কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজাকারের বাচ্চাদের অংশগ্রহণ ছিল

সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বহাল রাখার পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্তরসূরিদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মাঠে নেমেছে একটি সংগঠন। সংগঠনের বক্তারা বলেন, ‘কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের আন্দোলন। এই আন্দোলনে নিজেকে রাজাকারও ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঔদ্ধত্য মেনে নেয়ার মতো না। এতেই স্পষ্ট হয়, এই আন্দোলনে রাজাকারের বাচ্চাদের অংশগ্রহণ ছিল। আমরা তাদেরকে সরকারি চাকরিতে দেখতে চাই না।’

শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’নামে একটি সংগঠনের এক সমাবেশে এই দাবি জানানো হয়।সমাবেশটি হওয়ার কথা ছিল রাজধানীর শাহবাগ এলাকায়। তবে সেখানে পুলিশ অনুমতি না দেয়ায় কর্মসূচিটি পালন করা হয় জাতীয় প্রেসক্লাবে।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের মতো তাদের উত্তরসূচিরাও মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। বারবার এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা প্রশাসনে গিয়ে নানা সময় অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করেছে। তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। এ কারণে এদের নিয়োগ বন্ধ করতে হবে।

কর্মসূচিতে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করারও দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে সরকারি চাকরিতে আগের মতোই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে সেই কোটা বিসিএসের প্রিলিমিনারি থেকেই কার্যকর করার দাবি জানানো হয়।

আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীসহ যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরেছিল, সেই দলগুলোকে নিষিদ্ধের আহ্বান জানানো হয়।স্বাধীনতার পর থেকেই সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং ২০০৯ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের এই কোটার আওতায় আনা হয়।

১৯৯৭ সালে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের অনুসারীরা মুক্তিযুদ্ধ কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে। তখন ব্যর্থ হলেও এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের আমল পর্যন্ত নানা সময় এই দাবি জানিয়ে এসেছে তারা।এই কৌশলে ব্যর্থতার পর এবার কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। আর ভাষা পাল্টানোর পর সারাদেশেই ছাত্রদের মধ্যে এই আন্দোলন জনপ্রিয় হয়। আন্দোলনকারীরা কোনো বিশেষ কোটা নিয়ে কথা না বলে সব মিলিয়ে কোটা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানাতে থাকে। কিন্তু নানা কর্মসূচি এবং সামাজিক মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়েই আক্রমণ চলতে থাকে।

তুমুল আন্দোলনের মধ্যে ১২ এপ্রিল সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো কোটা থাকার দরকার নেই।’ এরপর আন্দোলনকারীরা ক্লাসে ফিরে যায়।এখনও এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি না হলেও সম্প্রতি আবার কোটা বাতিল না করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সংগঠন।

আন্দোলনকারীরা বলছে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং তার পরিবারকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়নি। বর্তমান প্রজন্ম সেটি বিবেচনায় না নিয়ে আন্দোলন করেছে এবং সেই আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে। এটা কখনও মেনে নেয়া যাবে না।

সমাবেশে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ এর সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রেখে তা বাস্তবায়নে কমিশন গঠন করতে হবে। প্রিলিমিনারি থেকে কোটা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সাথে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে যারা হামলায় জড়িত তাদের বিচার করতে হবে।’

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান শাহীন বলেন, ‘কোটা নিয়ে আন্দোলনে চক্রান্তের মূলে ছিল জামায়াত-শিবির। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়। তাদের অনেকে নিজেদের প্রকাশ্যে রাজাকার হিসাবে ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছিল। এই রাজাকারের বাচ্চাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’,‘এরপর থেকে এই রাজাকারের বাচ্চারা যেখানে দাঁড়াবে, তাদেরকে সেখানে প্রতিহত করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা আর সহ্য করবে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আ ক ম জামাল উদ্দিন বলেন, ‘কোটা সিস্টেমে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নারীদের অবদানে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে পেরেছে। নারীদের এগিয়ে নেওয়া এবং পিছিয়ে পড়াদের অগ্রসর করার জন্য জেলা কোটার ব্যবস্থা করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখন কোটা প্রথা বাতিল করার মতো সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি না।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখানে করুণা নিতে আসিনি। আমাদের পরিবারের রক্তের অধিকার নিতে এসেছি। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়যন্ত্র আমরা বানচাল করে দেব।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সভাপতি মেহেদি হাসান বলেন, ‘প্রিলিমিনারি থেকে কোটার বাস্তবায়ন আমরা চাই। কোটার বিপরীতে যেসব শূন্য পদ আছে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে।’

সমাবেশে আট দাবি

গণসমাবেশে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা আট দফা দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো:

১. জাতির পিতা, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তিকারীদের শাস্তি দিতে হবে।

২. মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ মুক্তিযোদ্ধা সুরক্ষা আইন করতে হবে।

৩. ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রেখে তা বাস্তবায়নে কমিশন গঠন তরে প্রিলিমিনারি থেকে কোটা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হবে।

৪. মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চলমান সকল নিয়োগ কার্যক্রম অব্যাহত রাখাসহ সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কোটার শূন্য পদ সংরক্ষণ করে বিশেষ নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে।

৫. ১৯৭২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটায় শূন্য পদগুলোতে চলতি বছরেই নিয়োগ দিতে হবে।

৬. মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে পেনশন, বোনাস, রেশনসহ ওই মন্ত্রণালয়ের সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

৭. রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করাসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্তরসূরীদের সকল চাকরিতে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে।

৮. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলাসহ দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী স্বঘোষিত রাজাকারদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে এবং সবার জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দিতে হবে।