কেমন আছে নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ?

দক্ষিণ আফ্রিকার কোলে ঘুমিয়ে আছেন মাদিবা।

শান্তিতে আছেন তিনি। কিন্তু, মাদিবার, নেলসন ম্যান্ডেলার, দক্ষিণ আফ্রিকা যে বিশেষ ভাল নেই। মাদিবার হাত ধরে বর্ণের বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও বৈষম্যের অন্য মাপকাঠিতে ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। বড় অংশের কৃষ্ণাঙ্গের সামনে থমকে গিয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তির রথ। দু’দশক ধরে ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর (এএনসি) শাসনের পরেও এই পরিস্থিতি পীড়াদায়ক। বিরোধীদের অভিযোগ, সর্বজনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের থেকে অবাধ পুঁজিবাদের দিকেই ঝুঁকেছেন এএনসি নেতৃত্ব। বৈষম্যের মাপকাঠিতে আজ প্রথম সারিতে দক্ষিণ আফ্রিকা। কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে যার ফল ভুগছেন কৃষ্ণাঙ্গরাই।
দক্ষিণ আফ্রিকার আনাচে-কানাচে বৈষম্যের ছাপ বড় প্রকট। বেশি নয়, রাজধানী কেপটাউনই দেখুন। এক দিকে পাহাড়ের ছায়ায়, সমুদ্রের কোলে বহুমূল্য সম্পত্তির সারি। সেখানে বাস দেশের অত্যন্ত ধনী নাগরিকদের। অনতিদূরেই কেপ ফ্ল্যাট। কোনও মতে তৈরি অস্থায়ী আবাস। ঠাণ্ডায় হাড় কাঁপে। বৃষ্টিতে বানভাসি। তার মধ্যে গিজ গিজ করছে মানুষ। টিকে থাকার নিত্য সংগ্রামে রত এঁরা সবাই কৃষ্ণাঙ্গ। শুধু কেপ ফ্ল্যাট-ই নয়, বিশ বছর ধরে এএনসি-র শাসনের পরেও এমনই অবস্থা রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার বড় অংশে। বৈষম্যের সমুদ্রের মাঝে ছোট ছোট প্রাচুর্যের দ্বীপ।
এএনসি কিন্তু অন্য এক ছবি তুলে ধরছে। ‘রাইজিং ইন্ডিয়া’র মতো ‘আফ্রিকা রাইজিং’-এর স্লোগানে মশগুল এএনসি নেতৃত্ব। প্রচারে উঠে আসে বিশ বছরে দারিদ্রের হার কমিয়ে আনা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা, এডস-এর প্রকোপ কমিয়ে আনা, দরিদ্রদের জন্য প্রায় ৩৭ লক্ষ নতুন বাড়ি তৈরি, প্রায় ১.৬ কোটি মানুষের কাছে জনকল্যাণমূলক ভর্তুকি পৌঁছে দেওয়ার কথা। এক কৃষ্ণাঙ্গ মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে তোলার কথা। কিন্তু ২০ বছরের হিসেবে ধরলে মাদিবার চোখেই তা ‘টু লিটল, টু লেট’ মনে হতে পারে।
শাসকের চিরাচরিত পথে প্রচারে এএনসি-ও গ্লাসের পূর্ণ দিকটিই তুলে ধরছে। এই যেমন, ‘আফ্রিকা রাইজিং’-এর প্রচারে বলা হয় না, আফ্রিকা মহাদেশে বেশ কিছু দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার দুই অঙ্কে পৌঁছে গেলেও ২০১৪-এ দক্ষিণ আফ্রিকায় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার রয়ে গিয়েছে ১.৪ শতাংশেই। তার উপরে আগের বছরের শেষ চার মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমে গিয়েছে। ২০১৫-য় হার বেড়ে বড়জোর ২.২ শতাংশে পৌঁছতে পারে। ২০১৪-য় দক্ষিণ আফ্রিকাকে ছাপিয়ে জিডিপি-তে সব চেয়ে উপরে উঠে এসেছে নাইজেরিয়া। এই হতাশার ছাপই রয়ে গিয়েছে গত বছরের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে। না, ক্ষমতা হারায়নি এএনসি। তবে আধিপত্য ক্রমেই কমছে। ২০০৯-এ ৬৫.৯ শতাংশ মানুষের সমর্থন পেলেও ২০১৪-য় তা নেমে এসেছে ৬২.১ শতাংশে।


পরিবারের মাঝে

৩৩ বছরের যুবক জুলিয়াস মালেমা। এক সময়ে এএনসি-র সক্রিয় কর্মী, যুব সংগঠনের প্রধান। হতাশায় পার্টি ছাড়েন। তৈরি করেন নতুন দল, ইকনমিক ফ্রিডম ফাইটার্স (ইএফএফ)। কড়া বামপন্থী মেজাজের এই দলই ২০১৪-র নির্বাচনে ৬.৪ শতাংশ ভোট তুলে নিয়েছে। ইএফএফ-এর ধীরে ধীরে পায়ে মাটি পাওয়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে বৈষম্যের, হতাশার গল্প। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘জিনি’ সূচক, যা আয়ের বৈষম্য মাপে, ০.৬৯ (এই মান যত একের দিকে এগোবে ততই বাড়বে বৈষম্য)। জিনির এই মান নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা একে বারে প্রথম সারিতেই (ভারতের জিনি ০.৩৩)। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার ১৯৯৪-য়, বর্ণবৈষম্যের অবসানের সময়ে, এই জিনি-ই ছিল ০.৬৪। ভোগের বৈষম্যের জিনি-ও বেশি, ২০০৯-এ তা ছিল ০.৬৩ শতাংশ। সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ নাগরিক দেশের মোট আয়ের ৫৮ শতাংশের অধিকারী। আর সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ থাকে মোট আয়ের ০.৫ শতাংশ নিয়েই। স্বভাবতই এই দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া অংশের নাগরিকেরা সবাই কৃষ্ণাঙ্গ।
কৃষ্ণাঙ্গরাও ধনী হয়েছেন। তবে তা সংখ্যায় বড় কম। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছেন যাঁরা সফলের তালিকায় তাঁদের নামই বেশি। সেই তালিকায় এনএনসি-র বেশ কয়েক জন কর্মকর্তার নামও রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগও বড় কম নয়। অভিযোগ, এঁরা অনেকেই পিছিয়ে পড়া কৃষ্ণাঙ্গদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। তাঁদের সামনে রেখেই চলছে বৈষম্যের শাসন, চলছে পুঁজির রমরমা। প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা ১৪১ কোটি ডলার ব্যয়ে নিজের দেশের বাড়ির সংস্কার করেছেন। তা নিয়ে হইচই কম হয়নি। কিন্তু ৫ কোটি জনসংখ্যার এ দেশেই প্রায় ২ কোটি নাগরিক বেঁচে থাকার জন্য সরকারি ভর্তুকির উপরে নির্ভর করেন।
মালেমাদের দাবি, এই অবস্থার বড় কারণ এএনসি-র অপশাসন। সামগ্রিক উন্নয়নের থেকে পুঁজিকে বেশি জায়গা ছেড়ে দেওয়া। যেমন, ১৯৯৪-য় ক্ষমতায় বসে এএনসি বলেছিল ভূমি-সংস্কার করবে। মোট কৃষিজমির ৩০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে ফিরিয়ে দেবে। ২০১৪-র পরিসংখ্যান বলছে মাত্র আট শতাংশ কৃষিজমি বিতরণ করা হয়েছে। বড় জমির মালিক এখনও শ্বেতাঙ্গদের হাতে। খনিজে সমৃদ্ধ দেশের বেশি খনির মালিকানাও বহুজাতিকের হাতে। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের থেকে মুনাফা লুটছেন মুষ্টিমেয়ই। মালেমাদের অভিযোগ, কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বদলে এএনসি এখন পুঁজিবাদের দাসত্ব করছে। তাতে বৈষম্যের পাশাপাশি দারিদ্র আর বেকারত্বের ফাঁসেও আটকে যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের ঠিক করা নিয়ম অনুযায়ী মাসে ৪৩ ডলার রোজগার করলে তাঁকে দরিদ্র বলা যাবে না। কিন্তু সে দেশে ৪৭ শতাংশ মানুষ এখনও সেটুকুও আয় করতে পারেন না। ২০১১-র হিসেব বলছে, জনসংখ্যার অনুপাতে ৫৩.৮ শতাংশ নাগরিক ( হেড কাউন্ট রেশিও) দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। এ দলেই আছেন বছর আঠারোর লিজানা এন্টেলবেয়ার বা বছর বাইশের ফেলিসিটি জ্যাকব। দু’জনেই স্কুলে যেতেন। কিন্তু স্কুল শেষ করতে পারেননি। পরিস্থিতির চাপে দু’জনেই আজ যৌনকর্মী। পরিস্থিতি পাল্টানোর আশাও করেন না তাঁরা। কারণ, হতাশার এই জাল কেটে মাদিবার মতো মশাল হাতে আসারও কেউ নেই।
সঙ্কটের ছবিটি আরও পরিষ্কার হয়, কর্মহীনদের দিকে চোখ ফেরালে। ২০১৪-এ বেকারত্বের হার পৌঁছছে ২৫.৫ শতাংশ। যা গত ১১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে যাঁদের বয়েস ২৫ বছরের কম তাঁদের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ৫০ শতাংশ। প্রায় সাত লক্ষ ৬০ হাজার নাগরিক কর্মহীন। কৃষ্ণাঙ্গ, দরিদ্র এবং মহিলাদের মধ্যে এই হার আরও বেশি। উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সুযোগের অভাবে কাজের বাজারে কল্কে পাচ্ছেন না অনেকেই। এর সঙ্গেই বাড়ছে অপরাধের সংখ্যাও। ২০১১-য় হত্যার পরিসংখ্যানে ৯৮টি দেশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার স্থান ছিল অষ্টমে।
বাড়ছে ধর্মঘটের মতো শ্রমিক অসন্তোষের নানা ঘটনাও। ২০১২-র অগস্টে মারিকানায় প্ল্যাটিনামের খনিতে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটে সামিল শ্রমিকদের উপরে গুলি চালায় পুলিশ। নিহত হন ৩৪ জন শ্রমিক। বর্ণবৈষম্যের অবসানের পরে শ্রমিকদের উপরে এত বড় আঘাত আসেনি। এই খনিটি একটি ব্রিটিশ সংস্থার অধীন। মালেমা তাই খনিগুলি জাতীয়করণের দাবি তুলেছেন। দাবি তুলেছেন পূর্ণাঙ্গ ভূমি সংস্কারেরও। হইহই করে উঠেছে সরকার এবং পুঁজিপতিরা। তাঁদের মতে, ব্যাহত হবে উন্নয়নের পথ। কিন্তু এই পথে থাকলে বেড়ে চলা অসন্তোষের আঁচ কি নিয়ন্ত্রণে থাকবে? কারণ, মাদিবাই তো বলেছেন, বিপ্লবের শেষ হয় না!