নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও বহিরাগত দুর্বৃত্তদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ, লাঠিচার্জে রাজধানীর ধানমন্ডি, সাইন্সল্যাব ও জিগাতলা এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শনিবার (৪ আগস্ট) দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় এসব এলাকায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ অন্তত অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছে। আহতদের কারও কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ঘটনাস্থল থেকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছিল শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যেতে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না বলে আন্দোলন বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকে। দুপুরের দিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দফায় দফায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হেড কোয়ার্টারের গেটের সামনে অবস্থান নেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেয় বিপুল পরিমাণ দাঙ্গা পুলিশ ও সরকার সমর্থিতরা।
এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে দফায় দফায় টিয়ারশেল নিক্ষেপের করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ করতেও দেখা যায়। গোলাগুলির ঘটনা ঘটেও বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।
এর পর সাইন্সল্যাব ও সিটি কলেজের সামনে অবস্থান নিয়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করতে থাকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে জিগাতলায় সংঘর্ষ চলাকালে ৪ শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও ৪ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার কথা শোনা গেলেও বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ধানমন্ডিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। শনিবার বিকেল ৩টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত। এসময় পেশাদার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গণমাধ্যমের কয়েকজন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীকে হামলার মুখে পড়তে হয়। ছবি তোলার দায়ে কারও কারও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ারও অভিযোগ ওঠে।
সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেলের পাশাপাশি এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি ছুড়তে শুরু করে বলেও খবর পাওয়া যায়। এসময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ব্যাপকভাবে সংঘর্ষে অংশ নেয়।
পরে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে শিক্ষার্থীরা ব্রিফ করে জানায়, তারা তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না। অন্যদিকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, শিক্ষার্থীরা যেন ঘরে ফিরে যায়। সরকার তাদের সব দাবি মেনে নিয়েছে। দাবি বাস্তবায়ন না হলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে থাকারও আশ্বাস দেন ছাত্রলীগ নেতারা।
এদিকে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় হতাহতরা পপুলার ডায়গনাইস্টিক সেন্টার, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল ও আশপাশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
অপর দিকে দুর্ঘটনার নামে সহপাঠীদের হত্যার বিচার ও পরিবহন নৈরাজ্যের প্রতিবাদে চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অষ্টম দিনের মত আগামীকাল রবিবারও (৫ আগস্ট) সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা। শনিবার (৪ আগাস্ট) বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ ঘোষণা দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
গত রবিবার (২৯ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর হোটেল র্যাডিসনের বিপরীত পাশের জিল্লুর রহমান উড়ালসড়কের ঢালের সামনের রাস্তার ওপর জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম ওরফে রাজীব (১৭) ও দিয়া খানম ওরফে মীম (১৬) নিহত হয়। আহত হয় আরও ১৩ শিক্ষার্থী।
ওই দিন বিকেলেই রাজধানীর দু-একটি পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। রাতে নিহত মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৩৩।
পরদিন সোমবার নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহাজান খান গণমাধ্যমের সামনে এ নিয়ে হাস্যরসাত্মক মন্তব্য করলে ফুঁসে ওঠে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা।
এরই ধারাবাহিকতায় নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতসহ ৯ দফা দাবিতে শনিবার টানা সপ্তম দিনের মতো রাজধানীকে অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা।
এরই মধ্যে গত বুধবার জাবালে নূর পরিবহনের ঘাতক বাসটির চালক মাসুম বিল্লাহকে ৭ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। একইসঙ্গে বাতিল করা হয়েছে জাবালে নূর পরিবহনের রুট পারমিট ও নিবন্ধন। বৃহস্পতিবার জাবালে নূরের মালিক শাহাদৎ হোসেনকেও ৭ দিনের রিমান্ডে দিয়েছে আদালত। বুধবার বিকেলে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব সদস্যরা।