গত ৮ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ইসি সচিব হেলাল উদ্দীন আহমদ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বলেছেন, ‘তফসিল ঘোষণার আগে তিনি পরিকল্পনা কমিশনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন। হেলাল উদ্দীনের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন নিরাপত্তা বিভাগের সচিব চট্টগ্রামের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারদের ডেকে গত ১৬ নভেম্বর বৈঠক করেছেন। পরবর্তীতে ২০ নভেম্বর চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার, তার এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ডেকে সরকারের পক্ষে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব ঘটনায় নির্বাচনী আইনের প্রতি তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা ইসি সচিবের ভয়ে তটস্থ। সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী দক্ষ ও নিরপেক্ষদের বদলি করে নির্বাচন ভবনটি তিনি আওয়ামীপন্থী ক্যাডারদের দিয়ে সাজিয়েছেন।’
সোমবার (২৬ নভেম্বর) নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রিজভী বলেছেন, ‘বিশেষ সুবিধাভোগী হেলাল উদ্দীন আহমদ ২০১৭ সালের ৩০ জুলাইয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যোগদান করে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পূর্ণ সচিব পদে সরকার তাকে পদোন্নতি দেয়। অথচ ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি জেলা প্রশাসক ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে তাকে নির্বাচন কমিশনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সরকার সচিব হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমদের একান্ত সচিব ছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগপন্থি আমলা হিসাবে তার পরিচিতি ব্যাপক। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি। প্রশাসনের ভেতরে সরকারের প্রভাবশালী একজন আমলা। প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তার ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রশংসামূলক পোস্ট দেয়া আছে। এসবে প্রমাণিত হয় তিনি নিরপেক্ষ নন, চরম দলবাজ এবং আওয়ামী লীগের অন্ধ অনুসারী।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘এ ধরনের চিহ্নিত, দলবাজ ও সরকারের চরম সুবিধাভোগী ইসি সচিব স্ব-পদে বহাল থাকলে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ইসি সচিবের বিরুদ্ধে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দাখিল করলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অবিলম্বে ইসি সচিবকে প্রত্যাহার করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের জন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হোক। দল নিরপেক্ষ এবং চৌকস কাউকে দ্রুত হেলাল উদ্দীনের স্থলে নিয়োগ দেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষায় কথা বলে আসছেন ইসি সচিব হেলাল উদ্দীন সাহেব, দ্রুত দলবাজ ইসি সচিবকে নির্বাচন কমিশন থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। কারণ আওয়ামী লীগ নেতারদের বক্তব্যের সাথে সুর মিলিয়ে বিরামহীন রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একতরফা ও নীলনকশার পাতানো নির্বাচনের মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন ইসি সচিব। সরকার পরিকল্পিতভাবে সাজানো ভোটারবিহীন আরেকটি নির্বাচন করার জন্য দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে নির্বাচন কমিশনে হেলাল উদ্দীন সাহেবকে নিয়োগ দিয়েছে। ইসি সচিব মুলত: নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করছে। বাকী পাঁচ সদস্যের কমিশনারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে জোরে সোরে তোড়জোড় চালাচ্ছেন তিনি।’
রিজভী বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাগ্নে (আপন বোনের ছেলে) এস এম শাহজাদা সাজু। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে গতকাল তিনি চিঠি পান। সেখানে আওয়ামী লীগের আর এক মনোনয়ন প্রত্যাশী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেনে-আমাকে মনোনয়ন না দেবার কারণ একটি, সেটি হলো শাহজাদা সিইসির ভাগ্নে। সিইসিকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজে লাগানোর জন্যই তার ভাগ্নেকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে। সাজুকে মনোনয়ন দেয়া সরকার কর্তৃক সিইসিকে ভেট দেয়ার একটি পরিষ্কার উদাহরণ। আমরা মনে করি-এই মনোনয়ন সিইসির জন্য স্বার্থের সংঘর্ষের একটি সুষ্পষ্ট ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যার কারণে সিইসি স্বীয় পদে অব্যাহত থাকার নৈতিক অধিকার সম্পূর্ণভাবে হারিয়েছেন। তার পক্ষে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে আওয়ামী লীগের অঘোষিত নেতা তা তার কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত। সিইসি নির্বাচন কমিশনের প্রধান হওয়ার কারণে নিজে নৌকায় না উঠে ভাগ্নেকে নৌকার মাঝি করলেন।’
‘এ প্রসঙ্গে প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সততা, নিরপেক্ষতার অনন্য দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য, যার তুলনা বর্তমানে নেই বললেই চলে। নিশ্চয়ই আপনাদের স্মরণে আছে-২০০১ সালের নির্বাচনে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মূখ্য সচিব ডক্টর শাহ মোহাম্মদ ফরিদ স্বেচ্ছায় মুখ্য সচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন-যাতে স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন কোনভাবেই উঠতে না পারে। কারণ সেই নির্বাচনে তার ভাই বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন। যদিও তিনি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন না। তবু তিনি পদত্যাগ করে এক অসাধারণ নজীর স্থাপন করেছিলেন। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার সেই দায়-দায়িত্ব থেকে অনেক দুরে অবস্থান করেন। আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি যে, ভাগ্নে সাজুর মনোনয়নের প্রেক্ষিতে সিইসি অনুরুপ উচ্চ নৈতিক মান প্রদর্শন করে অবিলম্বে স্বীয় পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি যে, ফেনীসহ কিছু কিছু জেলার পুলিশ সুপাররা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) ডেকে নিয়ে সভা করে তাদেরকে সরকারের পক্ষে কাজ করার চাপ দিচ্ছেন এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানির বিষয়ে ব্রিফ করছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সুকোমল বড়ুয়া, একরামুজ্জামান, যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সহ-দফতর সম্পাদক মুনির হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।