বাংলার মানুষের মুক্তি আর অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত হয় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। পুরান ঢাকার বিখ্যাত রোজ গার্ডেনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এ দলটির জন্মলাভের মধ্য দিয়েই রোপিত হয়েছিল বাঙালীর হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ। বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগ-স্বাধীনতা এই তিনটি শব্দ অমলিন, অবিনশ্বর, অবিনাশী। ইতিহাসে এই তিনটি শব্দ একই সূত্রে গাঁথা। গৌরব ও ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে আজ ৭২ বছরে পা দিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী আর বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ।
বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে কখনও বিরোধী দলে, কখনও সরকারে থেকে দেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখে চলেছে মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে একটিই নাম আওয়ামী লীগ। সব পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের হার না মানা নেতৃত্ব। এই দলের নেতাকর্মীদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও অঙ্গীকারদীপ্ত সংগ্রামী ভূমিকা ইতিহাসবিদিত। স্বভাবতই বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের নির্মাতা আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সামান্য বিচ্যুতি কিংবা ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তারা।
তবে ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু এবং তার স্বপরিবারসহ দায়িত্বরত সবাইকে হত্যা করার পর ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অনেক কিছুই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতায় ফিরিয়ে আনা হয়৷ জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞাটা তুলে নেয়া হয়৷ পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা জামায়াত নেতারা একে একে ফিরেও আসে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের পরে৷
স্বাধীনতার পরে যে দলটি নিষিদ্ধ ছিল বিএনপির বিশেষ কৃপায় সেই জামায়াত এক সময় জাতীয় সংসদেও ঢুকে পড়ে৷ ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত তো বিএনপির সহযোগী শক্তি হিসেবে মন্ত্রী পরিষদেও ঢোকে৷ আলবদর নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামী তখনই কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী হন৷ আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে আর বিএনপি এই বিচার শুরুর উদ্যোগও কখনো নেয়নি৷
যদি এখন বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতো তাহলে জাতির জনকের বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের হত্যার বিচার হতো না। কারণ বিএনপি জামায়াত পাকিস্তানের আদর্শ ধারণ করে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করে। তারা মানবতার শত্রু। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হিসেবে পাকিস্তানের ভাবাদর্শ এদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা তারা করেছে। এখনো অব্যাহত আছে।কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করেছে।
দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই ও প্রাসাদসম ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দলটি আজ এ দেশের গণমানুষের ভাব-ভাবনার ধারক-বাহকে পরিণত হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে দলটি। জন্মের পর থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী দলটি বেঁচে আছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে।
আওয়ামী লীগের জন্মলাভের পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে এই দলের নেতৃত্বে বাঙালী জাতি ক্রমশ এগিয়ে যায় স্বাধীনতার দিকে। এই দলের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের স্থান দখল করে। আর এসব আন্দোলনের পুরোধা ও একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘ ২১ বছর বিরোধী দলে অবস্থান করে আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করেছিল। এর আগে এই দলের আন্দোলন সংগ্রামেই প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন। এছাড়া, তিনি কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি চালু করেন। এর মধ্যে দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তি নিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প। ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে করে বিচার ব্যবস্থা পূর্ণগঠন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু, রাজনৈতিক হত্যা, বঙ্গবন্ধু ও তার সপরিবার, কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যাসহ সকল হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন।
২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিরোধী দলে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করতে বেশ কয়েকবার মারণাঘাত চালায় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট। ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতা অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও ঝরে যায় অসংখ্য তাজা প্রাণ। ওয়ান-ইলেভেনের পর আবারও ঝড় আসে আওয়ামী লীগের ওপর। দীর্ঘ ১১ মাস কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দী রেখেও বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া আওয়ামী লীগকে ভাঙ্গতে পারেনি নেপথ্যের কুশীলবরা। ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশ শতকে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেন।
তারপর বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৩,২৬০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, ৫ কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষিকার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বিনা জামানতে বর্গাচাষীদের ঋণ প্রদান, চিকিৎসাসেবার জন্য সারাদেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৩৮.৪ থেকে ২০১৩-১৪ বছরে ২৪.৩ শতাংশে হ্রাস করে।
তারপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থল সীমানা চুক্তির অনুমোদন এবং দুই দেশ কর্তৃক অনুসমর্থন, (এর ফলে দুই দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে), মাথাপিছু আয় ১,৬০২ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ, দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে হ্রাস, ৩২ বিলিয়ন ডলারের উপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন কাজ করে।
এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ৭ জানুয়ারি ২০১৯ শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তারপর মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার কাজে সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুত্তি, বিদ্যুৎ খাত, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন দেশের ভেতর-বাইরে প্রশংসিত হয়েছে। শিক্ষাখাতে অভাবনীয় উদ্যোগ করেছে সরকার। বিনামূল্যে বই বিতরণ, মেধাবৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ যা জোট সরকারের আমলের ১৩ গুণ বেশি, শিক্ষক নিয়োগ ও মর্যাদা বৃদ্ধি, নতুন বিদ্যালয় স্থাপন, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা, দারিদ্রপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড, কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন এবং সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ করছে।
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ এখন শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়, একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবেও প্রশংসিত। কথিত তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ আজ ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র-চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
এছাড়াও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেস সহ আরো অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। দেশের আইটি খাতের নতুন সম্ভাবনা যশোরে ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’ করা হয়েছে।
এদিকে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদিতা নির্মূলে বাংলাদেশ সফল হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কাজ করছে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছেন। বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাণ পণে কাজ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্রের মানস কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হাজারো লড়াই, সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা অতিক্রম করে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণে আওয়ামী লীগ এই সফলতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে। আর বাংলাদেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবে।
লেখকঃ
গাজী সারোয়ার হোসেন বাবু
সাংগঠনিক সম্পাদক,
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ
সাবেক ভিপি
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রসংসদ