বিয়ের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ

বিয়ের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ

বিয়ের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছিল সহজ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। বিয়ের ঘোষণা দেয়া ও বিয়ের খবর প্রচার করা। খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা। ওয়ালিমা বা বৌভাতের আয়োজন করা ও দাওয়াত দেয়া। দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি কেউ রোযা থাকলে তবুও তিনি হাযির হয়ে নিমন্ত্রণকারীর জন্য দোয়া করবেন; তবে খাবার গ্রহণ করা অপরিহার্য নয়।

এরপর স্বামী-স্ত্রী সৎভাবে সংসার করবে এবং সদভাবে সংসার করার যাবতীয় উপকরণ গ্রহণ করবে।

সংক্ষিপ্তভাবে এটাই নবীজির আদর্শ; এবার বিস্তারিত আলোচনায় আসুন:

এক: মোহরানা সাধ্যের মধ্যে হওয়া

বাইহাকী (১৪৭২১) বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “সর্বোত্তম মোহরানা হচ্ছে- সহজসাধ্য মোহরানা”। একই হাদিস আবু দাউদ (২১১৭) বর্ণনা করেছেন এ ভাষায়: “সর্বোত্তম বিবাহ হচ্ছে- সহজসাধ্য মোহরানা”[আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

আউনুল মাবুদ গ্রন্থে বলা হয়েছে-

أيسره শব্দের অর্থ হচ্ছে- মোহরানা ও অন্যান্য খরচ কমানো, যাতে করে পুরুষের জন্য সহজসাধ্য হয়। আল্লামা শাইখ আল-আযিযি বলেন: “মোহরানার পরিমাণ কম হওয়া কিংবা এমন হওয়া যাতে করে পাত্রের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করা সহজ হয়”[সমাপ্ত]

ইমাম আহমাদ (২৩৯৫৭) ও ইবনে হিব্বান (৪০৯৫) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “কনের বরকতের আলামত হচ্ছে- বিয়ের প্রস্তাবনা সহজ হওয়া, মোহরানা সহজসাধ্য হওয়া এবং গর্ভ ধারণ সহজ হওয়া।”[‘সহিহুল জামে’ (২২৩৫) গ্রন্থে আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

সুনানে তিরমিযি গ্রন্থে (১১১৪) ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “সাবধান, তোমরা নারীদের মোহরানা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। যদি মোহরানা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা দুনিয়াতে সম্মানের বিষয় হত কিংবা আল্লাহর কাছে তাকওয়া হত তাহলে তোমাদের নবী তা করতেন। আমার জানামতে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নারীদেরকে বিয়ে করেছেন কিংবা তাঁর মেয়েদেরকে বিয়ে দিয়েছেন তাদের কারো মোহরানা ১২ উকিয়ার বেশি ছিল না।[আলবানী হাদিসটিকে সহিহুত তিরমিযি গ্রন্থে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন]

এক উকিয়া হচ্ছে- ৪০ দিরহাম। গ্রামের হিসেবে দিরহামের ওজন হচ্ছে- ২.৯৭৫ গ্রাম।

দুই: বিয়ের ঘোষণা দেয়া

তিরমিযি (১০৮৯) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা এ বিয়ের ঘোষণা দাও”[আলবানী তাঁর ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে (৭/৫০) হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন]

নাসাঈ (৩৩৬৯) মুহাম্মদ বিন হাতেব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “হালাল ও হারামের মাঝে ব্যবধান হচ্ছে- বিয়েতে দফ বাজানো ও চেঁচামেচি করা”[আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন]

বিয়েতে দফ বাজানো নারীদের জন্য খাস।

ইবনে হাজার তার ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেন: “মজবুত হাদিসগুলোতে দফ বাজানোর যে অনুমতি এসেছে সেটা নারীদের জন্য খাস। এ অনুমোদনের মধ্যে পুরুষেরা অন্তর্ভুক্ত হবে না। যেহেতু সাধারণভাবে পুরষদেরকে নারীদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে”[সমাপ্ত]

তিন: ওয়ালিমা বা বৌভাত

বিয়ের ক্ষেত্রে ওয়ালিমার আয়োজন করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এটি বিয়ের প্রচারণার অন্তর্ভুক্ত এবং আনন্দ ও খুশি প্রকাশ করার শামিল।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) যখন বিয়ে করেছেন তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন: “একটি ছাগল দিয়ে হলেও তুমি ওয়ালিমার আয়োজন কর”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম]

মুসনাদে আহমাদের হাদিসের কারণে কোন কোন আলেম ওয়ালিমার আয়োজন করাকে ওয়াজিব বলেন। ইবনে বুরাইদা (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, আলী (রাঃ) যখন ফাতেমা (রাঃ) কে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “বিয়ের ক্ষেত্রে ওয়ালিমা বা ভোজানুষ্ঠান থাকতেই হবে।”[আলবানী তাঁর ‘আদাবুয যিফাফ’ নামক গ্রন্থে (৭২) বলেন: হাদিসটির সনদ যেমনটি বলেছেন ইবনে হাজার: কোন অসুবিধা নেই][সমাপ্ত]

ওয়ালিমার দাওয়াত পেলে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব। তোমাদের কাউকে যখন ওয়ালিমার দাওয়াত দেয়া হয় তখন সে যেন সে দাওয়াতে যায়”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম]

ইবনে উছাইমীন (রহঃ) বলেন:

আলেমগণ বলেন: বিয়ের প্রথম দাওয়াত কবুল করা ওয়াজিব। অর্থাৎ প্রথম ওয়ালিমার। যদি নিমন্ত্রণকারী কিংবা তার প্রতিনিধি কিংবা কার্ড পাঠানোর মাধ্যমে ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে দাওয়াত দেয়া হয়। তবে শর্ত হচ্ছে- এ অনুষ্ঠানে যেন শরিয়ত গর্হিত কোন কিছু না থাকে। আর যদি এ অনুষ্ঠানে শরিয়ত গর্হিত কোন কিছু থাকে তাহলে এর হুকুম ব্যাখ্যাসাপেক্ষ: যদি ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে এ গর্হিত কাজে নিষেধ করা সম্ভবপর হয় তাহলে এ ব্যক্তির জন্য উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব। আর যদি উপস্থিত হয়ে এ গর্হিত কাজে বাধা দেয়া সম্ভবপর না হয় তাহলে এ ব্যক্তির জন্য উপস্থিত হওয়া নাজায়েয।[সমাপ্ত]

[লিকাউল বাব আল-মাফতুহ (১৩/১৩৩]

গোশত ছাড়াও ওয়ালিমা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বৈধ। সহিহ বুখারীর বর্ণনায় (৪২১৩) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বার ও মদিনার মাঝে তিনদিন অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি সাফিয়্যাকে (রাঃ) বিয়ে করেন। আমি মুসলমানদের সকলকে তাঁর বিয়ের ওয়ালিমার দাওয়াত দিলাম। সে ওয়ালিমাতে রুটি বা গোশত কিছুই ছিল না। সে ওয়ালিমাতে কিছুই ছিল না; শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল (রাঃ) কে চামড়ার চাটাই বিছানোর নির্দেশ দিলেন; চাটাই বিছানো হল। এরপর সে চাটাই এর ওপর খেজুর, পনির ও ঘি ছিটিয়ে দেয়া হল।”

চার:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো অভিনন্দনের মাধ্যমে বরকে অভিনন্দন জানানো মুস্তাহাব। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, যখন কেউ বিয়ে করত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুভেচ্ছা জানাতেন ও তার জন্য দোয়া করতেন এই বলে: ‘বারাকাল্লাহু লাক, ওয়া বারাকা আলাইক, ওয়া জামাআ বাইনাকুমা ফি ফাইর’ (অর্থ- আল্লাহ তোমাকে বরকত দিন, তোমার ওপর বরকত ঢেলে দিন এবং তোমাদের দুইজনকে কল্যাণের ওপর একত্রিত করুন)।[সুনানে আবু দাউদ (২১৩০) আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

পাঁচ: স্বামী যখন স্ত্রীর সাথে বাসর করবেন তখন নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পালন করা মুস্তাহাব:

–      বাসর ঘরে স্ত্রীর সাথে কোমল আচরণ করা।

ইমাম আহমাদ (২৬৯২৫) আসমা বিনতে উমাইস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: আমি ছিলাম আয়েশা (রাঃ) এর বান্ধবী। আমি আরও কিছু মহিলাকে সাথে নিয়ে তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছি ও তাঁর ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি। আসমা বলেন: আল্লাহর শপথ, আমরা তাঁর ঘরে মেহমানদারি হিসেবে এক পেয়ালা দুধ ছাড়া আর কিছু পাইনি: তিনি সে পেয়ালা থেকে কিছুটা পান করলেন, এরপর আয়েশাকে দিলেন। অল্পবয়সী মেয়েটি লজ্জাবোধ করল। তখন আমরা বললাম: আল্লাহর রাসূলের হাত ফিরিয়ে দিও না; গ্রহণ কর। তখন সে ইতস্তত করে হাতে নিল এবং সেটা থেকে পান করল। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমার বান্ধবীদেরকে দাও। আমরা বললাম: আমাদের চাহিদা নেই। তিনি বললেন: তোমরা ক্ষুধা ও মিথ্যা দুটোকে একত্র করও না।[আলবানী ‘আদাবুয যিফাফ’ গ্রন্থে (১৯) হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন]

–      স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে তার জন্য দোয়া করা:

সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (২১৬০) আমর বিন শুয়াইব থেকে তিনি তাঁর পিতা থেকে তিনি তাঁর দাদা থেকে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “তোমাদের কেউ যখন কোন নারীকে বিয়ে করে তখন সে যেন স্ত্রীর মাথার অগ্রভাগ ধরে বলে: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা, খাইরা মা জাবালতাহা আলাইহি। ওয়া আউযু বিকা মিন শার্‌রিহা, ওয়া শার্‌রি মা জাবালতাহা আলাইহি (অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তাঁর কল্যাণটুকু এবং যে কল্যাণের ওপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, অভ্যস্ত করেছেন সেটা প্রার্থনা করি। আর তার অনিষ্ট থেকে ও যে অনিষ্টের ওপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, অভ্যস্ত করেছেন তা থেকে আশ্রয় চাই)।[আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন]

–      কোন কোন সলফে সালেহীন স্বামী-স্ত্রী একত্রে দুই রাকাত নামায আদায় করাকে মুস্তাহাব গণ্য করেছেন:

ইবনে আবি শাইবা (১৭১৫৬) শাকীক থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের (রাঃ) কাছে এক লোক এসে বলল, আমি এক যুবতী মেয়েকে বিয়ে করেছি। আমি আশংকা করছি- সে আমাকে অপছন্দ করবে। বর্ণনাকারী বলেন, আব্দুল্লাহ বললেন: মিল-মহব্বত আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। দূরত্ব ও ঘৃণা শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহ যা হালাল করেছেন শয়তান সেটাকে তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় করে তুলতে চায়। যখন সে তোমার কাছে আসবে তখন তাকে তোমার পিছনে দুই রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দিবে।”[আলবানী ‘আদাবুয যিফাফ’ গ্রন্থে (২৪) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

–      স্বামী যখন স্ত্রী সহবাস করতে চাইবে তখন বলবে:

‘বিসমিল্লাহ। আল্লাহুম্মা জান্নিবনাস শায়তান ওয়া জান্নিবিস শায়তানা মা রাযাকতানা’। যেহেতু সহিহ বুখারীতে (৩২৭১) ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: “যখন তোমাদের কেউ স্ত্রী সহবাস করতে চায় তখন যদি বলে, “বিসমিল্লাহ্‌। আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শায়তান ও জান্নিবিশ শায়তানা মা রাযাকতানা” (অর্থ- আল্লাহর নামে শুরু করছি। হে আল্লাহ, আমাদেরকে শয়তান হতে বাঁচান এবং আমাদেরকে যদি কোন সন্তান দেন তাকেও শয়তান হতে বাঁচান) এরপর যদি তাদের কোন সন্তান হয় তাহলে শয়তান সে সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”

সর্বশেষ উপদেশ হচ্ছে সদভাবে সংসার করা। স্ত্রীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা এবং স্ত্রীও স্বামীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে। তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ্‌ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।”[সূরা নিসা, আয়াত: ১৯]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, রমযান মাসে রোযা রাখে, নিজের যৌনাঙ্গ হেফাযতে রাখে, স্বামীর আনুগত্য করে; তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা ইচ্ছা হয় সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ কর।”[আলবানী ‘তাখরিজুল মিশকাত’ গ্রন্থে (৩২৫৪) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

আল্লাহই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব