একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় আসার আকাঙ্ক্ষা নেই আমার নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে সুন্দর শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ আছে। সকলেই যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশটা বজায় রাখে। এখানে জনগণ ভোট দেবে, যাকে দেবে তারাই ক্ষমতায় আসবে। আমার এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, যেনতেনভাবে ক্ষমতায় আসতে হবে। দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিক। ভোট দিয়ে তারা তার সরকার পছন্দ করে নিক।’
সম্মেলনে বাংলাদেশে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা ও শিল্পপতিরা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চান এবং নৌকার বিজয়ে পাশে থাকার সাহস ও শক্তি দেন।
প্রধানমন্ত্রী সরকারের টানা মেয়াদে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এই বিদ্যুৎ কিন্তু কখনো বেসরকারি খাতে ছিল না। কেবলমাত্র সরকারি খাত থেকে উৎপাদন হতো। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর আইন করে এটা বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দেই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যারা শিল্পমালিক তাদেরকেও অনুমোদন দিয়ে দেই। তারা দশ-বিশ-ত্রিশ মেগাওয়াট যাই পারেন ক্যাপটিভ জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নিজের ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার করাসহ পাশে বিক্রি করতে পারবে। আমরা এই সুযোগ করে দিই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মনে করি ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না। আর সব কাজ সরকার একা করবে না। একা করতে পারে না। সরকারের হাতে কিছু থাকবে, যাতে অর্থনৈতিক অবস্থাটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং একটা সুস্থ পরিবেশ রাখতে পারে। কিন্তু মূল ব্যবসাটা করবে বেসরকারি খাত। তাই যখনই আমরা সরকারে এসেছি বেসরকারি খাতের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আমরা ব্যবসা করতে আসিনি কিন্তু ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা করবার মতো পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া এটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।’
তিনি বলেন, ‘গতকাল আমরা যে নির্বাচনী ইশতেহারটা দিয়েছি আমরা কিন্তু সেই রাজনৈতিক দল এই উপমহাদেশে, আমরা আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার একবার ঘোষণা দিয়ে ফেলে দেই না। এই ইশতেহারটা আমাদের সঙ্গে থাকে। সেই সঙ্গে যখনই কোনো প্রজেক্ট নেই বা বাজেট করি; তখন এই বাজেট করার সময় প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়েই নির্বাচনী ইশতেহারের একটা কপি দিয়ে দেই। কারণ আমরা যে ওয়াদা দিয়েছি সেই ওয়াদা আমরা পূরণ করতে চাই। যদি সুযোগ হয় তার চেয়েও বেশি করি।’
জনগণের উন্নয়নের কল্যাণে কঠোর পরিশ্রম করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করে আপনি সারাদিনরাত এত কঠোর পরিশ্রম করেন কেন? আমার একটাই কথা। আমার বাবা এ দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে তিনি হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেটা করে যেতে পারেন নাই। তাই তার সেই অসমাপ্ত কাজটা সম্পন্ন করা এটা আমি আমার দায়িত্ব হিসাবে নিয়েছি, কর্তব্য হিসাবে নিয়েছি।’
‘ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখেছে। তারা তাদের মতো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চলবে। তাদের জন্য কী রাখতে হবে, না রাখতে হবে ওই চিন্তা কখনো আমি করি না। আমি চিন্তা করি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কী রেখে গেলাম, কী করে গেলাম, কতটুকু করতে পারব। ভবিষ্যতের জন্য কী করব, যেন সকলের ছেলেমেয়েই আগামীতে সুন্দর জীবন পায়। সেটাই আমি চিন্তা করি। যেভাবেই আমাদের সকল কর্মকাণ্ড সকল পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। যে স্বপ্নটা নিয়ে আমার বাবা দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই স্বপ্নটাই আমরা পূরণ করতে চাই।
সামনে সরকারের অনেক পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘জাতির পিতা একটা কথা বলতেন বাংলাদেশকে তিনি গড়ে তুলবেন প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে।’
এ বিষয়ে শেখ হাসিনা ভৌগোলিকগতভাবে সুইজারল্যান্ডের অবস্থান ও সুবিধার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘ইউরোপের একদিক থেকে আরেকদিকে যেতে হলে কিন্তু ওই সুইজারল্যান্ডকে ব্যবহার করতে হয়। সুইজারল্যান্ড একটি শান্তিপূর্ণ দেশ। তিনিও বাংলাদেশটাকেও সেইভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যাতে প্রাশ্চ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন করতে পারে বাংলাদেশ। তার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন। সেই উন্নয়নের কাজ হাতে নিয়েছি।’
এছাড়াও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একটা যোগাযোগ এবং সদ্ভাব সেটাও আমরা খুব সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছি বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা কিন্তু প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করতে যাইনি। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান করার প্রচেষ্টা নিয়েছি এবং একটা এগ্রিমেন্টেও সই করেছি। ঠিক সেইভাবে সমুদ্রসীমা, স্থলসামীনাসহ যে সমস্ত জায়গায় এতটুকু জটিলতা ছিল সেটা আমরা সমাধান করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেই সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-মাদক এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান এটা অব্যাহত রাখব। যাতে আমাদের সমাজে শান্তি ফিরে আসে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস থাকলে কোন দেশ উন্নতি করতে পারে না। কাজেই আমরা দেশে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থান থাকুক। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন। আমি অনেক কিছু সহ্য করেও সকলের সঙ্গে বসে, কথা বলেছি। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেছি।’
‘আলোচনা করে সবাইকে বলেছি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে। আমরা চাই নির্বাচনটা শান্তিপূর্ণ হোক। আপনাদের কাছ থেকে একটা সহযোগিতা চাই, আজকে একটা সুন্দর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আছে এবং অনেকগুলি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। সকলেই যেন একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রেখেই নির্বাচনটা যাতে হয়, সেই পরিবেশটা যেন বজায় রাখে। এখানে জনগণ ভোট দেবে, যাকে দেবে তারাই ক্ষমতায় আসবে। আমার এমন কোন আকাঙ্ক্ষা নেই, যেনতেনভাবে ক্ষমতায় আসতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যদি ক্ষমতায় আসতে পারি আলহামদুল্লাহ। যদি না পারি কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু দেশের শান্তি বজায় থাকুক। দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিক। ভোট দিয়ে তারা তার সরকার পছন্দ করে নিক। সেই পরিবেশটা বজায় থাকুক। আমি সেটাই চাই। কারণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলে দেশটা এগিয়ে যাবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারপরও আমি বলব, আজকে এতগুলি কাজ হাতে নিয়েছি এবং অনেকগুলি দাবিও এখানে করেছেন। আমরা কিন্তু কোনোদিকটা বাদ রাখিনি। সবদিক কোনদিকটা বাদ রাখিনি। সবদিকে কিন্তু আমরা উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছি।’
মেগাপ্রজেক্টসহ আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রকল্প ও গৃহীত পদক্ষেপগুলোর প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, যে কাজগুলি আমরা করে যাচ্ছি, দরিদ্র বিমোচনের যে কর্মসূচি নিয়েছি, সেটা যেন বাস্তবায়ন করতে পারি। আপনাদের জন্য ব্যবসাবান্ধব একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছি, অন্তত এখন তো এইটুকু বলতে পারবেন না, কেউ হাওয়া ভবন খুলে সব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে থাবাথাবি করছে; কিছু করতে গেলেই ভাগ দিতে হবে। অন্তত আমরা সেটা করি না। করবো না, এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবে। সরকার হিসাবে দায়িত্ব পরিবেশ সৃষ্টি করা। ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা।
সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা আরও বলেন, খুব পরিকল্পিতভাবেই আমাদের পরিকল্পনা আমরা নিয়েছি। এগুলো বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তার জন্য অবশ্যই আপনাদের কাছে সহযোগিতা চাইবো।
তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বর নৌকা মার্কায় ভোট চাই। যেন উন্নয়নের ধারাটা অব্যাহত রাখতে পারি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবো; এই সুযোগটা আমি দেশবাসীর কাছে চাই, আপনাদের কাছে চাই।
‘যারা এখানে উপস্থিত বা যারা আসতে পারেননি তাদেরকেও আমি এই আবেদনই জানাবো, অন্তত নৌকা মার্কায় আমাকে ভোট দিয়ে আরেকবার সুযোগ দিন আপনাদের সেবা করার। আমার উন্নয়নের কাজগুলি যেন আমি সম্পন্ন করতে পারি। যদিও এর শেষ নাই। উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। তারপরও যে কাজগুলি হাতে নিয়েছি, সেটা যেন আমরা পালন করতে পারি। বাংলাদেশকে আজকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করেছি। এখন দেশে বিদেশে যেখানেই যান বাঙালি জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে যে সম্মানটা পাচ্ছেন সেটা যেন অব্যাহত থাকে, সেটাই আমি চাই।
এরপর বিকেলে তিনটায় সুধাসদন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের চারটি জেলায় নির্বাচনী জনসভায় যোগ দেওয়ার তাড়ার কথা উল্লেখ কওে দ্রুত বক্তব্য শেষ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইসিসির সভাপতি মাহবুবুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির, এমসিসিআইয়ের সভাপতি নিহাত কবীর, সাবেক সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমান, প্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকেল ফোলি, মাইক্রোসফট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সোনিয়া বশীর কবির সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান।
এছাড়া আরও বক্তব্য দেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, বিএসআরএম স্টিলের চেয়ারম্যান আলী হুসেন আকবর আলী, বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ, এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুপালী চৌধুরী, মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক, বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীরসহ অন্যরা।