মুশতাকের কুমির খামারের মালিক এখন পলাতক পিকে হালদার

ক্যাডেট কলেজ পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মুশতাক আহমেদ, পরে উচ্চশিক্ষার জন্য যান ইংল্যান্ড। প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন তিনি। ২০০২ সালেই স্বপ্ন দেখেছিলেন বন্যপ্রাণী নিয়ে কিছু করার। কুমিরের প্রতি আলাদা আগ্রহ ছিল তার। শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিক খামার ও কুমির রফতানি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন মুশতাক। পরে সেই খামারের মালিকানা হারান আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের কাছে! কুমির চাষের সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে বইও লিখেছেন তিনি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দি মুশতাক আহমেদ বৃহস্পতিবার বন্দিদশাতেই মারা যান। ময়মনসিংহের ভালুকায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার করেন তিনিই। তখনো বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষের ধারণাটি বাংলাদেশে একেবারে নতুন। দেশের ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর যাত্রা করে মুশতাক আহমেদের রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। ভালুকা উপজেলা সদর থকে ১৭ কিলোমিটার দূরে হাতিবেড় গ্রামে ১৩ একর জমিতে খামারটি গড়ে তোলেন তিনি।

জানা যায়, শুরুতে মালয়েশিয়া থেকে ৭৪টি কুমির আমদানি করে মুশতাকের খামারের যাত্রা হয়। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো দুটি কুমির ৬৯টি ডিম দেয়। তবে মাত্র তিনটি ছানার জন্ম হয়। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের ব্যবধানে মারা যায় সবক’টি। কিন্তু মুশতাক তাতে হতাশ হননি। পরের বছরই তার খামারে ৬০০টি ডিম থেকে জন্ম নেয় ১৪১টি কুমিরছানা। বর্তমানে খামারটিতে ৩ হাজারের বেশি বিভিন্ন বয়সী কুমির রয়েছে।

যে স্বপ্ন থেকে মুশতাক আহমেদ কুমিরের খামার শুরু করেছিলেন, ২০১০ সালে প্রথম রফতানির দিন থেকেই সেই স্বপ্ন ফিকে হতে থাকে। প্রথমে মালিকানা নিয়ে অংশীদারের সঙ্গে বিভেদ, পরে প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের কাছে খামারের মালিকানা হারান মুশতাক আহমেদ।

জানা গেছে, খামারটি যখন গঠন করা হয়, তখন ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল মেজবাহুল হকের, যিনি সম্পর্কে মুশতাক আহমেদের আত্মীয়। ১৫ শতাংশ শেয়ার ছিল মুশতাক আহমেদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ প্রকল্পের ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। সে হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেয়ার ছিল ৪৯ শতাংশ। মেজবাহুল হক ও মুশতাক আহমেদ ছিলেন উদ্যোক্তা পরিচালক আর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি ব্যাংক কর্মকর্তা প্রিতিশ কুমার সরকার ছিলেন পরিচালক। মেজবাহুল হক ছিলেন খামারের চেয়ারম্যান আর মুশতাক আহমেদ ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২০১০ সালে কুমিরের প্রথম রফতানির দিন থেকেই মালিকানা নিয়ে মেজবাহুল হকের সঙ্গে মুশতাক আহমেদের বিরোধ দেখা দেয়। পরে বিষয়টি আদালত অবধি গড়ায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে প্রথম কুমির রফতানির দিন মেজবাহুল হক ঘোষণা দেন তিনিই এখন থেকে ইনচার্জ, সবকিছু দেখাশোনা করবেন। তখনো কোম্পানির নিবন্ধিত কার্যালয় ছিল মুশতাক আহমেদের বাসার ঠিকানায়। পরে সেই বছরেরই সেপ্টেম্বরে বোর্ড মিটিংয়ে মেজবাহুল হক নিজেকে কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দাবি করেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্তে এমডি বা কোম্পানির ঠিকানা পরিবর্তন সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল।

মেজবাহুল হক বাংলাদেশ ব্যাংককে না জানিয়েই নিজের অ্যাপার্টমেন্টে কোম্পানির ঠিকানা স্থানান্তর করেন। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের কোনো লেনদেন আর ব্যাংকের মাধ্যমে হয়নি। ২০১১ সালে মেজবাহুল ফার্ম দখল করে মুশতাক আহমেদকে ঢুকতে বাধা দেন। তখনো কোম্পানির ৪৯ শতাংশ মালিকানা বাংলাদেশ ব্যাংকের এবং এর প্রতিনিধি পরিচালক ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা প্রিতিশ কুমার সরকার।

২০১০ সালে মেজবাহুল হক নিজ উদ্যোগে এসআর বোস অ্যান্ড কোম্পানিকে দিয়ে অডিট রিপোর্ট তৈরি করে নেন। মেজবাহুল হক এবং এ কোম্পানির স্বত্বাধিকারী শিশির বোস একই ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। আট-নয় মাস ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন না হলেও ২০১১ সালে মেজবাহুল হক ২ কোটি টাকা জমা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ার নিজ নামে করে নিতে আবেদন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী সব টাকা জমা হওয়ার পরই কেবল শেয়ার হস্তান্তর সম্ভব। মুশতাক আহমেদ সে সময় সব অনিয়ম লিখিত আকারে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানান।

২০১১ সালের জুন-জুলাইয়ের দিকে মুশতাক আহমেদকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, তাকে ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ার কিনে নেয়ার জন্য টাকা জমা দিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ শেয়ারের পুরোটাই মেজবাহুল হকের নামে হস্তান্তর করা হবে। সেক্ষেত্রে কোম্পানিতে মেজবাহুল হকের মালিকানা দাঁড়াবে ৮৫ শতাংশে। মুশতাক আহমেদ এ নিয়ে মামলা করলে আদালত শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। মুশতাক আহমেদকে নয় মাস সময় দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ার কিনে নেয়ার জন্য।

কোম্পানিতে যখন এ বিভেদ তুঙ্গে, তখনই দৃশ্যপটে আসেন প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। ২০১২ সালে মুশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। সে সময় পিকে হালদার ছিলেন রিলায়েন্স সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের এমডি। ওই সময় পিকে হালদার খামারের শেয়ার কিনে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অর্থ সংকটে থাকলেও মুশতাক আহমেদ শুরুতে খামারের মালিকানা ছাড়তে আগ্রহী ছিলেন না। যদিও মেজবাহুল হকসহ কোম্পানির কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় পিকে হালদার কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হন।

ওই সময় পিকে হালদার মুশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে জানিয়েছিলেন, কোম্পানির সব শেয়ার কিনে নেয়ার জন্য মেজবাহুল হকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি। কোম্পানিটি কিনে এটিকে পিকে হালদার স্টক মার্কেটে নিয়ে যাবেন।

প্রথমে এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মুশতাক আহমেদ। কিন্তু পরে মেজবাহুল হক ও পিকে হালদারের ক্রমাগত চাপ ও অর্থসংকটের কারণে এক পর্যায়ে এ শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

২০১৩ সালে পিকে হালদারের ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডের ফ্ল্যাটে মুশতাক আহমেদ চেক নিয়ে শেয়ার হস্তান্তরের দলিলে সই করে দেন। এ সময় তার নামে থাকা শেয়ার লিখে দেয়া হয় ওরিয়েল লিমিটেডের অঙ্গ মোহন রয়ের নামে। মেজবাহুল হকের কাছ থেকে অঙ্গ মোহন রায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেন। এর কয়েক বছর পর খামারটির ওয়েবসাইটের তথ্য হালনাগাদ করা হয় ২০১৯ সালের আগস্টে। এতে দেখা যায়, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন রাজীব সোম নামে এক ব্যক্তি। চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন রাজীব সোমের স্ত্রী শিমু রয়।

এদিকে গত বছরের ৮ জানুয়ারি পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার এজাহারে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ আনা হয়। দুদকের তদন্তে উঠে আসে, আটটি কোম্পানিতে নিজের নাম এবং নিকটাত্মীয় ও কর্মচারীদের নাম ব্যবহার করে ৬৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৪ হাজার ১৯৯ টাকা বিনিয়োগ করেছেন পিকে হালদার। এসব বিনিয়োগের সপক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো বৈধ আয়ের উৎস দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা খুঁজে পাননি। এর মধ্যে রেপটাইলস ফার্মে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, রাজিব সৌম্য ও তার স্ত্রী শিমু রায়ের নাম ব্যবহার করে ৫ কোটি ৬৯ লাখ ৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন পিকে হালদার। ওই খামারের জমি জব্দ করতে এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশনা পেয়েছে দুদক।

পিকে হালদারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ময়মনসিংহের ভালুকায় রেপটাইল ফার্ম ও আশপাশের বেশকিছু জমির দলিল উদ্ধার করা হয়েছে। সেসব জমি জব্দ করার নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।

এদিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী রফতানি না হওয়ায় এরই মধ্যে খামারটিতে কুমিরের সংখ্যা বেড়ে আবাসস্থল ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, ব্যবস্থাপনায় সামান্য ঘাটতি থাকলেও ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা। ফলে খামারটি এখন জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চেয়ে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবু সায়েম মোহাম্মদ আরিফের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। -বণিক বার্তা