শেখ হাসিনার একগুঁয়েমিতে রাজনীতির মাঠ শান্ত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
সোমবার (১৫ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি।
রিজভী বলেন, অবৈধ ক্ষমতা ধরে রাখতে শেখ হাসিনা একগুঁয়েমি করছেন। তাঁর এই একগুঁয়েমির জন্য রাজনীতির ময়দান শান্ত, নিরাপদ ও সুখময় হয়ে উঠবে না।
গতকাল শিবচরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যকে বিভ্রান্ত মনের উন্মাদনা মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী সরকারের পড়ন্ত বেলায় প্রধানমন্ত্রীর খাপছাড়া বক্তৃতায় দৈন্যদশার বহি:প্রকাশ। গতকাল মাওয়া ও শিবচরের জনসভায় অবৈধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী আজগুবি, উদ্ভট, স্ববিরোধী নানা কথা বলেছেন। যা জাতিকে হতবাকই করেনি, মানুষ মুচকি হেসেছেও। আসলে তিনি তাঁর বক্তব্যে নিজ দলের অনাচারগুলো অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে বক্তব্য রেখেছেন’।
রুহুল কবির বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই-২০০৬ সালের অক্টেবরে আপনি যখন লগী বৈঠা নিয়ে আপনার কর্মীদের ঢাকায় আসতে বলার নির্দেশ দিয়ে দলীয় লোকদেরকে দিয়ে ২৮ অক্টোবরে লাশের ওপর নৃত্য করালেন, তারপরেও কী আপনাকে শান্তির দূত বলতে হবে ? চট্টগ্রামে হত্যার হুমকির কথা বাদই দিলাম, এবারে ক্ষমতায় এসে বিএনপি’র মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে যুবনেতা-ছাত্রনেতাসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের গুম হওয়া-যা প্রত্যক্ষভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তারপরেও কী আপনাকে মানবতার জননী বলতে হবে ?
বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার বিচার বহির্ভূত হত্যার হিড়িকে দেশব্যাপী আতংক ও ভয়ের গ্রাসের মধ্যেও আপনাকে কী বলতে হবে আপনি আইনের শাসনের সরকারের প্রধান ? আপনার শাসনামলেই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে, দেবালয়ের পুরোহিতকে হত্যা করা হয়েছে, বিদেশীরা হত্যার শিকার হয়েছে।
আপনার দলের এমপি কচি-বাচ্চা ছেলের পায়ে গুলি করেছে, নারায়ণগঞ্জের নিস্পাপ কিশোর ত্বকী হত্যারও অভিযোগ সেখানকার আপনারই একজন এমপি’র বিরুদ্ধে, তারপরেও আপনাকে কী মাদার অব তেরেসা বলতে হবে ?
দেশের সাধারণ মানুষের মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে আপনি নিজেকে একক ভাষ্যকারে পরিণত করে বক্তৃতায় অন্যকে খুনী, দুর্নীতিবাজ বলছেন-অথচ খুন, জখম যে আওয়ামী শাসনের ঐতিহ্য তা কিন্তু মানুষ ভুলে যায়নি।
মানুষ ভুলে যায়নি ‘৭২ থেকে ‘৭৫’ এ হাজার হাজার প্রগতিশীল নেতাকর্মীর হত্যার কথা, ভুলে যায়নি প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ শিকদারের হত্যাকাণ্ড ও এই হত্যাকাণ্ডের পর আস্ফালন। এরপরেও কী আপনাদেরকে শান্তির বার্তা বাহক বলতে হবে ? যে দলের এমপি লতিফ সিদ্দিকী বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে বিএনপি’র লোকদের হত্যা করার আদেশ দেয়, সেই দলকে কি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের সঙ্গে তুলনা করবো ?
তিনি বলেন,‘আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম তো বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে সেবামূলক কাজ করে। আর আওয়ামী লীগ প্রতিনিয়ত জীবন্ত মানুষকে লাশ করার কাজ করে’।
সাবেক এই ছাত্র নেতা বলেন, ‘আমি আবারও প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে বন্দি করে এবং বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় একের পর এক সাজা দিয়ে আপনার ক্রোধাগ্নী নির্বাপন করতে পারেননি, এর উপর মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে পাথর চাপা দিয়ে সারাজাতির দম বন্ধ করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা কালাকানুন করে-আপনারা গণতন্ত্রকেই লকআপ করেছেন। এখন মানুষ মন খুলে কথা বলতে এবং হাসতেও ভয় পায়। মানুষ এখন ডিজিটাল আতংকে ভুগছে।
আপনার নির্বাচনে ভোটারদের কোন অস্তিত্ব নেই, আপনার অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে তা ভোট ডাকাতি। গণমাধ্যমগুলোর মালিক ও সাংবাদিকরা চরম আতংকে আছেন। এরপরেও কী আপনাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলতে হবে ?
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট হয়ে গেল, আপনার আমলে বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেল, ঘুষ ছাড়া এখন কিছুই হয় না, ঘুষ নিতে মন্ত্রীরাও কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে উৎসাহিত করে, আপনার কেবিনেটের অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন-বাংলাদেশে এখন পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি হচ্ছে, তারপরেও কি বলতে হবে আওয়ামী মহাজোট সরকার সৎ ও স্বচ্ছ সরকার ? আওয়ামী সরকার ভাসছে কী স্বচ্ছ সরোবরে ?
পদ্মা সেতু’র দুর্নীতি নিয়ে যে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল তারা এখনও সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করেনি। কুইক রেন্টাল বিদ্যূৎ খাতে ব্যাপক দুর্নীতিতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, জনগণের পকেট কেটেই বিদ্যূতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে, আর জনগণের এই টাকা নয়-ছয় করেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ সিঙ্গাপুরে শ্রেষ্ঠ ধনী হচ্ছে, মালেশিয়া ও কানাডায় সেকেন্ড হোম ও বেগম পল্লী গড়ে উঠছে, তারপরেও কি বলতে হবে আওয়ামী সরকার ধোয়া তুলসী পাতা ?
আইটি সেক্টরের লক্ষ-কোটি ডলারের দুর্নীতি কিন্তু মানুষের অজানা নয়। ভিওআইপি ব্যবসার সাথে কারা জড়িত সেটিও মানুষ অবগত। নানামূখোশে শোভিত অতি ক্ষমতাবানদের মুখোশের ভেতরের চেহারাটার খবরও রাখে জনগণ। একদিন হুড়মুড় করে সব বেরিয়ে পড়বে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়েও সেটি আটকানো যাবে না। বলেও যোগ করে বিএনপির এই নেতা’।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী মহাজোট সরকারের হরিলুটের জন্য এখন চালের কেজি ৮০ টাকা হয়েছে, ৫০ টাকা কেজির নীচে কোন সবজি নেই, তেলের লিটার এখন ১১০ টাকা, সকল নিত্যপণ্যের দাম এখন গ্যালাক্সীতে গিয়ে ঠেকেছে। কর ও ট্যাক্সের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। গ্যাস ও বিদ্যূতের দাম বেড়েছে আলোর গতিতে। এই পরিসংখ্যান তো প্রধানমন্ত্রী তাঁর গতকালের বক্তব্যে উল্লেখ করেননি। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পার কিলোমিটার রাস্তা তৈরীতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশে তা হয় কয়েক গুণ। এই বাড়তি ব্যয় তো হয় শুধুমাত্র ক্ষমতাসীনদের পকেট ভারীর জন্য। প্রধানমন্ত্রী আপনি এসব বিষয় এড়িয়ে গেলেও এসব দুর্নীতির কথা মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছে। সুতরাং বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বৈরাচার ও নিকৃষ্ট মানের দুর্নীতিবাজ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একথা স্বীকার না করলেও জনসমাজে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে’।
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘সকল রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ইভিএম এর বিরোধীতা করলেও সরকারের অনড় প্ররোচনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইভিএম পদ্ধতি কেন চালু করতে চাচ্ছেন, সেই থলের বিড়ালটি এখন বেরিয়ে পড়ছে। ভারতের চেয়েও এগার গুণ বেশী দামে ইভিএম কেনার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভোটের আগে বেশ বড় পরিমান টাকা হাতিয়ে নেয়া। নির্বাচনের প্রাক্কালে এই টাকা কমিশনের কিছু ব্যক্তিকে উপহার দিলেন কী না, এটা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। কারণ অনেক কর্মকর্তা কমিশনের নিরপেক্ষতা ভেঙ্গে সরাসরি সরকারের দুষ্কর্মের সঙ্গী হতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে’।