সর্বকালের সেরা ৫ উইকেট কিপার-ব্যাটসম্যান
উইকেট কিপার (Wicket Keeper) ক্রিকেট মাঠের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ডিং পজিশন। উইকেট কিপার স্ট্যাম্প এর পেছনে গ্লাভস এবং প্যাড পরিহিত অবস্থায় বল ধরে, স্ট্যাম্পিং করে, রান আউট করে ইত্যাদি। ব্যাটিং এও তারা খুবই ভালো। কারন উইকেটকীপার সাধারণত উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান হিসেবেই পরিচিত। উইকেটকীপিং করা খুবই চ্যালেন্জিং একটা কাজ। তাদের খুবই অ্যাথলেটিক, অ্যাগ্রেসিভ, নির্ভল নড়াচড়া, প্রখর দৃষ্টি সম্পন্ন, দ্রুত এবং চটপটে হতে হয়। এখন পর্যন্ত ক্রিকেট বিশ্ব অনেক উইকেট কিপার দেখেছে, তাদের প্রায় সবাই নিজ নিজ দেশের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। কিন্তু তবুও এদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা দেশের গন্ডি পেড়িয়ে ইতিহাসে নিজেদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখেছেন।
এখানে সেরা ৫ উইকেট কিপার নির্বাচনে যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের আন্তর্জাতিক এবং ঘরোয়া লীগের স্ট্যাটিস্টিক, মাঠের খেলায় প্রভাব ইত্যাদি ধরা হয়েছে। যদিও লিস্টে থাকা বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত তবুও বর্তমানের উইেকেট কীপারও (Wicket Keeper) আছে যারা এই সেরা ৫ এর লিস্টে স্থান করে নিয়েছেন।
৫) ইয়ান হিলি: ইয়ান হিলি ৩০ এপ্রিল ১৯৬৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেকের পর তিনি ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত মোট ৩৪৪ টি টেস্ট খেলেছেন। এরমধ্যেই অবশ্য ১৯৯৭ সালে অবসরের আগে ১০২ টি এক দিনের ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছেন।
স্ট্যাম্পের পিছনে উইকেট কিপার হিসেবে ইয়ান হিলি মোট ৬২৮ টি ডিসমিসালের সাথে জড়িত। যেখানে ৩৪৪ টি টেস্টে ৩৬৬ টি ক্যাচ এবং ২৯ টি স্ট্যাম্পিং এর মাধ্যমে ৩৯৫ টি ডিসমিসাল। আর একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১৯৪ টি ক্যাচ এবং ৩৯ টি স্ট্যাম্পিং এর মাধ্যমে ২৩৩ টি ডিসমিসাল। টেস্ট ( ৪৩৫৬ রান, ৪ টি সেঞ্চুরি ) এবং ওডিআই ( ১৭৬৪ রান ) মিলে তার মোট রান ৬১২০। এছাড়া তিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৮ টি ম্যাচে অধিনায়কত্ব পালন করেন।
১৯৯৪ সালে তিনি ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেন এর বর্ষসেরা খেলোয়ার নির্বাচিত হন। খেলা থেকে অবসরের পর তিনি প্রথমে চ্যানেল নাইনের নিউজ প্রেজেন্টার এর কাজ করেন। পরে কিছুদিন কোচিং করালেও ১৯৯৯ সালের পর থেকে তিনি ধারাভাষ্যকার হিসেবেই নতুন ক্যারিয়ার শুরু করেন।
৪) মহেন্দ্র সিং ধোনি: মহেন্দ্র সিং ধোনি ৭ জুলাই, ১৯৮১ সালে ভারতের রাঁচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এখনো পর্যন্ত ইন্ডিয়ার সেরা উইকেট কিপার। উইকেট কীপিং করার পাশাপাশি তিনি ইন্ডিয়ার অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেছেন। এমনকি অনেকের মতে তিনি ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। বাংলাদেশের বিপক্ষে একদিনের ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক হয়। তিননি শুধুমাত্র গতিময় এবং চতুর ই নয়। তার মধ্যে ক্রিকেটীয় সকল গুনাগুনই দেখা যায়। ক্যাপ্টেন হিসেবে সবসময় ঠান্ডা মাথার বলে তাকে “ক্যাপ্টেন কুল” নামে ডাকা হয়।
উইকেটের পিছনে থেকে তিনি মোট ৭২২* টি ডিসমিসালের সাথে জড়িত। এরমধ্যে টেস্টে ২৫৬ টি ক্যাচ এবং ৩৮ টি স্ট্যাম্পিং এর মাধ্যমে ২৯৪ টি। আর ওডিআই তে ২৬৯* টি ক্যাচ এবং ৯৪* টি স্ট্যাম্পিং এর মাধ্যমে ৩৬৩* টি। এবং টিটুয়েন্টি তে ৪২* টি ক্যাচ ও ২৩* টি স্ট্যাম্পিং এর মাধ্যমে ৬৫* টি। ব্যাটস ম্যান হিসেবে তার মোট রান ১৫৩৬০*। যারমধ্যে টেস্টে ৬ টি সেঞ্চুরির মাধ্যমে ৪৮৭৬ রান এবং ওডিআইতে ১০* টি সেঞ্চুরির মাধ্যমে ৯২৭৫* রান। আর টুয়েন্টি টুয়েন্টিতে ১২০৯* রান।
অধিনায়ক হিসেবে তিনি ভারতের হয়ে প্রায় সবই জিতেছেন। তার অধিনায়কত্বেই ভারতে ওডিআই বিশ্বকাপ, টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে এবং টেস্ট র্যাঙ্কিং এ প্রথম বারের মত ১ নম্বর দল হয়। আইপিএলেও এখনো পর্যন্ত তার অধিনায়কত্বের সেরাটাই দেখা গেছে।
৩) মার্ক বাউচার: মার্ক বাউচার ১৯৭৬ সালের ৩ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্ট লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তার অবসরের পূর্বে তিনিই ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের প্রথম পছন্দ এবং তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বকালের সেরা উইকেট কিপার এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই।
১৯৯৭ সালে শ্রীলংকার সাথে তার টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়। এরপর তিনি টেস্ট এবং ওডিআই খেলে যান ২০১১ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত। উইকেট কিপার হিসেবে তিনি কেমন তা তার রেকর্ড দেখলেই বুঝা যায়। টেস্টে তার ডিসমিসাল সংখ্যা ৫৫৫ টি যা টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ। আবার একদিনের ক্রিকেটে তার ডিসমিসাল সংখ্যা ৪২৫ টি। অর্থাৎ তার পুরো ক্যারিয়ারে উইকেটের পিছনে থেকে ডিসমিসাল সংখ্যা হলো ৯৮০ টি। ব্যাটসম্যান হিসেবেও মার্ক বাউচার ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা মিডল অর্ডারের অন্যতম ভরসা। টেস্টে তিনি ৫ টি সেঞ্চুরির মাধ্যমে করেছেন ৫৫১৫ রান এবং ওডিআই তে ৪৬৮৬ ( ১ টি সেঞ্চুরি )। এছাড়া তার নামের পাশে একটি উইকেটও লেখা আছে।
মার্ক বাউচারের রেকর্ড দেখলেই বুঝা যায় তিনি কত বড় খেলোয়াড় ছিলেন। তকর নামের পাশে আছে মোট ৯৮০ টি ডিসমিসাল এবং ১২০১ রান। তিনি চোখে ইন্জুরির কারনে ২০১২ সালের ১০ জুলাই ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। তার এই অসামান্য খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের কারনেই তিনি আমাদের সেরা উইকেট কীপারের লিস্টে ৩য় স্থান দখন করে নিয়েছেন।
২) কুমার সাঙ্গাকারা: কুমার সাঙ্গাকারা একজন প্রাক্তন শ্রীলংকান প্লেয়ার যার জন্ম ২৭ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে। তিনি পুরো ক্রিকেট বিশ্বেরই অন্যতম সেরা খেলোয়ার। শুধু উইকেটরক্ষক হিসেবেই নয় শ্রীলংকা দলের ব্যাটিং ডিপার্টমেন্টেরও অন্যতম ভরসা ছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৮০১৬ রান নিয়ে শচীন টেন্ডুলকারের পরই তার অবস্থান। আর উইকেট কিপার হিসেবেও তিনি অনেক রেকর্ডের অধিকারী। ৫ জুলাই ২০০০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে একদিনের ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক হয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে (Cricket) উইকেট কিপার হিসেবে তার মোট ডিসমিসাল সংখ্যা ৭৪৮ টি। যার মধ্যে একদিনের ক্রিকেটেই ৪০২ টি ক্যাচ এবং ৯৯ টি স্ট্যাম্পিং নিয়ে মোট ৫০১ টি ডিসমিসাল যা ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ডিসমিসাল। টেস্টে ১৮২ টি ক্যাচ এবং ২০ টি স্ট্যাম্পিং নিয়ে মোট ২০২ টি ডিসমিসাল। আর টি-টুয়েন্টি তে মোট ৪৫ টি ডিসমিসাল যার ২৫ টি ক্যাচ এবং ২০ টি স্ট্যাম্পিং। যদিও ক্যারিয়ারের শেষ দিকে তিনি উইকেটকীপিং করেননি। ব্যাটসম্যান হিসেবে তার পরিসংখ্যান আরো সমৃদ্ধ। টেস্টে ৫৭.৪০ গড়ে তার মোট রান ১২৪০০। টেস্টে তার সর্বোচ্চ রান ৩১৯ এবং সেঞ্চুরি ৩৮ টি। ওডিআই তে ৪১.৯৮ গড়ে ২৫ টি সেঞ্চুরির মাধ্যমে রান ১৪২৩৪। আর টি-টুয়েন্টিতে ৩১.৪০ গড়ে ১৩৮২ রান।
কুমার সাঙ্গাকারা ২০-২৪ আগস্ট ভারতের বিপক্ষে টেস্ট খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহন করেন। অবসরের পর তিনি ২০১৬ টিটুয়েন্টি বিশ্বকাপের দল নির্বাচনের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর তিনি ক্রিকেট অল-স্টার সিরিজ এবং মাস্টার্স চ্যাম্পিয়ন লীগও খেলেন। ক্রিকেটে উইকেটকীপার এবং ব্যাটসম্যান হিসেবে তার অসামান্য রেকর্ডের জন্যই তিনি এই লিস্টে ২য় স্থান দখল করে আছেন।
১) অ্যাডাম গিলক্রিস্ট: অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, প্রাক্তন এই ক্রিকেটার অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস এ জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ছিলেন একজন বিদ্ধংসী বাহাতি ব্যাটসম্যান এবং রেকর্ড-ব্রেকিং উইকেট কিপার। তিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্বও পালন করেছেন। দলগত হিসেবে তিনি অস্ট্রেলিয়া দলের ১৯৯৯ – ২০০৩ – ২০০৭ সালের হ্যাট্রিক বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে।
উইকেট কিপার হিসেবে তার মোট ডিসমিসাল সংখ্যা ৯০৬ টি। যার মধ্যে ওয়ানডে তে ৪১৭ টি ক্যাচ এবং ৫৫ টি স্ট্যাম্পিং করে ৪৭২ টি ডিসমিসাল আর টেস্টে ৩৭৯ টি ক্যাচ এবং ৩৭ টি স্ট্যাম্পিং করে ৪১৬ টি ডিসমিসাল। ব্যাটসম্যান হিসেবে তার মোট রান ১৫১৮৯ রান। যারমধ্যে টেস্টে ১৭ টি সেঞ্চুরির মাধ্যমে ৪৭.৬০ গড়ে ৫৫৭০ রান। এবং ওয়ানডেতে ১৬ টি সেঞ্চুরির মাধ্যমে ৩৫.৮৯ গড়ে ৯৬১৯ রান। প্রথম খেলোয়ার হিসেবে তিনিই টেস্টে ১০০ টি ছয় মেরেছেন।
২৬ জানুয়ারি, ২০০৮ সালে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের ৪র্থ টেস্ট চলাকালীন সময়ে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট (International Cricket) থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। অবসরের পর তিনি ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন। বিভিন্ন চ্যারিটি অনুষ্ঠানে যোগদান করছেন। কোন সন্দেহ নেই তিনি পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ক্রিকেট বিশ্বকে শাষন করেছেন। সত্যিকারের একজন লীজেন্ড। তিনিই আমাদের এই সেরা ৫ উইকেট কীপারের লিস্টে নাম্বার ওয়ান পজিশনে আছেন। সূত্রঃফেক্টসবিডি