শেখ হাসিনার বহুল আলোচিত ভারত সফর শেষ হয়েছে। সফর নিয়ে দেশটির প্রথম সারির বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বিতর্কিত ‘এনআরসি’ বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী প্রশ্নে ভারতকে আরো স্বচ্ছতা দেখানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা আর এনআরসি নিয়ে সরকারের দুই রকম কথা সেটি মোটেও কল্যাণকর নয়। এ নিয়ে একাধিক সম্পাদকীয়তে সতর্ক করা হয়েছে সরকারকে।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চীনের উপস্থিতি আছে, থাকবে- এটি মেনে নিয়েই ভারতের এগোনো উচিত – এমন পরামর্শও দিয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সফরকে সার্বিকভাবে ভারতের গণমাধ্যম কীভাবে বিশ্লেষণ করছে- এই প্রতিবেদনে মূলত তারই অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
বস্তুত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে বিদায় নেওয়ার পর প্রায় ৭২ ঘণ্টা কাটতে চলল, কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় সেই সফরের কাটাছেঁড়া ও ময়নাতদন্ত এখনও অব্যাহত। সফরের চার দিন শেখ হাসিনা ভারতের প্রায় সব জাতীয় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ঠাঁই পেয়েছেন, আর সফর শেষে বিভিন্ন সম্পাদকীয় বা মন্তব্য প্রতিবেদনে এখনও চলছে ওই সফরের বিশ্লেষণ।
তবে সফরের সময় স্বাক্ষরিত বিভিন্ন সমঝোতা স্মারক বা চুক্তির চেয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘এনআরসি’, যে প্রসঙ্গ দুদেশের যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখও করা হয়নি।
‘দ্য হিন্দু’ লিখেছে, বাংলাদেশ সরকার যদিও এখনও পর্যন্ত ভারতের মুখের কথায় ভরসা রাখছে – কিন্তু তারা এনআরসি নিয়ে যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন সেগুলো উপেক্ষা করা দিল্লির জন্য মোটেও ঠিক হবে না।
দ্য হিন্দুস্থান টাইমস’-ও প্রায় একই সুরে বলছে, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সেরা বন্ধু’ যদি এনআরসি প্রশ্নে উদ্বিগ্ন বোধ করলে দিল্লির উচিত হবে দূর করা।’ পত্রিকাটি অবশ্য একই সঙ্গে তিস্তা চুক্তির প্রশ্নেও ভারতকে আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
দিল্লিতে বাংলাদেশ গবেষক শ্রীরাধা দত্ত বলছিলেন, ভারতীয় মিডিয়াতে এই ধরনের পর্যবেক্ষণ বেশ ইতিবাচক একটা পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘এবার দেখে ভালো লাগছে যে অনেক বেশি খোলা মন নিয়ে ও একটা ন্যায্যতার দৃষ্টিতে ভারতীয় মিডিয়া দুদেশের সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করছে।’ বলা যেতে পারে, বিষয়টি একতরফাভাবে পরিবেশিত হচ্ছে না।
টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, এনআরসি ইস্যু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি স্ট্রেইন বা উত্তেজনার কারণ – এই অভিযান বন্ধ করে ভারতের উচিত হবে দক্ষিণ এশিয়ার ‘গ্রোথ ইঞ্জিন’ বাংলাদেশ থেকে অর্থনীতির পাঠ নেওয়া।
আবার এনআরসি-কে যেভাবে সরকার একদিকে অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে বর্ণনা করছে, অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অবৈধ বিদেশিদের বাংলাদেশে ডিপোর্ট করার হুমকি দিচ্ছেন, এই দ্বিচারিতার কড়া সমালোচনা করেছে ‘স্ক্রল’ পোর্টাল। এই পটভূমিতেই শ্রীরাধা দত্ত বলছিলেন, ‘স্ববিরোধিতা তো আছেই। আর সেখানে এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, আপনাদের ও নিয়ে ভাবতে হবে না বললেই কিন্তু সব কিছু মিটে যায় না।’
তিনি বলেন, ‘বস্তুত আমার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরগুলোতে ওই দেশের মিডিয়া, অ্যাকাডেমিয়া বা নীতি-নির্ধারক সবার কাছ থেকে প্রথমেই আমাদের যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয়েছে তা কিন্তু এনআরসি। এখন ভারতীয় মিডিয়াও যে তাদের এই উদ্বেগ অনুধাবন করেছে, সেটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক।’
বাংলাদেশ উপকূলে ভারতের রেডার সিস্টেম বসানোর পটভূমিতে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ কমোডোর উদয় ভাস্কর আবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিবন্ধটির শিরোনাম হলো ‘ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে দিল্লিকে এটি মেনে নিতে হবে যে বাংলাদেশে চীনেরও উপস্থিতি আছে।’
ভারতীয় নৌসেনার সাবেক কর্মকর্তা ভাস্কর বলেন, ‘চীন থেকে সবচেয়ে বেশি সামরিক সরঞ্জাম পেয়ে থাকে যেসব দেশ, সেই তালিকার ওপর দিকেই আছে বাংলাদেশ। সেখানে আরো আছে পাকিস্তান বা মিয়ানমারও।’
ভাস্কর বলেন, ‘এখন আমি যেটা বলতে চেয়েছি, চীন থেকে সাবমেরিন পাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে – আর সেটি ভারতকেও নিশ্চয় উদ্বিগ্ন করবে। কিন্তু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে চীনের এই উপস্থিতি একটা বাস্তবতা – এটাতে বিরক্ত বোধ না করেই ভারতকে তা ডিল করার উপায় খুঁজতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘হয় আমরা, নয়তো চীনের মধ্যে থেকে বেছে নাও – বাংলাদেশকে সেদিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না।’
ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জিও ওই পত্রিকায়ই তাঁর মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় রাখতে চাইলে দিল্লিকে যে ‘আরো বেশি কিছু করতে হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’
শেখ হাসিনার সফরের পর মেইনস্ট্রিম ভারতীয় মিডিয়ার মূল বক্তব্যও সেটাই – এবার কিন্তু করে দেখানোর পালা ভারতের।