দেশের অর্থনীতির ওপর মহামারীর সঙ্কটের বিরূপ প্রভাব নিয়ে অর্থনীতিবিদদের শঙ্কার মধ্যেও আগামী দিনের জন্য আশার বাণী শুনিয়েছেন সরকারের দুই মন্ত্রী।
আওয়ামী লীগের আয়োজনে মহামারী ও পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে ‘বিয়ন্ড দ্য প্যানডেমিক’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠানের ষষ্ঠ পর্বে যোগ দিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘বাস্তব কারণেই’ উচ্চ প্রবৃদ্ধির আশা করছে সরকার।
আর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর বাজার খুলতে শুরু করায় সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ‘ঘুরে দাঁড়াতে পারবে’ বলে তিনি আশা করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদের সঞ্চালনায় মঙ্গলবার রাতে ইন্টারনেটে সম্প্রচারিত এ আলোচনার এবারের বিষয় ছিল ‘বাজেট ২০২০-২০২১: জীবন ও জীবিকার বাজেট’।
পরিকল্পনা ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছাড়াও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম এবং বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ এদিন আলোচনায় অংশ নেন।
মহামারীর সঙ্কটের মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ ম মুস্তফা কামাল ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরেছেন, তাকে ‘অবাস্তব’বলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রী মান্নান বলেন, “মহামারীর মধ্যেও বাস্তব কারণে তিনি (অর্থমন্ত্রী) উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরেছেন। কারণ এই মহামারীর মধ্যেও আমাদের রেকর্ড রেমিটেন্স এসেছে, কৃষিতে বাম্পার ফলন হয়েছে, রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। এসব কারণে তিনি উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরেছেন।”
প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল ফোনের সেবায় সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা নিয়ে জনগণের অসন্তুষের খবর ‘সরকারের উচ্চ মহলে’ পৌঁছেছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে ‘একটি সমাধান’ হতে পারে বলে তিনি আশা করছেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, গত তিন মাসে তৈরি পোশাক খাতের বেশ কিছু অর্ডার বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় ‘সোয়া তিন বিলিয়ন ডলারের’ চাপ এসেছে বাংলাদেশের ওপর। ফলে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ৫০ বিলিয়ন ডলারের যে রপ্তানি টার্গেট ধরেছিল, তার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।
“সব এক্সপোর্ট খাতই ভীষণ রকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করলাম, শুধু আমাদের পাটজাত দ্রব্যটা (ব্যবসা) ধরে রাখতে পেরেছে। সেটাও আমাদের সামান্য, বড় অ্যামাউন্ট নয়।”
তবে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বাজার খুলতে শুরু করায় ‘আশাবাদী হয়ে উঠছেন’ বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।
“বাজার খুলতে শুরু করেছে, মানুষ পোশাক কিনবে। সে বিবেচনাতে আমরা ধরেছি, এক্সপোর্টটা বাড়বে। সামনের দিকে ভালো দিন আসছে। এমন না যে, আমাদের টার্গেটের পুরোটাই একেবারে পারব। কিন্তু এই খারাপের মধ্যে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব বলে মনে করছি।”
কোভিড-১৯ সঙ্কটে বিশ্ব বাজারে বেশি দামের পণ্যে যখন মন্দাভাব, তখন স্বল্প ও মাঝারি দামের পণ্য উৎপাদন করে বাংলাদেশ সেই বাজার ধরতে পারে বলে মত দেন টিপু মুনশি।
তিনি বলেন, “আমরা যে মানের পণ্য উৎপাদন করি বাংলাদেশে, সেটার বাজার খারাপ হওয়ার কথা নয়। নিচে থেকে মাঝারি ধরনের আইটেম করি, যেটার চাহিদা হয়ত কমবে না। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে হয়ত হাই প্রাইসের আইটেমগুলোর ওপর প্রভাব পড়বে।”
সামনের দিনে বাংলাদেশ রপ্তানি চালিয়ে যেতে পারবে, এমন আশার কথা শুনিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, যারা আমাদের কাছ থেকে এত দিন কিনেছে, রাতারাতি তাদের সোর্স চেইঞ্জ হবে না। তাদের তো নিতে হবে। হয়ত কিছু কম হবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তারা সরে যাবে, এমনটা চিন্তা করার কোনো কারণ নাই। আমি আশাবাদী যে তারা হয়ত আমাদের কাছ থেকে আইটেম কিনতে শুরু করবে।”
বিশ্বের অনেক দেশ যখন চীন থেকে ব্যবসা সরিয়ে নিচ্ছে, তখন স্থানান্তরিত ব্যবসার সুবিধা বাংলাদেশ পেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন টিপু মুনশি।
“এ কথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, চায়না থেকে অনেকে ব্যবসা সরিয়ে নেবে। তার প্রভাব আমরা লক্ষ্য করছি। আমরা আশাবাদী, চায়না থেকে রিলোকেট হওয়া ব্যবসাটা আমরা পাব।”
রপ্তানিতে শুধু তৈরি পোশাক খাতের উপর নির্ভর না করে এখন অন্যান্য পণ্যেও নজর দিতে তিনি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ করেন।
বাণিজ্য মন্ত্রী বলেন, “লাইট মেশিনারিজ, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল- এসব কিন্তু এক্সপোর্টের ভালো সুযোগ আছে।”
বাণিজ্যমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু আলোচনায় বলেন, “যারা বিজনেস রিলোকেট করতে চায়, তারা এদেশে আসবে কি না সেটা নির্ভর করবে আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস দিতে পারছি কি না। এই দুটো সার্ভিস আনইন্টারাপটেড হতে পারে, তাহলে কিন্তু তারা আসবে।“
এই সঙ্কটের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি বিতরণ করা এখন ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ হয়ে দেখা দিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “টার্গেট ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বাতি জ্বলবে। কোভিড-১৯ এর কারণে আমাদের বেশ কয়েকটা প্রকল্পে ধীর গতি এসেছে। তবু এ পরিস্থতিতে এডিপির অর্জন প্রায় ৯৬ শতাংশ, সেটা খারাপ না, বলা যায় বেশ ভালো।”
এ বছর বিদ্যুৎ খাতের সিংহভাগ বরাদ্দ বিতরণ ও ট্রান্সমিশনে ব্যয় করা হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
কর ফাঁকির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখনই আমরা সময় থাকতে যদি ডিজিটালাইজড না করি, তাহলে কিন্তু ক্যাশ রেভিনিউ কালেকশনের ব্যাপারে সবসময় একটু আমাদের বাধাগ্রস্থ হতে হবে, করাপশন থেকে যায়, ক্রেডিট রেটিং সিস্টেমগুলো ইমপ্লিমেন্ট হবে না।”
তবে ২০১২ সালে সরকারের করা ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন বাংলাদেশে ‘সম্ভব নয়’ মন্তব্য করে এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, “ভ্যাট আইন যেটা করা হয়েছে এটা বহুজাতিক কোম্পানি এবং বড় ব্যবসায়ীদের জন্য। দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এই আইন ক্ষতি করবে।”
তার ভাষায়, ওই আইন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার জন্য ‘উপযোগী নয়’। গত বছর থেকে এ আইন বাস্তবায়ন শুরুর পর ভ্যাট আদায় আরও কমেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে মহামারী থেকে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এসএমইসহ সব ধরনের উদ্যোক্তারা ভালো সুযোগ তৈরি করে নিতে পারবেন বলে মত দেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
তিনি বলেন, সরকার এসএমইর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, কৃষিতে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং বড় উদ্যোক্তাদের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ দিয়েছে।
“এই তহবিলগুলো ঘূর্ণায়মান। তিন বছরের জন্য এই প্যাকেজ ঘোষাণা করা হয়েছে। প্রতিবছর যখন একবার করে যখন ওই ঋণের অর্থ ফেরত আসবে, তখন আবার পরের বছর এবং পরের বছর ওই অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবে। তাই ওই অর্থ তিনগুণ হবে।”
এসএমই খাতের ৯৯ শতাংশ উদ্যোক্তাই যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তারা যেন ‘ফরমাল ইকনোমিতে’ আসতে পারে, সেজন্য ট্যারিফ সুবিধা চান ফাহিম।
তিনি বলেন, “ট্যারিফ কম ধরে মূল্য সংযোজন করের মাধ্যমে যে কর বৃদ্ধির সুযোগ আছে তা সরকার নিতে পারবে। কম ট্যারিফ ধরলে যদি ব্যবসায়ীরা উৎপাদনের সুযোগ পায়, তাহলে মূসক দিয়ে বেশি কর আসবে।”
বরাবরের মতই এ পর্বটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেইসবুক পেইজ থেকে সম্প্রচার করা হয়। সেইসঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ও দৈনিক সমকালের ফেইসবুক পেইজেও তা সরাসরি দেখা যায়। বিজয় টিভিও অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখিয়েছে।
এর আগে ‘বিয়ন্ড দ্য প্যানডেমিকের’ পাঁচটি পর্ব প্রচার হয়েছে। গত ৬ জুন সর্বশেষ পর্বে করোনাভাইরাস সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের সক্ষমতা, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হয়।