দশমের মতো একাদশ সংসদ নির্বাচনেও অংশ না নিলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হতে পারে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-বিতর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ক্ষমতাসীন দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা ইতোমধ্যে বলেছেন এবারো নির্বাচন বর্জন করলে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও টেলিভিশনের টকশোতেও এ নিয়ে প্রায়শই বিতর্ক করছেন আলোচকরা। পরপর দুবার নির্বাচনে অংশ না নিলে আসলেই কি বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে? দেশের বিদ্যমান সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) কী বলে?
এ দুটি প্রশ্নের উত্তরসহ ব্যাখ্যা জানতে সংবিধান, আরপিও ও নির্বাচন বিষয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বললে তারা ইত্তেফাককে জানান, সংবিধানে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। বিষয়টি রয়েছে শুধু আরপিও’তে। এ আরপিও’টি আইন। যেই যেই কারণে একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের কথা আরপিও’তে বলা হয়েছে সেগুলোর ব্যাখ্যা বলছে, দশমের পর একাদশ নির্বাচনেও অংশ না নিলে এবং পরপর দুবার নির্বাচনে না যাওয়ার কারণে বিএনপির নিবন্ধন ঝুঁকিতে পড়বে, তবে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবেই— বিষয়টি এরকম চূড়ান্ত নয়। কারণ আইনে বলা আছে ‘মে’ বা ‘হতে পারে’; ‘শ্যাল’ বা ‘হয়ে যাবে’ ধরনের কিছু বলা নেই। তা ছাড়া বিএনপি যদি এবারো নির্বাচনে না যায় তারপরেও আরপিও অনুযায়ীই দলটির নিবন্ধন থাকা না থাকার বিষয়টি নিষ্পত্তির দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। যাতে চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন বাতিল হতে পারে, নাও হতে পারে।
উল্লেখ্য, শুধু বিএনপি নয়, এরকম ঝুঁকি রয়েছে বিএনপিসহ অন্তত ২৭টি রাজনৈতিক দলের। কারণ এ ২৭টি দলই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এ দলগুলোর মধ্যে যারা একাদশ সংসদ নির্বাচনেও অংশ নেবে না, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই ঝুঁকি তৈরি হবে।
বিষয়টি সম্পর্কে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও এক সময় নির্বাচন কমিশনের আইন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা ড. শাহ্দীন মালিক গতকাল রবিবার ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, “সংবিধানে বড় দাগে কতগুলো কথা বলা আছে, একেবারে সুস্পষ্ট কিছু নেই। নিবন্ধন বাতিলের কথা বলা হয়েছে আরপিও’তে। এবারো বিএনপি নির্বাচনে না গেলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে, সরকারি দলের কারো কারো এ ধরনের বক্তব্য ছেলেমানুষি। আমি কথাটা এ অর্থে বলছি যে বিএনপি যদি নির্বাচনে না-ও আসে তা হলে নিবন্ধন বাতিল ঠেকানোর জন্য যে কোনো দু’-একটি আসনে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে প্রার্থী দিলেই হলো। আইনে বলা আছে— পরপর দুবার অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিল হবে, কিন্তু তিনশ আসনেই প্রার্থী দিতে হবে এমন কোনো কথা বলা নেই। এমন বহু দল আছে যারা দু’-চারটি আসনে প্রার্থী দেয়। কাজেই বিএনপিও এরকম দু’-একটি আসনে প্রার্থী দিয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা কাটাতে পারে।”
আরপিও’টি আইন কি-না, কিংবা এ সংক্রান্ত পৃথক কোনো আইন আছে কি-না বা আইনের প্রয়োজন আছে কি-না; সাধারণ্যের কারো কারো এমন প্রশ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ্দীন মালিক বলেন, “আরপিওটি-ই আইন। কারণ আমাদের সংবিধান পাস হয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে। ’৭৩ এ প্রথম সংসদ নির্বাচন হয়। ’৭৩ এর এপ্রিল থেকে আইন পাস হতে শুরু করেছে সংসদে। ’৭২ থেকে ’৭৩ পর্যন্ত বলা ছিল- সংসদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি আইন করতে পারবেন, রাষ্ট্রপতির তখনকার আদেশগুলো আইন। তখন সেগুলোকে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার’ বলা হতো। পরবর্তীতে এরকম যে কয়টি আইন বলবত্ ছিল আরপিও সেগুলোর অন্যতম।”
প্রসঙ্গত, নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) আইনের ৯০ এইচ (১) ধারায় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি কারণে কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। এ ধারার (ই) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হবে, যদি কোনো রাজনৈতিক দল পরপর দুটি সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়।
অবশ্য নিবন্ধন বাতিলের ক্ষেত্রে কোনো দল যদি ৯০ এইচ (১) (ই) ধারা লঙ্ঘন করে, সেক্ষেত্রে দলটির নিবন্ধন সরাসরি বাতিল হবে না। পরপর দুবার নির্বাচনে অংশ না নেয়া দলটিকে শুনানিতে অংশ নেয়ার সুযোগ দেবে। কমিশনের কাছে দলটির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলেই কেবল তারা নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেবে।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে এই আইন প্রণয়নকালে সেই সময়ের এটিএম শামসুল হুদা কমিশন সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়েছিল। আইন প্রণয়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ওই সময় কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এ সংলাপের তথ্য নিয়ে কমিশন একটি বই প্রকাশ করেছিল। সেখানে বিএনপির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে কমিশনের আলোচনায় দেখা গেছে, নিবন্ধন বাতিলের এ ধারা নিয়ে দলটির পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি তোলা হয়নি। অন্য দলগুলোর পক্ষ থেকেও এ ধারা মেনে নেয়া হয়েছিল। তবে ওই আলোচনায় কমিশনকে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া নিয়ে আপত্তি তোলে বিএনপিসহ কয়েকটি দল। পরে এ-সংক্রান্ত ৯১ (ই) ধারাটি বাতিল করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সেই হুদা কমিশনে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, “আইনে আছে ‘মে’, অর্থাত্ হতে পারে; ‘শ্যাল’ বা ‘হয়ে যাবে’ এমন কথা বলা নেই। তা ছাড়া বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত এবারো নির্বাচনে অংশ না নেয়, সেক্ষেত্রেও দলটির নিবন্ধন বাতিল করতে চাইলে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রথমে দলটিকে নির্বাচন কমিশনের শোকজ বা কারণ দর্শানো নোটিশ দিতে হবে, তারপর এর ওপর শুনানি হবে, এরপর কমিশন সিদ্ধান্ত দেবে। কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতেও যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্তও কিন্তু চূড়ান্ত নয়। কাজেই এবারো নির্বাচনে না গেলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হতে পারে, না-ও হতে পারে। কারণ নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে বিএনপির দাবি যদি যৌক্তিক বলে কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয় তাহলে নিবন্ধন বাতিল হবে না।”
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করছে, দলের নিবন্ধন রক্ষার জন্য একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে বাধ্য হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সম্প্রতি বলেছেন, দলের নিবন্ধন রক্ষা করতে বিএনপিকে নিজের প্রয়োজনেই নির্বাচনে আসতে হবে। আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে- এমন ঝুঁকি নিয়ে বোকার মতো নির্বাচনে বিএনপি না আসার সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমার মনে হয় না।
সরকারি দলের নেতাদের এ বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, এ ধরনের জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। নিবন্ধন হারানোর যে ভয় দেখানো হচ্ছে, সেই ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না। নিবন্ধন নিয়ে বিএনপি ভাবেও না। তা ছাড়া বিএনপি এমন কোনো ঠুনকো দল নয় যে, নিবন্ধনের ভয়ে কোনো প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নেবে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা এবং না করলে নিবন্ধন বাতিলের ঝুঁকি সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘নির্বাচন ও আইনের অনেক ফাঁকফোকর আছে। আরপিও-তে নিবন্ধন বাতিলের যে কথা বলা আছে সেটি জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিনা সেটিও স্পষ্ট নয়। কিন্তু আমরা ধরে নিচ্ছি অবশ্যই এটা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এটা ঠিক যে পরপর দু’বার নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপিকে নিবন্ধন হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে হবে। কিন্তু মোটাদাগে দেখলে এখানে আইন মুখ্য নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়টি বিবেচ্য। কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দল বিষয়গুলোকে রাজনৈতিকভাবেই দেখে এবং সেইভাবে ফয়সালাও করতে চায়। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। বিএনপি যদি একাদশ নির্বাচনেও না যায় এবং দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে তাদের শূন্যস্থানটি উগ্র ও সাম্প্রদায়িক শক্তি দখলে নিতে পারে। এতে চূড়ান্ত বিচারে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।’
সূত্র: ইত্তেফাক