আসছে জাতীয় নির্বাচনে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হবে বলে দাবি করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দলগুলো নিয়ে সর্ববৃহৎ ঐক্য ‘একমঞ্চ’ কিংবা ‘যুগপৎ’ যে কোনো প্ল্যাটফরমে আন্দোলন হতে পারে। কেউ না কেউ সামনে এগিয়ে যাবে এবং জনগণও তার পেছনে যাবে।
গুলশানে নিজ বাসায় শুক্রবার জনপ্রিয় এক জাতীয় দৈনিক পত্রিকাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জোট, আন্দোলন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই নেতা।
মান্না বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন কোনো বড় ইস্যু নয়। বরং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনই এখন সবার একমাত্র দাবি হওয়া উচিত। যদিও বিএনপির জাতীয় ঐক্যের ডাকের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও চরমোনাই পীরের দলকে নিয়ে যদি ঐক্যের চিন্তা করা হয়, তাহলে তা হবে না। আমরা বিশ্বাস করি, বহির্বিশ্বের শক্তিগুলোও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রেখেই সবকিছু করবে। তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাইরে কোনো কিছু গ্রহণ করবে না। নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, যতক্ষণ এই সরকার আছে; যাকেই নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হোক না কেন কিছুই যায় আসে না। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে আন্দোলন করবেন, তা ঠিক হবে না। কারণ বর্তমান সরকার তাদের মতো করেই ইসি ঘোষণা করে দেবেন-এটাই হবে। তাই এটা কোনো বড় ইস্যু নয়। বরং প্রধান দাবি হওয়া উচিত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। তবে সরকারকে বলব, এমন একটা নির্বাচন কমিশন করুন, সেটা সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে নির্বাচন করতে পারবে। কীভাবে হবে, তা সবাই বসে ঠিক করা উচিত। সরকার যদি মনে করে পরামর্শ নেবে, তখন দেব।
বিএনপির জাতীয় ঐক্যের ডাকের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমত জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার অর্থ হচ্ছে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তারই একটা প্রকাশ। এখন এই জাতির মধ্যে কি জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও চরমানোই পীরের দল পড়ে? তাদের নিয়ে ঐক্য হবে? বিএনপি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন তা স্পষ্ট নয়।
বিএনপি ‘একলা চলো নীতিতে’ চলছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে ডাকসুর সাবেক এই ভিপি বলেন, ‘বিএনপি দলগতভাবে সে অধিকার রাখে যে নিজেদের মতো করে চলবে। সেটা যদি হয়, তাহলে বিএনপি একা সফল হবে-এটা ভাবার মতো কোনো পরিস্থিতি এখনো হয়নি। কিন্তু বিএনপি যদি সারা দেশের রাজনীতিকে প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, যদি রাজনীতির সামনে থাকতে চায়, তাহলে তাদের সমগ্র জাতির স্বার্থটা বিবেচনায় আনতে হবে।’
কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় এক্যের সরকারের দাবি তুলেছে-এ ব্যাপারে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের কথা বলছি না, আমি বলছি নির্বাচনকালীন সরকার। জাতীয় ঐক্যের সরকার হলে তো সেখানে আওয়ামী লীগেরও কেউ থাকবেন। মানে হলো-যারা দিনের ভোট আগের রাতে নিয়েছে তাদেরকে রেখে আবার নির্বাচন করার চিন্তা। কথার কথা-যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগের কাছে গেছে, তখন তারা তো যেরকম ইচ্ছা সে রকম করতে পারবেন। তাই নির্বাচনকালীন সরকার হতে হবে। সবার আগে সরকারের পতন চাই। তারপরই নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। সেখানে যত ছাড় দিয়ে হয় করা উচিত। এমনও হতে পারে আওয়ামী লীগের কাউকে কাউকে সেখানে আমি মানতেও পারি। আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছু নেতা তো আছেন যাদের হয়তো বিশ্বাসও করা যাবে।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয়নি। তবে কার্যত এই জোট নেই।’
বিরোধী জোট হলে নির্বাচনকালীন নেতা কে হবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে মান্না বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি যদি কোনো নেতা দেয়, ভালো। কিন্তু তা অন্য দলের নেতারা মানবেন, তা তো কথা নেই। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো সময় বলা হয়নি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল, সেখানে সবাই সমান ছিল। পরে সেই নির্বাচন হয়েছে, তারা মেজরিটি নিয়ে সরকারে গেছেন। জোটে কাউকে নেতৃত্বে রাখতেই হবে-সেরকম আমি মনে করি না। তবে হ্যাঁ, একজন মুখপাত্র থাকা জরুরি হবে। সেটা করব আমরা। যাকে মনে করি রাজনীতিটা ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারেন, কূটনৈতিক ও প্রশাসনের সঙ্গে যেখানে দরকার কথা বলতে পারবেন, সেরকম কেউ থাকবে, তাহলেই তো হয়।’
আগামী নির্বাচনে বহির্বিশ্বের শক্তিগুলোর মনোভাব সম্পর্কে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমেরিকা স্পষ্ট ঘোষণা করেছে বিতর্কিত নির্বাচনকে স্বীকার করবে না। বড় শক্তিগুলোর মধ্যে রাশিয়া কিংবা চীন খুব নির্বাচনের প্রক্রিয়ার ওপর বিশ্বাসই করে না। আর ভারতের ব্যাপারটা হচ্ছে তারা সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু গত নির্বাচন বা তার আগের নির্বাচনে তারা এই সরকারকে একটা পুরোপুরি ‘ব্ল্যাংকচেক’ দিয়েছিল। কিন্তু আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনো তারা নতুন করে কিছু বলেননি। আমি বিশ্বাস করি, ভারতও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রেখেই সবকিছু করবে। তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ এখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাইরে কোনো কিছু গ্রহণ করবে না।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া কি রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছেন? ধরেন খালেদা জিয়া ঘরের মধ্যে আছেন। তার বাসার সামনে তো বেশ বড় একটা বাগান আছে, ওখানে হাঁটতে পারেন না। দরজা খোলা রেখে হাঁটতে পারেন না। তিনি কি সামনের বাসায় যেতে পারেন না। নাকি তাও নিষেধ? খালেদা জিয়া যদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটেন-এটাই বড় নিউজ।’
আগামী নির্বাচনে দলের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য-একটা নিরাপদ, গণতান্ত্রিক ও মানবিক দেশ। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে যাদের সঙ্গে পারি হাঁটব। এমন না যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জোনায়েদ সাকি বা নূররাই আমাদের পছন্দ, তাদের সঙ্গে হাঁটছি। এটা আ স ম আবদুর রব, ড. কামাল হোসেন যে ঐক্যফ্রন্টে ছিল, সেটা নিয়েও চলতে পারি। আরও বামরা যদি থাকে যুগপৎভাবে চলতে পারি। আমরা সেই লক্ষ্যে হাঁটছি। জোট গঠন কিংবা ঐক্য নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি বলেও জানান মাহমুদুর রহমান মান্না।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কিছু বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কথাও জানান মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ নেতা সম্পর্কে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। আমি দল করি, অন্য দলের নেতা সম্পর্কে কেন বলব। আবার এটাও ঠিক জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তো দল নেই। ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ অন্য দলের সমালোচনা করতেই পারেন। সে দৃষ্টিতে দেখলে আবার দোষ দেখি না। সেজন্য যে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে গালমন্দ করবেন, সেটা ঠিক মনে করি না। তবে তিনি যেহেতু ঐক্যফ্রন্টের নেতা-এরকম কথা না বলাই ভালো। এছাড়া তার জাতীয় সরকারের দাবির সঙ্গেও আমি একমত নই।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব খুবই স্পষ্ট। তারা চলছে খেয়ালখুশিমতো। চাপ আছে চতুর্দিক থেকে। মাঝেমধ্যে গণতন্ত্রের ভান করা হচ্ছে। নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে দেখানো হচ্ছে, দেখ আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। সামগ্রিকভাবে একটা অযোগ্য ও জনগণ ধিকৃত এই সরকার।
সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের আন্দোলন শক্তিশালী হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একমঞ্চে কিংবা যুগপৎ-যে প্ল্যাটফরমেই হোক, আন্দোলন হওয়া উচিত। তা না হলে কেউ না কেউ সামনে এগিয়ে যাবে, মানুষও তার পেছনে যাবে। ছয় দফার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন পর্যন্ত কোনো জাতীয় ঐক্য হয়নি। কিন্তু সফল হওয়া গেছে। শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে বড় নেতা ছিলেন না। তখন তার চেয়ে বড় নেতা আরও ছিলেন; কিন্তু তারা পেছনে পড়ে গেছেন। দেশ এখন এমন সংকটে যে, মানুষ পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। এখন যারাই সরকার পতনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারবেন, জনগণ তাদের পেছনেই চলবে।