয় উর্দ্ধগতিতে ঠিকাদারগণ মারাত্মকভাবে আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

ঠিকাদার নেতারা বলেন, ঠিকাদাররা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নকারী নির্মাণ প্রতিষ্ঠানসমূহ সব সময় চলমান বাজারদরের উপর ভিত্তি করে দরপত্রের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে থাকেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক দরে কার্যাদেশ প্রাপ্ত হন। সাধারণত GOB ফান্ডের সমস্ত কাজ Fixed Rate এ কার্যাদেশ প্রদান করা হয় এবং কার্যাদেশ প্রাপ্তির পরে কার্য সমাপ্তির কার্যকালিন সময়ে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি পেলেও আমরা সরকার থেকে কোন প্রকার মূল্য সমন্বয় (Price Adjustment) পাই না। সরকার ঘোষিত Public Procurement Regulation ধারা অনুযায়ি GOB Funded প্রকল্পে ১৮ মাসের অধিক কার্যকালীন সময়ের দরপত্রে Price Adjustment Clause সন্নিবেশিত করার বিধান থাকলেও Procurement Entity তা অনুসরণ করেন না। যদিও বিদেশী অর্থায়নের প্রকল্প সমূহে Price Adjustment Clause বা Rate Escalation Clause সন্নিবেশিত থাকে। নির্মাণ সামগ্রীর বাজার দর বহুবার বৃদ্ধি পেলেও Rate Schedule হালনাগাদ করা হয়নি। বর্তমানে দেশের সড়ক, মহাসড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট, বিভিন্ন সুউচ্চ ভবন ইত্যাদিও কাজ প্রায় বন্ধ। ঠিকাদারগণ ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

ঠিকাদার নেতারা আরও বলেন ,সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনা সম্ভব হয়। গত ৬ এপ্রিল মহান জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনের সমাপনি ভাষণে দেশরত্ন শেখ হাসিনা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে দর সমন্বয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য প্রধান করেন। তিনি বলেন, “রড, সিমেন্ট থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, প্রতিটি দেশে সময়ে সময়ে দাম বাড়ে। তার সাথে দর সমন্বয় করে কাজ করে। এটা নিতে হয়। এটা করতে হবে, না হলে আমার কাজ সম্পন্ন হবে না। আমি যদি সম্ভার আশায় বসে থাকি, আমার কাজও এগুবে না।

বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের সাথে মতবিনিময় সভা করা হয়, ৩ নভেম্বর, ২০২১ তারিখে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকের সাথে সমসাময়িক যাবতীয় সমস্যার কথা তুলে ধরি, FBCCI এর সভাপতি জনাব জসীম উদ্দীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এই খাতের যাবতীয় সমস্যার কথা উল্লেখ করে একটি পত্র লেখেন, যার কপি সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়, ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর (BACI)’র উদ্যোগে রাজধানীর রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলন করা হয়, ২৮ মার্চ, ২০২২ উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলাসহ মোট ১৯টি জেলার প্রতিনিধিদের নিয়ে বগুড়ায় একটি মতবিনিময় সভার মাধ্যমে তাদের দাবী দাওয়া উপস্থাপন করেন। এছাড়াও নেত্রকোণা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় ঠিকাদারগণ তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

এমন অবস্থায় ঠিকাদারদের রক্ষায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত CPTU এর কাছে বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদ কিছু দাবী জানিয়েছেন। দাবি গুলো হলো:

১. বর্তমান চলমান কাজগুলো যেহেতু Fixed Rate Contract এ সম্পাদিত হচ্ছে তাই বিশেষ ব্যবস্থায় প্রজ্ঞাপন জারি করে PPR-এ সন্নিবেশিত ফর্মূলা অনুযায়ি Price Adjustment ধারা প্রয়োগ করে চলমান চুক্তিবদ্ধ কাজের দর সমন্বয় করা হউক অথবা চলমান কাজে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির জন্য যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতির জন্য Compensation দেয়া হোক। গত ২১ শে জুন গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদফতরের নতুন Rate Schedule অনুমোদন করেছেন। তাতে গড়ে ৩০% শতাংশ পর্যন্ত দর বৃদ্ধি হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা বরাবর দর সমন্বয়ের উপর গুরুত্ব আরোপের কথা বলেছি কিন্তু দর সমন্বয় প্রক্রিয়াটি একটি জটিল ও ক্ষমতা অপব্যবহারের কারন হতে পারে মনে করে করোনা কালীন সময়ে Award প্রাপ্ত সকল চুক্তির জন্য বর্তমানে ঘোষিত PWD Rate Schedule অনুযায়ী দর সমন্বয় করা হোক।

২. এখন থেকে প্রতিটি দরপত্রে কাজ বাস্তবায়নের সময় বিবেচনা ব্যতিরেকে PPR অনুযায়ি অত্যাবশ্যকীয় মূল্য সমন্বয় ধারা (Price Adjustment Clause) সন্নিবেশিত করে কার্যকর কারণসহ এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারিতা, অজ্ঞতাপ্রসুত এবং PPR ২০০৮ (সংশোধিত) এর সহিত সাংঘর্ষিক আরোপিত শর্তাবলি দরপত্রে প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হোক।

৩. প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত খরচ সকল Rate Schedule এ সন্নিবেশিত করা হোক।

৪. বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিটি নির্মাণ কাজের প্রাক্কলনে Price Contingency এর আওতায় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা হোক।

৫. সরকারের পরিপত্র ও বিধিনিষেধ আরোপের কারণে নির্মাণ সামগ্রীর দরের পরিবর্তনের প্রভাব এবং নির্মাণ
ব্যয় সমন্বয় সংক্রান্ত PPR এ বর্ণিত ধারা Adjustment for changes in legislation’ কার্যকরি করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত নির্বাহী প্রতিষ্ঠানকে জরুরী আদেশ প্রদান করা হোক।

৬. আমদানি নির্ভর নির্মাণ সামগ্রীর কাঁচামালের আমদানি শুল্ক সাময়িকভাবে হলেও স্থগিত করা হোক।

৭. চলমান নির্মাণ চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়ন নির্বাহী প্রতিষ্ঠান যেমন- গণপূর্ত, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি মূল্য সংশোধন সেল গঠন পূর্বক চুক্তিবদ্ধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা হোক।

বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের দাবীসমূহের একটি কপি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে দেওয়া হয়। এসময় তিনি দাবিগুলো বিবেচনার আশ্বাস দেন।

সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের সভাপতি রফিক আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক ম. আব্দুর রাজ্জাক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বাসি) ডিরেক্টর হাসান মাহমুদ বাবু, ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বশির আহমেদ, সম্রাট এন্টারপ্রাইজের মোয়াজ্জেম হোসেন সহ দেশের নামকরা ঠিকাদারি কোম্পানির স্বত্বাধিকারী ও মনোনীত প্রতিনিধিরা।