দল বদলে আওয়ামী লীগে এসেছিলেন আরিফ হোসেন ছোটন। সাধারণ ক্ষমায় তার দণ্ডাদেশ মওকুফ করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। কিন্তু ক্ষমা পেয়েই পুরোনো চেহারায় দেখা দিয়েছেন তিনি। গত দুই দশকে তিনি এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন যে, এলাকায় তার চেয়ে বড় নেতারাও তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পান।
আরিফ হোসেন বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সভাপতিও। তবে তার উত্থান ঘটে জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রসমাজের মহানগর দক্ষিণের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল নাগাদ ছোটনের বিরুদ্ধে খুন-অস্ত্রবাজি-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগের ৩২টি মামলা ছিল। অস্ত্র ও চাঁদাবাজির একটি মামলায় তার সাত বছরের কারাদণ্ডও হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালের দিকে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এর পর তার সব মামলা একে একে প্রত্যাহার হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমার আওতায় মওকুফ হয় সাত বছরের দণ্ডাদেশ।
আরিফ হোসেন ছোটনের বিরুদ্ধে অভিযোগ- বাড়ি ও মার্কেট দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততা, হেরিটেজখ্যাত লালকুঠির জায়গায় অবৈধ দোকান নির্মাণ, বাংলাবাজারের প্রকাশকদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া, পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সভাপতির পদ দখলে রাখাসহ নানা অপরাধমূলক কাজ অব্যাহত রেখেছেন তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জানাচ্ছেন, ছাত্রসমাজের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময় নর্থব্রুক হল রোডে একজন মোটর পার্টস ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদাবাজির ঘটনায় গোলাগুলি হয়। তখন একজন এএসপিসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় ছোটনসহ ছয়জন গ্রেপ্তার হন। মামলায় ছোটনকে সাত বছর কারাদণ্ড দেন আদালত, যা পরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দেন।
বাংলাবাজারের একাধিক প্রকাশক জানান, এরশাদ আমলে আলমগীর শিকদার লোটন যখন ছাত্রসমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, তখন ছোটনের ভাই সারোয়ার হোসেন টিটো ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। তখন আরিফ হোসেন ছোটনকে ভোট ছাড়াই পুস্তক প্রকাশনা সমিতির ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক বানান লোটন ও টিটো। এ ঘটনায় শহিদ নামে একজন প্রতিবাদ করেন। কিছুদিন পরই আততায়ীর গুলিতে মারা যান তিনি। তখন প্রকাশকদের মুখে-মুখে এ খুনের ঘটনায় ছোটনের নাম আসে। অভিযোগ রয়েছে, সময়ের পরিক্রমায় আরিফ হোসেন ছোটন গত প্রায় পাঁচ বছর আগে ভোটারবিহীন এক নির্বাচনে পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সভাপতি হন। সমিতির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভোটের মাধ্যমে পরপর দুই দফায় সর্বোচ্চ চার বছর পদে থাকার বিধান থাকলেও তিনি সেটা মানছেন না। এ নিয়ে কোনো প্রকাশক প্রতিবাদ করলে তার দোকানে তালা মেরে দেয় ছোটনের লোকজন। তার অনুসারীদের অত্যাচারের কারণে একুশে প্রকাশনীর মিজানসহ বেশ কয়েকজন বাংলাবাজার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া প্রকাশকদের তার কাছ থেকে কাগজ কিনতে বাধ্য করা ও জামায়াত-শিবিরপন্থি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
সরেজমিন ঐতিহ্যবাহী লালকুঠির পেছনে গিয়ে দেখা যায়, কুঠির জায়গায় বেশ কয়েকটি দোকান বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এসব দোকানের পজিশন বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা ছোটন নিয়েছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। দোকানগুলো নির্মাণে সম্পৃক্ত ছিলেন ছোটনের ভাই আজাদ, নাকা বাবু, ভাস্কর ও বিএনপি জাহাঙ্গীর।
স্থানীয়রা জানান, ফরাশগঞ্জ রোডে কাশ্মীরি হাউস নামে একটি বিলেতি মদের দোকান ছিল। ছোটন কাউন্সিলর হয়ে সেই দোকানটা তুলে দেন। এর পরপরই ওই এলাকায় ইয়াবা-ফেনসিডিলের মতো ভয়াবহ মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। বর্তমানে এলাকায় ইয়াবা ব্যবসায় যুক্ত সবাই কাউন্সিলরের লোক হিসেবে পরিচিত। পাতলা খান লেন, কেজি গুপ্ত লেন, শ্রীশ দাস লেন এবং আড়পাড়া এলাকায় পাপ্পু, হেমন্ত, বিজয়, শ্যামল, জ্যাকি ও মামুন ইয়াবা ব্যবসা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। হেমেন্দ্র দাস লেনের ডালপট্টিতে এ ব্যবসা করে জয়, আর রূপচান লেনে করে গৌতম, জয়ন্ত ও শুভ।
হেমেন্দ্র দাস রোডের এক বাসিন্দা জানান, এই রোডের এক্রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠান হয়। সেটাও হয় কাউন্সিলরের কথায়। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝেমধ্যেই বিপাকে পড়তে হয় এবং স্কুলের পরিবেশও নষ্ট হয়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকার চাঁদাবাজ সবাই আরিফ হোসেন ছোটনের অনুসারী। বাদামতলী ঘাট থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত এলাকায় তারা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। সদরঘাট এলাকায় চাঁদাবাজি করে খলিফা বাহিনী। তার প্রধান আসাদ খলিফা। তার সঙ্গে আছে জাবেদ হোসেন মিঠু, ইস্টবেঙ্গল মার্কেটের শফিক, হকার্স মার্কেটের মনির ওরফে বিএনপি মনির, নাকা বাবু ও যুবলীগের জাবেদ হোসেন পাপন। ইসলামপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে মিঠু ও পাপন। শ্যামপুর এলাকায় চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত রব, বাপ্পি, জয়সহ কয়েকজন। শ্যামবাজার ব্যবসায়ী বণিক সমিতি থেকে প্রতিদিন ৭৫ হাজার টাকা দেওয়া হয় কাউন্সিলরের কার্যালয়কে। শ্যামবাজার পাইকারি মার্কেটে যত ট্রাক পণ্য যায়, প্রতি ট্রাকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। পান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গাড়িপ্রতি ৫০০ টাকা ও ভ্যানপ্রতি ১৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়।
সদরঘাট সংলগ্ন মায়াকাটারা মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে ৬৬ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ওই মার্কেটের জায়গা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু দোকানিরা মার্কেটের মালিক হিসেবে জানতেন অবাঙালি সুলতান-মঈনুদ্দিন গংকে। কিন্তু ২০১৪ সালে এখানে নজর পড়ে আরিফ হোসেন ছোটনের। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ইউসুফ মৃধা দুলালকে দিয়ে মার্কেটের মালিকানা সংক্রান্ত একটি সাইনবোর্ড টাঙান তিনি। মার্কেটটি ভেঙে নতুন করে তৈরির একটি বায়নামাও করেন তারা প্রসিমো ডেভেলপমেন্টসের মালিক শাজাহান সিরাজ জুয়েলের সঙ্গে। কিন্তু গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদ এলে আদালতে মামলা হয়। আদালত মার্কেটের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। এভাবে মার্কেটটি সেই দফায় রক্ষা পায়।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ মহানগর দক্ষিণের এক নেতা জানান, ২৫, পিসি ব্যানার্জি লেনের এক বাড়িওয়ালাকে কয়েক বছর বাড়িতে ঢুকতে দেননি ছোটন। পরে সাত কাঠা ভূমির ওপর আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের পাশাপাশি ওই দুটি বাড়ি কেনেন মাত্র ৪০ লাখ টাকায়। বর্তমানে সেখানে বহুতল ভবন তুলছেন কাউন্সিলর। কেজি গুপ্ত লেনে দখল করা আরেকটি বাড়ি রিকশা গ্যারেজ হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন ছোটনের ভাই মুন্না। ৩০, নর্থব্রুক হল রোডের গিয়াস গার্ডেন দখল করেছেন কাউন্সিলর।
২৯, বাংলাবাজারের মেহেরজান হোটেলের জায়গা নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধ ছিল। এই বিরোধকে কাজে লাগিয়ে সে জমির মালিক হয়ে গেছেন ছোটন। বর্তমানে সেখানে তার মালিকানাধীন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রয়েল ডিজাইন প্রপার্টিজ লিমিটেড বহুতল ভবন নির্মাণ করছে।
২২ নম্বর পাতলা খান লেনে ছোটনদের ছিল পুরনো বাড়ি। বাড়ির পেছনে কিছু সরকারি প্যাসেজ ছিল। কাউন্সিলর হয়ে সেখানে ১০ তলা অত্যাধুনিক ভবন তৈরি করেছেন ছোটন। বাড়ি তৈরির সময় দখল করে নিয়েছেন প্যাসেজটি। এ ছাড়া ১৬, কেজি গুপ্ত লেনে একটি মন্দিরের জায়গা দখল করে তিনি জেনারেটর ব্যবসা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কাউন্সিলরের বক্তব্য :এদিকে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা পাওয়া প্রসঙ্গে আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, সেগুলো ছিল রাজনৈতিক মামলা। এ জন্যই তখন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করেছিলেন। কখনোই চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বা এখনও নেই দাবি করে তিনি বলেন, আসাদ খলিফা নামে যার কথা বলা হচ্ছে, তিনিও ভালো লোক। তিনি সদরঘাট এলাকায় পানির ব্যবসা করেন। তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ পড়েছিল। ওসি এবং ওসি (তদন্ত) দু’জনে তদন্ত করেও কোনো প্রমাণ পাননি।
শ্যামবাজারে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে ছোটন বলেন, শ্যামবাজার বণিক সমিতিই এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করে। ওই সমিতির সভাপতি সূত্রাপুর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজি সাঈদ। তিনি আগে কাউন্সিলর ছিলেন। চাঁদাবাজির কারণেই তিনি গত কাউন্সিলর নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। অথচ আমি স্বতন্ত্র হিসেবে শতভাগ সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছি। শ্যামবাজারের ওখানে কয়টা গলি আছে, তাও ভালো করে জানি না।
লালকুঠির পেছনে অবৈধ দোকান নির্মাণ প্রসঙ্গে আরিফ হোসেন বলেন, লালকুঠিতে একটি স্পোর্টস ক্লাব আছে। এই ক্লাবের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের মৌখিক অনুমতি নিয়ে সেখানে ছয়টি দোকান তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর ভাড়া দিয়ে স্পোর্টস ক্লাবের খরচ চালানো হয়। তিনি বলেন, ওই ক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর জন্য মাসে ৩০ লাখ টাকার অফার ছিল। কিন্তু তা করতে দেওয়া হয়নি। অথচ তিনি কাউন্সিলর হওয়ার আগে ওই ক্লাবে জুয়া চলত। যারা কাউন্সিলর ছিলেন, তারা সেই জুয়ার টাকার ভাগ পেতেন। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে শপথ নেওয়ার আগেই তিনি তার প্রথম কাজ হিসেবে সেই জুয়া বন্ধ করেছেন।
মাদক ব্যবসায়ে সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রসঙ্গে আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, তিনি কখনোই মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত নন। সরকার অনুমোদিত বিলেতি মদের দোকান কাশ্মীরি হাউসও তিনি উচ্ছেদ করেননি। কাশ্মীরি হাউসের হোল্ডিং মালিকের সঙ্গে তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভেতরে একটি আড়তে তারা দোকান স্থানান্তরের জন্য একজনের সঙ্গে চুক্তি করে। তখন কাশ্মীরি হাউসের মালিককে ছোটন আড়তের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মদের দোকান না দিয়ে খানিকটা দূরের একটি দেশি মদের দোকানের পাশে তাদের দোকান দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
মায়াকাটারা মার্কেট দখল প্রসঙ্গে কাউন্সিলর বলেন, ওই মার্কেট নিয়ে মামলা আছে। যারা দোকানি ছিল, তারাই তো ব্যবসা করছে। তা হলে দখল হলো কীভাবে! যেসব বাড়ি দখলের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর একটির সঙ্গেও জড়িত নন বলে জানান তিনি।
পুস্তক প্রকাশনা সমিতি দখল প্রসঙ্গে আরিফ হোসেন জানান, এটা একেবারেই ঠিক না। একটি পদ্ধতির মাধ্যমে তাকে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো জেলার কোনো সদস্য যদি অভিযোগ করেন, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন। তা ছাড়া চার বছর মেয়াদ তার এখনও শেষ হয়নি।