চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন তিনি প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওই বছরের ১২ জুনের সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।
পরে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে জটিলতা সৃষ্টি করলে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। প্রায় ২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী এই দলটি সামনে যে সরকার গঠন করবে তাতেও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ফলে টানা তিনবার এবং চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। এর আগে বাংলাদেশে কেউ চারবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেননি।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মজীবন প্রায় চার দশকের। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ৩টি সংসদীয় আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে নব্বইয়ের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং এই আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালের সংসদীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলসহ সকলকে সংগঠিত করেন।
২০০৯ সালে সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব নেয়ার পর তাঁর সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় স্থাপিত ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে এবং রায় কার্যকর করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৫ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শেখ হাসিনা। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি এই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি ছিলেন। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই শেখ হাসিনা সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা সেসময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। পরে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে ৬ বছর ভারতে অবস্থান করেন।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পরপরই তিনি শাসকগোষ্ঠির রোষানলে পড়েন। তাঁকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাঁকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাঁকে দু’বার গৃহবন্দী করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২রা মার্চ তাঁকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দী হন। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে আবারও অন্তরীণ হতে হয়। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায়। প্রায় ১ বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তি পান।
শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়। এর মধ্যে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাঁকে লক্ষ করে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে যুবলীগ নেতা নূর হোসেন, বাবুল ও ফাত্তাহ নিহত হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁকেসহ তাঁর গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে তাকে লক্ষ্য করে পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিহত হন। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাঁকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তাঁর কামরা লক্ষ করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুতে রাখা হয়।
বিএনপি সরকারের সময় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট। ঐদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাঁকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা করা হয়। ইতিহাসের ভয়ংকর ও লোমহর্ষক সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ তাঁর দলের ২২ নেতাকর্মী নিহত হন এবং ৫’শর বেশি মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে আঘাত পান।
শত বাধা-বিপত্তি এবং হত্যার হুমকিসহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ভাত-ভোট এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। সামাজিক কর্মকান্ড, শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য শেখ হাসিনাকে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা সম্মানিত করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসানের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো তাঁকে হুপে-বোয়ানি (Houphouet-Boigny) শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনাকে সম্মানজনক ‘সেরেস’ (CERES) মেডেল প্রদান করে। এছাড়া, ২০১৪ সালে ইউনেসকো তাঁকে ’শান্তির বৃক্ষ’ এবং ২০১৫ সালে উইমেন ইন পার্লামেন্টস গ্লোবাল ফোরাম নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাঁকে রিজিওনাল লিডারশীপ পুরস্কার এবং গ্লোবাল সাউথ-সাউথ ডেভলপমেন্ট এক্সপো-২০১৪ ভিশনারি পুরস্কারে ভূষিত করে। জাতিসংঘ পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ এবং টেকসই উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য লিডারশীপ ক্যাটাগরিতে শেখ হাসিনাকে তাদের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ-২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এছাড়া, টেকসই ডিজিটাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য International Telecommunication Union (ITU) শেখ হাসিনাকে ICTs in Sustainable Development Award-২০১৫ প্রদান করে।