হজ্জ ও হজ্জের আমলগুলো
বিমানে ওঠার আগে:
হজ পালনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ার আগে জেনে নিন আপনার গন্তব্য ঢাকা থেকে মক্কায়, নাকি মদিনায়। যদি মদিনায় হয়, তাহলে এখন ইহরাম বাঁধা নয়; যখন মদিনা থেকে মক্কায় যাবেন, তখন ইহরাম পরতে হবে। বেশির ভাগ হজযাত্রী আগে মক্কা যান। যদি মক্কা যেতে হয়, তাহলে ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগে ইহরাম বাঁধা ভালো। কারণ, জেদ্দা পৌঁছানোর আগেই ইয়ালামলাম মিকাত বা ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান। বিমানে যদিও ইহরাম বাঁধার কথা বলা হয়, কিন্তু ওই সময় অনেকে ঘুমিয়ে থাকেন; আর বিমানে পোশাক পরিবর্তন করাটাও দৃষ্টিকটু। বিনা ইহরামে মিকাত পার হলে এ জন্য দম বা কাফফারা দিতে হবে। তদুপরি গুনাহ হবে। ইহরাম ছাড়া মিকাত অতিক্রম নিষিদ্ধ। হজ বা উমরাহ পালনকারী ব্যক্তির জন্য বিনা ইহরামে যে স্থান অতিক্রম করা জায়েজ নয়, তা-ই হলো মিকাত। বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘরের সম্মানার্থে প্রত্যেককে নিজ নিজ মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয় (মিকাত পাঁচটি-১· যুল হুলায়ফা বা বীরে আলীঃ মদিনাবাসী মক্কায় প্রবেশের মিকাত, ২· ইয়ালামলামঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকে জেদ্দা হয়ে মক্কা প্রবেশের মিকাত। ৩· আল-জুহফাঃ সিরিয়া, মিসর এবং সেদিক থেকে আগতদের জন্য মিকাত। ৪· কারনুল মানাজিল বা আসসায়েল আল-কাবিরঃ নাজদ থেকে আগতদের জন্য মিকাত এবং ৫· যাতু ইর্কঃ ইরাক থেকে আগতদের জন্য মিকাত)।
জেদ্দা বিমানবন্দর:
মোয়াল্লেমের গাড়ি আপনাকে জেদ্দা থেকে মক্কায় যে বাড়িতে থাকবেন, সেখানে নামিয়ে দেবে। মোয়াল্লেমের নম্বর (আরবিতে লেখা) কব্জি বেল্ট দেওয়া হবে, তা হাতে পরে নিবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র (যাতে প্রিলগ্রিম পাস নম্বর, নাম ট্রাভেল এজেন্টের নাম ইত্যাদি থাকবে) গলায় ঝোলাবেন। জেদ্দা থেকে মক্কায় পৌঁছাতে দুই ঘন্টা সময় লাগবে। চলার পথে তালবিয়া পড়ুন (লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক …..)।
আরও কিছু পরামর্শ:
মসজিদুল হারামে (কাবা শরিফ) অনেকগুলো প্রবেশপথ রয়েছে; সবকটি দেখতে একই রকম। কিন্তু প্রতিটি প্রবেশপথে আরবি ও ইংরেজিতে ১, ২, ৩ নম্বর ও প্রবেশপথের নাম আছে, যেমন – বাদশা আবদুল আজিজ প্রবেশপথ। আপনি আগে থেকে ঠিক করবেন, কোন প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকবেন বা বের হবেন। আপনার সফরসঙ্গীকেও স্থান চিনিয়ে দিন। তিনি যদি হারিয়ে যান, তাহলে নির্দিষ্ট নম্বর গেটের সামনে থাকবেন। এতে ভিড়ে হারিয়ে গেলেও নির্দিষ্ট স্থানে এসে সঙ্গীকে খুঁজে পাবেন। আর কাবা শরিফে জুতা রাখার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতে হবে। নির্দিষ্ট স্থানে জুতা রাখার জায়গায় জুতা রাখুন। এখানে-সেখানে জুতা রাখলে পরে আর খুঁজে পাবেন না। প্রতিটি জুতা রাখার র্যাকেও নম্বর দেওয়া আছে। এই নম্বর মনে রাখুন।
সৌদি আরবে অবস্থানকালে কোনো চাঁদা ওঠানো, সাহায্য চাওয়া, ভিক্ষা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। সুতরাং এগুলো থেকে বিরত থাকুন। ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, সিগন্যাল পড়লে রাস্তা পার হোন। রাস্তা পার হওয়ার সময় অবশ্যই ডানে-বাঁয়ে দেখেশুনে সাবধানে পার হবেন। কখনো দৌড় দেবেন না।কাবা শরিফ ও মসজিদে নববীর ভেতরে কিছুদূর পর পর পবিত্র কোরআন মজিদ রাখা আছে আর পাশে জমজম পানি (স্বাভাবিক ও ঠান্ডা) খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।মনে রাখবেন, মসজিদে নববী ও কাবা শরিফের সীমানার মধ্যে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।শরীরের কোনো স্থান কেটে গেলে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম ব্যবহার করুন এবং ক্ষতস্থানটি প্লাস্টার কিংবা ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে দিন।হাঁচি কিংবা কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই আপনার মুখ ঢেকে নিন। কোনো ধরনের অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনায় পড়লে বাংলাদেশ হজ মিশনের মেডিকেল সদস্যদের (চিকিৎসক) সঙ্গে যোগাযোগ করুন। হারানো হজযাত্রীদের খুঁজে পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ হজ মিশনে অবস্থিত আইটি ডেস্ক সাহায্য করে। হজযাত্রীদের যাবতীয় তথ্য, দেশের পরিবার-পরিজনের কাছে ই-মেইলের মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছানো যায়।
আপনার ট্রাভেল এজেন্সি আপনাকে যথাযথ সুবিধাদি (দেশ থেকে আপনাকে থাকা, খাওয়াসহ অন্য যেসব সুবিধার কথা বলেছিল) না দিলে আপনি মক্কা ও মদিনার বাংলাদেশ হজ মিশনকে জানাতে পারেন। এতেও আপনি সন্তুষ্ট না থাকলে সৌদির ওজারাতুল হজকে (হজ মন্ত্রণালয়) লিখিত অভিযোগ করতে পারেন। আরাফাতের ময়দানে অনেক প্রতিষ্ঠান বিনা মূল্যে খাবার, জুস, ফল ইত্যাদি দিয়ে থাকে। ওই সব খাবার আনতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি হয়, তাই সাবধান থাকবেন। মুজদালিফায় রাতে থাকার জন্য প্লাস্টিকের পাটি পাওয়া যায়। এটি মক্কায়ও কিনতে পারবেন। আরাফাতের ময়দান থেকে যদি হেঁটে মুজদালিফায় আসেন, পথে টয়লেট সেরে নেবেন। কেননা, মুজদালিফায় টয়লেটে অনেক ভিড় লেগে যায়।মিনায় যে তাঁবুতে অবস্থান করবেন, সেসব তাঁবু চিহ্নিত করে নিন। মোয়াল্লেম অফিস থেকে তাঁবুর নম্বরসহ কার্ড দেওয়া হয়; তা যত্নে রাখুন। বাইরে বের হওয়ার সময় তা সঙ্গে রাখুন। হজযাত্রী সচেতন থাকলে হারিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই।
আপনি যখন মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান করবেন, তখন চেষ্টা করবেন আপনার ব্যাগের ওজন যেন কম হয়। কারণ অনেক হাঁটতে হবে এবং সেখানে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হবে।
মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা শরীফে মেয়েদের সব সময় ঢুকতে দেওয়া হয় না। ফযর, যোহর ও এশার নামাজের পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঢুকতে দেয়। মেয়েদের জন্য ২৫ নং গেট দিয়ে ঢুকলে সব চেয়ে ভালো। বাংলাদেশসহ সব দেশের মেয়েদের আলাদা আলাদা করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দৌঁড়া-দৌঁড়ি এবং ধাক্কা-ধাক্কি করবেন না। তবে ছেলেদের এমন নিয়ম নেই। সেখানে রিয়াজুল জান্নাহ দোয়া কবুলের জায়গা। শুধু মাত্র সবুজ কার্পেট বিছানো অংশটুকু রিয়াজুল জান্নাহ।
হজের দিনগুলোতে আপনার করণীয়
হজের মূল দিবসগুলো হচ্ছে ৮ জিলহজ থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত।
হজ্জের ১ম দিন
পবিত্র হজ্জের এহরাম অবস্থায় (ফরজ) মক্কা থেকে মিনায় রওয়ানা হতে হয়।
হজ্জের ১ম দিন মিনায় যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজর নামাজ পড়তে (সুন্নত) হয়।
মিনায় রাত্রি যাপন করতে হয়।
হজ্জের ২য় দিন
ফজরের নামাজ মিনায় পড়ে আরাফাতের ময়দানে রওয়ানা হতে হয়।
আরাফাতের সূর্য হেলার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ফরয।
ওয়াক্তমত যোহর ও আছরের নামায আরাফাতে পড়তে হয় জামাতের সাথে পড়া উত্তম।
সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামায না পড়ে মুযদালিফায় রওয়ানা হতে হয়।
মুযদালিফায় পৌঁছে এশার ওয়াক্তে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করতে হয়।
এ নামাজ এক আযান ও এক ইকামতে আদায় করতে হয় (ওয়াজিব) এবং জামাতে পড়া উত্তম।
মুযদালিফায় অবস্থান (ওয়াজিব) রাত্রি যাপন করা সুন্নত।
হজ্জের ৩য় দিন
মুযদালিফায় ফজরের নামাযের পর কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয় এবং তা ওয়াজিব।
এরপর মিনায় পৌঁছে প্রথম একমাত্র বড় শয়তানকে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করতে হয় এবং তা ওয়াজিব।
বড় শয়তানকে পাথর মারার সময় ১০ই যিলহজ্ব সুবহে সাদেক থেকে ১১ই যিলহজ্জ সুবহে সাদেক পর্যন্ত ২৪ ঘন্টা।
তারপর কোরবানী করতে হয় (ওয়াজিব) ইফরাদ হজ্জকারীর জন্য এটা মুস্তাহাব।
তারপর মাথার চুল মুন্ডানো বা ছোট করা ওয়াজিব
তাওয়াফে জিয়ারতের জন্য মক্কায় যেতে হয় এবং তা ওয়াজিব।
তাওয়াফে শেষে মিনায় রাত্রি যাপন করা সুন্নত।
হজ্জের ৪র্থ দিন
তাওয়াফে যিয়ারত ও কোরবানী, চুল মুন্ডানো বা ছোট না করে থাকলে ঐ দিন করতে হয়।
সূর্য হেলার পর থেকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত সময়ে মিনায় শয়তান সমূহের স্তম্ভে ৭টি করে মোট ২১ টি পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।
প্রথম ছোট শয়তানকে ৭ টি পাথর নিক্ষেপ করতে হয়।
তারপর মেঝো শয়তানকে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করতে হয়।
তারপর বড় শয়তানকে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করতে হয়।
মিনায় রাত্রি যাপন করা সুন্নত।
১৩ই যিলহজ্জ মিনায় শয়তানে সমূহেক পাথর মেরে মক্কায় আসা উত্তর, এর সুন্নত সময় সূর্য হেলার পর থেকে।
হজ্জের ৫ম দিন
তাওয়াফে যিয়ারত ও কোরবানী না করে থাকলে সূর্যাস্তের পূর্বে অবশ্যই করতে হয়।
মিনায় সূর্য হেলার পর থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত সময় শয়তান গুলোকে পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।
প্রথম ছোট শয়তানকে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করতে হয়।
তারপর মেঝো শয়তানকে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করতে হয়।
তারপর বড় শয়তানকে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করতে হয়।
সূর্যাস্তের পূর্বে মক্কায় চলে আসা জায়েয।
সূর্যাস্ত পর্যন্ত, দুপুরের পূর্বেও পাথর মারা জায়েয তবে মকরূহ হয়, মক্কার বাহিরের লোকদের জন্য দেশে ফিরার পূর্বে বিদায়ী তাওয়াফ করা ওয়াজিব।
বিশেষ লক্ষণীয়:
বড় শয়তানকে পাথর মারার সুন্নত সময় হল ১০ই যিলহজ্জ থেকে সূর্য ঢালার পূর্ব পর্যন্ত, তবে সতর্ক থাকতে হয় এ সময়ে অনেকে ভিড়ের কারণে মারা যায়, আর সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত হল জায়েয এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে পরবর্তী সুবহে সাদিক পর্যন্ত মাকরুহেতানজিতী (ছোট মাকরূহ) সময় তবে মহিলা ও দূর্বলদের জন্য মাকরূহ নয়।
১১ ও ১২ই যিলহজ্জ পাথর মারার সময় শুরু হয় সূর্য ঢালার পর থেকে, এর পূর্বে মারলে আদায় হয় না সূর্য ঢালার পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত হল সুন্নত, আর সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত মাকরূহ হয়।
তাওয়াফে যিয়ারতের (ওয়াজিব) সময় ১০ই যিলহজ্জের সুবহে সাদিক থেকে ১২ই যিলহজ্জ পর্যন্ত।
৮ই জিলহজ্জ বা এর আগে মক্কা থেকে মিনায় রওয়ানা পূর্বে এহরামের সাথে নফল তওয়াফ করে হজ্জের সায়ী যদি না করে থাকে। তবে তওয়াফে যিয়ারতের পর হজ্জের সায়ী করা ওয়াজিব।
হজ্জের পূর্বে বা পরে হুজুর (সাঃ) এর কবর যিয়ারত করা মুস্তাহাব।