আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
শান্তিময় আগামীর পথে গৌরবোজ্জ্বল অভিযাত্রা
অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন
২৩ জুন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আওয়ামী লীগ গতানুগতিক ধারার কোনো সংগঠন নয়। এই সংগঠন মানুষকে শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষান্ত হয় না, স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নও ঘটায়। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাঙালির যা কিছু মহৎ অর্জন সবই অর্জিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে।
১৯৪৭ সালে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি পৃথক ভূ-খন্ড নিয়ে একটি অবাস্তব ও কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। এই দুই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষা-সংস্কৃতি এবং নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে কোনো মিল ছিল না। বাঙালি বিদ্বেষী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মাতৃভাষা বাংলাকে অস্বীকৃতি জানিয়ে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। সারাদেশের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। এরই পটভূমিতে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ৪ মাস ২০ দিন পর ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রথম সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ আত্মপ্রকাশ করে।
দীর্ঘ শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই সংগঠন সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা পালন করে। মুসলিম লীগের দুঃশাসন ও দমননীতির মুখে এক প্রবল বৈরী পরিবেশে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে এক কর্মী সমাবেশের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামছুল হক সাধারণ সম্পাদক ও জেলে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অচিরেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
১৯৫৩ সালের ৩, ৪ ও ৫ জুলাই ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। যদিও এই নামের ব্যাপারে জেলে থাকাবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। যার প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর লেখায় পাওয়া যায়। ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন- ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন চিন্তা-ভাবনা করেই করেছেন।’ ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র পরাজয়ের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই যেন জন্ম হয়েছিল এই আওয়ামী লীগের।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আরও গতিশীল হয়। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কর্মপরিষদ গঠন করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকসহ অনেকে। এরপর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ ৬-দফা পেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সামরিক শাসকগোষ্ঠী নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমস্ত পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মুক্তির দিশারী হিসেবে দেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনে দেশের মানুষ অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। দীর্ঘ ৯ মাস লড়াই- সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করি। বাঙালি জাতির দীর্ঘ এই সংগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছে। রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে মানুষের অধিকার আদায় করেছে।
১৯৭৪ সালের ১৮ জুন অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন- ‘কত চেহারা ভেসে ওঠে আমার সামনে। কত ত্যাগী কর্মী কারাবরণ করেছে। কত ভাই, কত সহকর্মী শহীদ হয়েছে। তাদের সঙ্গে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি। কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে দিন কাটিয়েছি। কত দিন আন্দোলন করতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। তাদের কথা স্মরণ না করলে অন্যায় হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাত্র ৯ মাসের মধ্যে জাতিকে সংবিধান উপহার দেওয়া হয়। সেই সংবিধান অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে বাংলাদেশ যখন সম্ভাবনার দিকে পা বাড়াতে শুরু করে তখন জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়। আইনের শাসন রুদ্ধ হয়। অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যায়। জাতির বুকে চেপে বসে সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্রের জগদ্দল পাথর। কায়েম হয় অন্ধকারের রাজত্ব। শুরু হয় হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।
চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু- কন্যা শেখ হাসিনাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দীর্ঘ ৬ বছরের নির্বাসন জীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু-কন্যার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। শুরু হয় বাঙালির ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার নবতর সংগ্রাম। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আন্দোলন-সংগ্রাম জীবনদানের পর দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভদিনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এই সময় দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরে আসে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে সংসদকে সকল করকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়। ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত পানি বণ্টন চুক্তি করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি করে দীর্ঘ দিনের হানাহানি রক্তপাত বন্ধ করা হয়। আইনের শাসন চালু হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি মর্যাদা পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের। বঙ্গবন্ধু-কন্যা’র নেতৃত্বে এই পাঁচ বছরের সময়কাল জাতির ইতিহাসে এক সূবর্ণ সময় হিসেবে বিবেচিত হয়।
২০০১ সালে বিএনপি-জামাতের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে দুর্বৃত্ত কবলিত হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। দেশ পরিণত হয় মৃত্যু উপত্যকায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে নারী নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়। বিএনপি-জামাত জোট আমলে সারাদেশে আওয়ামী লীগের ২৬ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়। নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার অপরাধে আওয়ামী লীগ নেতা- কর্মীসহ সংখ্যালঘুদের ভিটে-মাটি ছাড়া করা হয়। দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানো হয়। এসময় হাওয়াভবন কেন্দ্রিক লুটপাটের রাজত্ব সৃষ্টি করা হয়। বিএনপি-জামাত দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। পছন্দের লোকের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গিয়ে বিএনপি-জামাত সরকার দেশে এক জটিল অবস্থা তৈরি করে। যার ধারাবাহিকতায় দেশে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অযৌক্তিকভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে। তাকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তীব্র জনমতের কাছে ষড়যন্ত্রকারীরা পরাস্ত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সকল দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা আবারও সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান।
প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ৯ বছরে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের আর্থ- সামাজিক অবস্থা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।ইতোমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। মাথাপিছু আয় ১৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা এখন স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ কখনই লক্ষ্য নির্ধারণ করে বসে থাকে না। লক্ষ্যপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি দিয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করে। কোন কোন মহল আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অতীতের মতো অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ জনগণকে সাথে নিয়ে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বদ্ধ পরিকর। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর উন্নত সমৃদ্ধ শান্তিময় বাংলাদেশ রেখে যেতে যান। সেই কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে সবাইকে স্বাগত জানাই।
লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ