একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধু তার গ্রেফতারের কয়েক মিনিট আগে জানান,পাকিস্তানি সেনারা তাকে গ্রেফতার করতে আসছে। তবে বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর স্মৃতিচারণায় এ কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে ৮১ বছর বয়সী হাজী মোর্শেদ বলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশস্বাধীন হয়ে গেল। তারা আমাকে গ্রেফতার করতে আসছে। আমি বাসা’ই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
হাজী মোর্শেদ স্মৃতিচারণ করে বলেন যে, বঙ্গবন্ধু চোখ বন্ধ করে তার কক্ষে একাকী বসেছিলেন। তিনি রাত দশটার দিকে এ কথা বলেন এবং এর কয়েক মিনিট পর সর্বশেষ সাক্ষাৎকারী হিসেবে তৎকালীন ছাত্রনেতা তবিবর রহমান আসেন। তিনি মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার বিনীত অনুরোধ জানান।
মোর্শেদ বলেন, ‘তিনি (তবিবুর) তার সাথে আলিঙ্গন করেন এবং বলেন, অতি স্বত্ত্বর বাড়ি ছেড়ে চলে যান, তারা (সেনাবাহিনী) আপনাকে হত্যা করবে।’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যদি তারা আমাকে না পায় তারা সব লোককে মেরে ফেলবে এবং ঢাকা নগরী ধ্বংস করে দেবে।’
হাজী মোর্শেদ বলেন, ‘রাত সাড়ে এগারোটার দিকে একটি অজ্ঞাত ফোন রিসিভ করেন। ফোনে বলা হয়, তিনি বলধা গার্ডেন থেকে বলছেন এবং ট্রান্সমিটার বসানো হয়েছে। এখন তিনি কি করবেন জানতে চান।’
তিনি বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুকে এ খবর জানাই। বঙ্গবন্ধু তাকে (অজ্ঞাত ব্যক্তি) বলতে বললেন যে, স্থাপনকৃত ট্রান্সমিটার ভেঙ্গে দিয়ে সে যেন ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
হাজী মোর্শেদ বলেন, তিনি ১৯৪৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। সে সময়বঙ্গবন্ধু কলকাতায় ছাত্রনেতা হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালেরঘটনাবহুল মার্চ মাসে প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর সংগে কাটিয়েছেন।
তিনি বলেন, ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর ১টা পনের মিনিটের দিকে পুরো আকাশ উজ্জ্বলআলোয় আলোকিত হয়ে যায়। এ সময় তিনি ফোন রিসিভ করছিলেন। বঙ্গবন্ধু এর পর তার কাছে আসেন এবং কোনদিক থেকে আলো আসছে তা জানতে চান। এরপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যান।
হাজী মোর্শেদ বলেন, কয়েক মুহূর্ত পর এক ব্যক্তি চিৎকার করে বলল, ‘হ্যান্ডসআপ’…. মাত মারো (হত্যা করো না)। এ সময় তিনি বাড়ির সিঁড়ির পাশে টেলিফোনসেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
হাজী মোর্শেদ বলেন, ‘কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এক লোক আমার মাথার পেছনে আঘাত করে এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি এবং সে রাতের সর্বশেষ ঘটনা বলতে আমি এটুকুই মনে করতে পারি।’
ঘটনার অপর প্রত্যক্ষদর্শী বিগত বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন যিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির পাশের বাড়ি থেকে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।
বঙ্গবন্ধু ভবনের পার্শ্ববর্তী ভবন দার-ই খাসে’র বাসিন্দা এ কে এম মোশাররফ হোসেন আরো বলেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সময় গুলি ছুড়ছিল।
তিনি বলেন, ‘আমি তাকে (বঙ্গবন্ধু) চিৎকার করে বলতে শুনলাম “গুলি বন্ধ কর” এবং তারা গুলি বন্ধ করে।’
বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসার পর হাজী মুর্শেদকে অজ্ঞান ও রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। এ দৃশ্য দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বলেন, ‘তোদের এতবড় স্পর্ধা তোরা তাকে মেরেছিস, আমি তাকে জীবিত চাই।’
‘বঙ্গবন্ধু জানতেন এবং আমরা বুঝতে পেরেছিলাম পাকিস্তানি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করতে আসছে এবং আমরা আতঙ্কিত ছিলাম তারা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলে কি-না। তাদের মোকাবেলা করার মত সৎ সাহস তাঁর ছিল। তিনি কাপুরুষ ছিলেন না।
উভয় প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ২৫ মার্চ দিনের প্রথমভাগে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানি ও বিদেশী সরকারি কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর সংগে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে আসেন। অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর অ্গং সংগঠনের নেতা ও কর্মীরাও দল বেঁধে আসতে থাকেন।
হাজী মোর্শেদ বলেন, এসব সাক্ষাৎকারীর মধ্যে একজন হলেন পুলিশ অফিসার এম এআওয়াল। তিনি সে সময় আনসার বাহিনীর পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তিনি তার আধা পুলিশ বাহিনী আনসারের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। এই অস্ত্র প্রত্যেক জেলায় পুলিশ সদর দফতরে রাখা ছিল।
এ বিষয় নিয়ে ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের সংগে আলোচনা করা হলে তিনি(সিরাজুল আলম খান) অনাগ্রহ দেখান। কিন্তু বিকেলে বঙ্গবন্ধু হাজী মোর্শেদকে এম এ আওয়ালের সংগে তদানীন্তন ঢাকার এসপি ই এ চৌধুরীর কাছে পাঠান।
আসন্ন সামরিক অভিযান প্রতিরোধ করার জন্য পুলিশ সদস্যদের মধ্যে পুলিশের অস্ত্র বিতরণ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাদের পাঠানো হয়েছিল।
হাজী মোর্শেদ বলেন, তবিবুরের আগে তাজউদ্দিন আহমেদ, ড. কামাল হোসেন এবংব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মত বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য আসেন এবং মধ্যরাতের আগেই তারা ফিরে যান।
সূত্রঃ volunteersleague.org