সর্বকালের সেরা ১০ বই
যেকোনো বইই সময়, সমসাময়িক সমাজের ইতিকথা, জীবনধারণের গল্পকে ধারণ করে। তথ্যের নির্ভুলতা, ভাষাশৈলী এবং বর্ণনার কৌশলের ওপর নির্ভর করে কিছু বই হয়ে ওঠে সময়ের সেরা বই। ফিকশন, ননফিকশন, কবিতা, আধুনিক, প্রাচীন—সবগুলো বিষয় বিবেচনায় নিলে এমন শতাধিক বই রয়েছে, যা সর্বকালের সেরা বলে বিবেচিত হতে পারে। এরপরেও সম্ভাব্য যে ১০টি সেরা বই পাঠকের তালিকায় থাকতে পারে, সেগুলো হলো—
লিও তলস্তয়ের আনা কারেনিনা
রুশ লেখক লিও তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসটি ১৮৭৩ সাল থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্বে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বই হিসেবে এটি প্রকাশ পায় ১৮৭৮ সালে। এই উপন্যাসটি তলস্তয়ের প্রথম উপন্যাস বলে মনে করা হয়। দস্তয়ভস্কি তাঁর এই লেখাকে ‘শিল্পের নিখুঁত প্রকাশ’ বলে বর্ণনা করেছেন। ভ্লাদিমির নাবোকভও লেখাটিকে ‘তলস্তয় রীতির নিখুঁত জাদু’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, আর উইলিয়াম ফকনার তো বলেছেন, ‘সেরা উপন্যাস’।
গুস্তাভে ফ্লবার্টের মাদাম বোভারি
১৮৫৬ সালে প্রকাশিত ‘মাদাম বোভারি’ ফরাসি লেখক গুস্তাভে ফ্লবার্টের প্রথম উপন্যাস। গল্পটি এক চিকিত্সকের স্ত্রী, এমা বোভারিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, যিনি গতানুগতিক আর শূন্য জীবন থেকে পালাতে পরকীয়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। উপন্যাসটি ১৮৫৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত লা রেভ্যু দ্য প্যারিসে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এসময় আইন কর্মকর্তারা অশ্লীলতার অভিযোগ তুলেছিলেন এর বিরুদ্ধে। পরের বছর জানুয়ারি মাসে এ নিয়ে মামলার ফলে ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে যায় উপন্যাসটি। রায়ে ফ্লবার্ট নির্দোষ বলে প্রমাণিত হওয়ার পর বইটি প্রকাশ পায় এবং সে বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে সেরা বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান করে নেয়। এই উপন্যাসটি ফ্লবার্টের একটি মাস্টারপিস বলে মনে করেন সমালোচকেরা।
লিও তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস
তলস্তয়ের এই উপন্যাসটি বিশ্বসাহিত্যের উল্লেখযোগ্যতম কাজ। এটি তাঁর নিখুঁত সাহিত্যগুলোর মধ্যে সেরা বলেও মনে করা হয়। এই উপন্যাসে পাঁচটি অভিজাত পরিবারের বয়ানের মাধ্যমে ফ্রান্সের রাশিয়া আক্রমণের ঘটনা এবং নেপোলিয়ান যুগে সিজারিক সমাজের ওপর প্রভাব আলোচিত হয়েছে। উপন্যাসটি বই আকারে ১৮৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। নিউজউইক ২০০৯ সালে বইটিকে সেরা ১০০ বইয়ের তালিকায় সবার ওপরে রাখে। ২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’কে বিশ্বসাহিত্যের সেরা ১০ বইয়ের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রাখে।
ভ্লাদিমির নাবোকভের ললিতা
রাশিয়ান-আমেরিকান লেখক ভ্লাদিমির নাবোকভের ‘ললিতা’ উপন্যাস ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি তার বিতর্কিত বিষয়গুলোর জন্য আলোচিত। গল্পের প্রধান চরিত্র মধ্যবয়সী সাহিত্যের অধ্যাপক হামবার্ট তাঁর ১২ বছর বয়সী সেময়ের প্রেমে পড়েন এবং তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে তাঁর। উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় লেখা হয় এবং প্যারিসে অলিম্পিয়া প্রেস ১৯৫৫ সালে এটি প্রকাশ করে। পরে লেখক নিজেই এটি রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন এবং নিউ ইয়র্কে ফায়েদ্রা পাবলিশার্স ১৯৬৭ সালে উপন্যাসটি প্রকাশ করে। প্রকাশের পর খুব দ্রুতই সমালোচকদের নজর কাড়ে ললিতা। বর্তমানে এটি বিংশ শতাব্দির সেরা সাহিত্যকর্মের একটি বলে বিবেচিত হয়। বইটিকে উপজীব্য করে ১৯৬২ সালে এবং ১৯৯৭ সালে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।
মার্ক টোয়েনের দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন
মার্ক টোয়েনের ‘অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’ ১৮৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যে এবং ১৮৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। আমেরিকান সাহিত্যের সেরা কাজগুলোর একটি বলে মনে করা হয় এই বইটিকে। গল্পের চরিত্র হাকলবেরির বয়ানে ঘটনার বয়ান হয়েছে এতে। মিসিসিপি নদীর তীরের মানুষ আর স্থানগুলোর বর্ণিল বর্ণনার কারণেই পাঠকের মন জয় করেছে বইটি। বর্ণবাদ নিয়ে ব্যাঙ্গও বইটির সেরা তালিকায় স্থান করে নিতে সহায়ক হয়েছে।
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের হ্যামলেট
নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র ‘হ্যামলেট’ ঠিক কবে লিখেছিলেন, তার সঠিক কোনো তারিখ পাওয়া যায় না। তবে মনে করা হয়, ১৫৯৯ সাল থেকে ১৬০২ সালের মধ্যে এটি রচিত। ডেনমার্কের রাজা হ্যামলেটকে হত্যা করে তাঁর ভাই ক্লদিয়াসের সিংহাসনে আরোহন, ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে এবং তাঁর ভাতিজা যুবরাজ হ্যামলেটের প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনাগুলোই এই নাটকে বর্ণিত হয়েছে। হ্যামলেট শেক্সপিয়রের দীর্ঘতম নাটক এবং ইংরেজি সাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী শোকবহ রচনা বলে পরিগণিত হয়।
স্কট ফিেজরাল্ডের দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই
আমেরিকান লেখক এফ স্কট ফিেজরাল্ডের উপন্যাস ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই’ ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয়। এতে সমৃদ্ধ লং আইল্যান্ডের এক কল্পিত নগরীতে চরিত্রগুলোর বাস। ১৯২২ সালের এক গ্রীষ্মে ঘটনার সূত্রপাত। এতে প্রথমে রহস্যময় ধনী যুবক জে গ্যাটসবাই, তার খামখেয়ালি আর সুন্দরী ডেইজি বুচাননের প্রতি তার দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে ঘটনা এগিয়ে গেছে। এই উপন্যাসে লেখক অবক্ষয়, আদর্শবাদ, সমাজে আকস্মিক পরিবর্তন, পরিবর্তনে প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
মারসেল প্রোস্টের ইন সার্চ অব লস্ট টাইম
অতীত সময়কে বইয়ের পাতায় সংরক্ষণ করেছে মারসেল প্রোস্টের ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’। সাত খণ্ডের এই উপন্যাসটি এর দৈর্ঘ্যের জন্যও উল্লেখযোগ্য। এর অধ্যায়গুলোর মধ্যে মেডেলিনের অধ্যায়টি সেরা উদাহরণ হতে পারে, যা প্রথম খণ্ডেই সংযুক্ত হয়েছে। সি কে স্কট মনক্রিফ এবং টেরেন্স কিলমারটিন উপন্যাসটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯০৯ সাল থেকে উপন্যাসটি রচনা শুরু করেন প্রোস্ট এবং ১৯২২ সালের শরতে অসুস্থ হয়ে পড়া পর্যন্ত তিনি এ নিয়ে কাজ করে গেছেন। ফ্রান্সে এটি ১৯১৩ সাল থেকে প্রকাশ হতে শুরু করে।
অ্যানটন শেকভের দ্য স্টোরিজ অব অ্যানটন শেকভ
ছোট গল্পের সেরা লেখক মনে করা হয় অ্যানটন শেকভকে। তিনি তাঁর গল্পে রাশিয়ার মানুষদের জীবন তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখা গল্পগুলোর মধ্যে থেকে সেরা ৩০টি গল্প নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য স্টোরিজ অব অ্যানটন শেকভ’। দ্য হান্টসম্যান, আ বোরিং স্টোরি, ওয়ার্ড নম্বর সিক্স, দ্য লেডি উইথ দ্য লিটল ডগ—এই গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
জর্জ ইলিয়টের মিডলমার্চ
গতাণুগতিক জীবনকে ঘিরে ইংরেজ লেখক জর্জ এলিয়ট রচনা করেছেন ‘মিডলমার্চ’। ১৮২৯ সাল থেকে ১৮৩২ সাল পর্যন্ত মিডলমার্চের কল্পিত নগর মিডল্যান্ডের ঘটনাবলি এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি গল্পের সমন্বয় ঘটেছে এখানে এবং অনেকগুলো প্রধান চরিত্রকে ঘিরে উপন্যাসটি সামনে বেড়েছে। এতে সমাজে নারীর অবস্থান, আদর্শবাদ, স্বার্থপরতা, ধর্ম, ভণ্ডামি, রাজনৈতিক সংস্কার এবং শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কৌতুকেরও অভাব নেই এই উপন্যাসে। তথ্যসূত্রঃ ইত্তেফাক