আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে নিজ নিজ এলাকায় লাগামহীন দৌড়ঝাঁপ করেছেন প্রতিটি দলের একাধিক প্রার্থী। প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে বিভিন্ন আসনের বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের পাশাপাশি সব শ্রেণির নেতারা গেল ক’দিন দিনরাত মাঠে সরব ছিলেন। দলীয় কর্মসূচির পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছেন তারা।
অবশেষে চট্টগ্রামে সরকার দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে কিছুদিন ধরে চলমান প্রতিযোগিতার ইতি টেনেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের চূড়ান্ত মনোনয়নের চিঠি দেয়া শুরু হয়।
দলের দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ প্রার্থীদের হাতে এই চিঠি তুলে দেন। এর আগে গত ১০ দিনে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয় থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে এবার তেমন পরিবর্তন আসছে না। তবে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বড় ছেলে এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রথমবারের মত চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে।
এছাড়া গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচত সংসদ সদস্যরাই চট্টগ্রামে এবার নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
চট্টগ্রামের ১৬ টি সংসদীয় আসনের মধ্যে জাতীয় পার্টিকে চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী), তরিকত ফেডারেশনকে চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি), জাসদ একাংশের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মঈনুদ্দিন খান বাদলকে চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আংশিক) আসনটি ছেড়ে দেয়ার এরইমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রামের যেসব আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের জন্য মনোনীত হয়ে চিঠি পেয়েছেন তাদের মধ্যে চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই), চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ), চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড), চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান), চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনীয়া), চট্টগ্রাম-৯ কোতোয়ালি), চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) ও চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) ও চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া) আসনে মনোনীত প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী টিকেট পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
চট্টগ্রাম-১ মিরসরাই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন : চট্টগ্রাম-১ সংসদীয় আসন হলো বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ২৭৮নং আসন। মিরসরাই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা নিয়ে এটি গঠিত। যেখানে নির্মিত হচ্ছে এশিয়ার বৃহত্তম শিল্প পার্ক মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল। দেশের লাইফ লাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ২৮ কিলোমিটার অংশ পড়েছে মিরসরাইয়ে। মিরসরাইয়ে বর্তমানে দুই লাখ ৭৩ হাজার ৫৬ ভোটারের মন পেতে এবারো এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে মনোনীত হয়েছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী এম এ জিন্নাহর কাছে হেরে যায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। ১৯৯৬ সালে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ আসনে প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন। পরে উপ-নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী এম এ জিন্নাহকে পরাজিত করে আসনটি আওয়ামী লীগকে উপহার দেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির এম এ জিন্নাহ পুনরায় এমপি নির্বাচিত হন।
২০০৪ সালে তিনি বিএনপি ছেড়ে এলডিপিতে যোগ দিলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হন প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী। ওই নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ১ লাখ ৫ হাজার ৩৩৯ ভোট পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন। নিকটতম ধানের শীষের প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী পেয়েছিলেন ৯৪ হাজার ৬৬৫ ভোট।
২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ এমপি নির্বাচিত হয়ে বর্তমানে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে মাহফুজুর রহমান মিতা : আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনের নৌকার মাঝি হতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মাহফুজুর রহমান মিতা। গত রবিবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তাকে চূড়ান্ত মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে।
দশম জাতীয় সংসদে মাহফুজুর রহমান মিতা সন্দ্বীপের সাংসদ ছিলেন। মাহফুজুর রহমান মিতা আধুনিক সন্দ্বীপের রূপকার সাবেক সাংসদ প্রয়াত দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমানের সন্তান। প্রয়াত দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমানএলাকায় জনপ্রিয়। তিনি ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে সন্দ্বীপ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা জামাল উদ্দিন চৌধুরী। বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন মাহফুজুর রহমান মিতা।
আওয়ামী লীগে দু’জন প্রার্থী থাকায় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মোস্তফা কামাল পাশা জয়ী হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন মাহফুজুর রহমান মিতা।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) মো. দিদারুল আলম : চট্টগ্রাম -৪ সংসদীয় আসন হল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ৩০০ টি নির্বাচনী এলাকার একটি। এটি চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত জাতীয় সংসদের ২৮১ নং আসন। এ আসনটি চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ৯ ও ১০ নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত।
এ আসনটি নিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থী ও নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই নানান আলোচনার ঝড় উঠে। অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এ আসনে নির্বাচনের জন্য মনোনীত প্রার্থীর চিঠি পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মো. দিদারুল আলম। তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দিদারুল আলম ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮১৫টি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জাসদ থেকে মফিজুর রহমান ভোট পেয়েছিলেন ৪ হাজার ৪২ টি ভোট। এ আসনে এর আগে দু’বার বিএনপি এবং চার বার আওয়ামী লীগের প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম-৬ আসন এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী : আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও চট্টগ্রাম-৬ আসনটি নিজেদের দখলে রাখতে মরিয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ফলে টানা তিনবারের সাংসদ এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর ওপর আবারও আস্থা রাখলেন দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নৌকা প্রতীকে এবারও নির্বাচনের জন্য মনোনীত প্রার্থীর চিঠি পেয়েছেন তিনি।
চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) ড. হাছান মাহমুদ : চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া এলাকায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আওয়ামী লীগ থেকে ফের মনোনয়ের চিঠি পেয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ও সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্ধী বিএনপি প্রার্থী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে প্রায় ৪০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এর আগে ১৯৯১ সাল থেকে টানা তিন নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হন।
চট্টগ্রাম- ৯ (কোতোয়ালি) আসনে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল : চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি) গুরুত্বপূর্ণ ও ভিআইপি আসন হিসেবে বিবেচিত। এ আসন থেকে যে দলের প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হন, ওই দলই সরকার গঠন করে। গত ৫টি সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস এমনটিই বলছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের জন্য মনোনীত প্রার্থীর চিঠি পেয়েছেন ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি এবারই প্রথম সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করছেন।
নওফেল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) মো. সামশুল হক চৌধুরী : চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী শিক্ষা ও ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ পটিয়া উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম-১২ আসন। এ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের জন্য মনোনীত প্রার্থীর চিঠি পেয়েছেন শামসুল হক চৌধুরী।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে পর পর দু’বার নির্বাচিত এমপি শামসুল হক চৌধুরী। ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবেই খুব পরিচিত ছিল। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হলে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মো. সামশুল হক চৌধুরী।
চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ : চট্টগ্রামের শাহ আমানত-আনোয়ারা সেতুর দক্ষিণে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম ১৩ আসন। এ আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার মাঝি হিসেবে নির্বাচন করতে ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী মনোনীত প্রার্থীর চিঠি পেয়েছেন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বিএনপির সরওয়ার জামাল নিজামকে হারিয়ে এমপি হন। ওই নির্বাচনে বাবু ১ লাখ ১০ হাজার ৯৫১ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি সরওয়ার জামাল পান ৮৬ হাজার ৭৫১ ভোট।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া) আসন থেকে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম। এছাড়া চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকার মাঝি হচ্ছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী।