কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক অবনতি ঘটেছে বলে অভিযোগ করে দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘তিনি ঘাড়-মাথা সোজা রাখতে পারছেন না। সোজা হলেই আবার হেলে পড়ছে। কয়েক বছর আগে অপারেশন করা চোখ এবং হাঁটুর ব্যাথা ক্রমশ: বৃদ্ধির ফলে কষ্টে কাতরাচ্ছেন ‘গণতন্ত্রের মা’।’
তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক অবনতি ঘটেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে তাঁর জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ গুরুতর অসুস্থতার কথা জাতির সামনে বারবার তুলে ধরা হয়েছে। অথচ বেগম জিয়ার চিকিৎসা হয়েছে তাঁর ইচ্ছের বাইরে নামকাওয়াস্তে।’
রবিবার (২৮ জুলাই) নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘গতকালও সেতুমন্ত্রী বেগম জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু গতকালই গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তীব্র ব্যথা নিয়ে দাঁতের চিকিৎসা নিতে হয়েছে দেশনেত্রীকে। সেখানে ২০ মিনিট বসিয়ে রেখে কী চিকিৎসা করা হয়েছে আমরা জানি না। কিন্তু গণমাধ্যমে আমরা বেগম জিয়ার যে ছবি দেখেছি সেটি ছিল তীব্র ব্যথায় যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছবি।’
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কথা তুলে ধরে রিজভী আরও বলেন, ‘চার দেয়ালের মধ্যে কারারুদ্ধ অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় দেশনেত্রীর ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এখন তাঁর অবস্থা জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ের মধ্যে। ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন ব্লাডসুগার। জিহ্বার আলসারের কারণে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, যা দিনকে দিন আরও গুরুতর হচ্ছে। ফলে তিনি কিছুই খেতে পারছেন না। আর্থ্রাইটিস ও ফ্রোজেন শোল্ডার সমস্যার কারণে স্বাস্থ্যের আরও গুরুতর অবনতি ঘটছে।’
তিনি বলেন, ‘গতকাল শনিবার দেশনেত্রীকে যখন পিজি হাসপাতালের কেবিন ব্লক থেকে হুইল চেয়ার থেকে নামিয়ে গাড়িতে তোলা হচ্ছিল তখন দুজনে ধরেও তাঁকে দাঁড় করাতে পারে নি। কষ্টে কাতরাচ্ছিলেন তিনি। হুইল চেয়ারেও বসতে পারছিলেন না, কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। টেলিভিশনের পর্দায় দেশনেত্রীর এই ভয়ংকর অসুস্থতার দৃশ্য দেখার পর অশ্রুশিক্ত হয়েছেন অগণিত মানুষ। আর দেশনেত্রীর এহেন অসুস্থতায় আওয়ামী নেতাদের বক্তব্যে আনন্দ ঝরে পড়ছে। বিএসএমএমইউ’র পক্ষ থেকে সরকারি বার্তাই জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তবে বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ, তাঁর উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন, কিন্তু সরকার সেটি অগ্রাহ্য করছে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সমালোচনা করে রিজভী বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন- ‘খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে বিএনপি অপপ্রচার করছে। গল্পের রাখাল বালকের মতো খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি আর অবনতি। অথচ ডাক্তাররা বলেন তিনি ভালো আছেন’। তার বক্তৃতার ৩ ঘণ্টা পর একই কথা হুবহু শোনা গেল বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের মুখেও।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘মধ্যরাতের নির্বাচনে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে সরকার গঠন করে মন্ত্রীরা ক্ষমতার মধুভাণ্ডার যাতে হাতছাড়া না হয়, এজন্য গুরুতর অসুস্থ দেশনেত্রীর শারিরীক অসুস্থতা নিয়ে উপহাস করছেন, অবজ্ঞা আর মিথ্যাচার করছেন। অথচ কয়েক মাস আগেও পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে- সেতুমন্ত্রী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয়ে সিঙ্গাপুর থেকে তাঁর চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আনা হয়েছিল। তিনি ফলোআপ চিকিৎসার জন্য নিয়ম করে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। আমরা কোনদিন তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে উপহাস তো করিনি! তার দলের প্রধান শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে বিদেশে নিয়ে যাবেন না, এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তুলবেন না, দেশেই আমার চিকিৎসা করাবেন’।
গত ১৯ এপ্রিল শের-ই-বাংলা নগরের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের মতো ১০ টাকায় টিকিট কেটে চিকিৎসা নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর প্রধানমন্ত্রী চক্ষু চিকিৎসার জন্য দুই দফা লম্বা ছুটি নিয়ে সূদুর লন্ডন গেলেন। এখন তিনি দ্বিতীয় দফায় লন্ডনে, সেটিও নাকি চিকিৎসার জন্য। মানুষ এত দ্রুত কী করে তাঁর অবস্থান পাল্টাতে পারে! তিনি যা বলেন করেন তার উল্টো।’
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি বিএনপি এবং গোটা দেশবাসীর পক্ষ থেকে জোর দারি জানাচ্ছি, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দ্রুত মুক্তি দিয়ে তাঁর পছন্দ অনুযায়ী বিশেষায়িত কোনও হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দেয়া হোক। তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। তাঁকে বাঁচতে দিন। দেড় বছর তো বিনা অপরাধে সাজা খাটালেন। এবার প্রতিহংসা-ঈর্ষা বন্ধ করুন। তাঁকে মুক্তি দিয়ে বন্যা-ডেঙ্গু মোকাবিলার চেষ্টা করুন।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ এই রাতের অন্ধকারের সরকার ক্ষমতা হারানোর ভয়ে প্রলাপ বকছে। বর্তমানে যেকোন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় গুজব। সরকার ডেঙ্গু দমনে ব্যর্থ হয়ে ছেলেধরা গুজবের মতো ডেঙ্গু জ্বরকেও গুজব বলছে। ডেঙ্গুতে মানুষ মরছে, মরছে চিকিৎসক, মরছে শিশুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা। এ পর্যন্ত সিভিল সার্জনসহ কয়েকজন ডাক্তার মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। আর সরকারি দলের নেতাসহ মেয়ররা জনগণকে ধমক দিচ্ছেন আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার।’
রিজভী বলেন, ‘গতকাল ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস নাকি একটা গুজবের ফ্যাক্টরি। আমি উনার কাছে জানতে চাই- গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলা, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা জাতির সামনে তুলে ধরা, সরকারের লুটপাট ও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা, শেয়ারবাজার লুট নিয়ে কথা বলা, ‘গত ৬ মাসে শেয়ার বাজার থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা মূলধন উধাও নিয়ে কথা বলা, ব্যাংক লুটের কথা বলা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলা, বিরোধী দলের ওপর সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলা, গুম-খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলা, নারী-শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলাই কি গুজব?’
পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে রিজভী বলেন, ‘সেতুমন্ত্রীর ভাষায় দুর্নীতির উন্নয়নের পালকি এগিয়ে যাওয়ার কথাই কি শুধু বলতে হবে? গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে দেশে আইয়ুব খান মডেলের উন্নয়নেরই জয়গানই কি গাইতে হবে? মনে হয় তাহলেই সেতুমন্ত্রীরা খুশি থাকবেন। তবে যে বাতাবরণটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবর্তিত হচ্ছে তাতে শত জুলুমের মুখেও বিএনপি সত্য উচ্চারণ করে যাবে। বিদ্যমান চারিদিকের ভয়ঙ্কর অরাজকতা দূর করতে জনগণের প্রলয় সৃষ্টি হবেই। আর আপনারা অন্ধ হলেও সেই প্রলয় বন্ধ হবে না। এই ভয়ঙ্কর নাৎসি শাসনের অমানিশার মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিই কেবলমাত্র জনগণের আশা-ভরসার উদিত একটি আলোকবিন্দু।’
সংবাদ সম্মেলনে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড.সুকোমল বড়ুয়া, সিরাজুল ইসলাম, সহ-দফতর সম্পাদক মো. মুনির হোসেন, নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মাদ রহমাতুল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।