দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পুঞ্জীভূত আবেগ থাকলেও বিএনপির নেতৃত্বের মূল ভূমিকায় শিগগির আসছেন না বেগম খালেদা জিয়া। ৬ মাসের মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলেও পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তিনি পেছন থেকেই পরামর্শক কিংবা জাতীয়তাবাদী শক্তির অভিভাবক হিসেবে কাজ করে যাবেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও গত শনিবার স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে দলের নীতিনির্ধারকদের রাজনীতির চাইতে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য সবাইকে সুস্পষ্ট পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
অসুস্থ খালেদা জিয়ার ৬ মাসের সাজা স্থগিতের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী মাসে। গত মার্চ মাস থেকে কারাগারের বাইরে থাকলেও তিনি দলীয় রাজনীতিতে প্রকাশ্য কোনো ভূমিকা রাখেননি। করোনোর কারণে অধিকাংশ সময়ই তিনি বাসায় কাটিয়েছেন কোয়ারেন্টিন কিংবা আইসোলেশনের মতো পরিবেশে। দুই ঈদে দুইবার তিনি শীর্ষ নেতাদের সাক্ষাৎ দিয়েছেন। এই দু’টি সাক্ষাতের কোনোটিই দলীয় রাজনীতির জন্য ইস্যুভিত্তিক কিংবা সিদ্ধান্তমূলক ছিল না, মূলত হয়েছে নেত্রীর সাথে আলাপচারিতা ও সৌজন্যমূলক ব্যক্তিগত ভাব বিনিময়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে খালেদা জিয়াও এসব সাক্ষাতে নিজস্ব চিন্তাভাবনা নেতাদের সাথে ভাগ করেছেন। বিশেষ করে তার অনুপস্থিতিতে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায়, সেই নির্বাচনের নানা প্রেক্ষিতও ছিল এই দু’টি সাক্ষাতে খোলামেলা আলোচনার বিষয়বস্তু।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে এরই মধ্যে কোনো কোনো নেতা আকার ইঙ্গিতে দলীয় রাজনীতিতে আবারো সক্রিয় হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে তিনি অসুস্থ হওয়ায় এ ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো আগ্রহই দেখাননি। দলের স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে এ বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দলের প্রধান নেত্রীর সুচিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে সবাইকে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন।
জানা গেছে, বিএনপির হাইকমান্ড এই মুহূর্তে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, সাজা স্থগিতের সময় বাড়ানো এবং প্রয়োজনে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্য দিকে, ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে সাংগঠনিক রাজনীতি কিংবা নেতৃত্ব যে প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলছে, সেভাবেই চলবে আগামীতেও।
টানা ২৫ মাস কারাভোগের পর গত ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে ৬ মাসের জন্য মুক্তি পান খালেদা জিয়া। শর্ত ছিল, এই সময়ে তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন, যেতে পারবেন না দেশের বাইরে। কিন্তু খালেদা জিয়া করোনা মহামারীর মধ্যে মুক্তি পাওয়ায়, তার চিকিৎসার বিষয়ে এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগই নিতে পারেনি বিএনপি। কিন্তু মুক্তির সময়সীমা ঘনিয়ে আসায় দলীয় প্রধানের অসুস্থতা ও মুক্তি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ ভর করেছে।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, পরিবারের আবেদনে খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন। তারাই তখন বিষয়টি মধ্যস্থতা করেছেন। এখন আবারো পরিবারের পক্ষ থেকেই সরকারের কাছে মুক্তির সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন করা হবে।
ওই নেতা জানান, খালেদা জিয়া এর আগে সিঙ্গাপুর, লন্ডন এবং আমেরিকায় চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি না হওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে বিদেশে চিকিৎসার কথাও ভাবা হচ্ছে। আর যেহেতু তার বড় ছেলে লন্ডনে রয়েছেন, তিনি যদি দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যেতে যান সেখানে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
জানা গেছে, সরকারের কাছে মুক্তির সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এ জন্য খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থার প্রয়োজনীয় প্রামাণিক কাগজপত্রও চিকিৎসক টিমের কাছে চাওয়া হয়েছে। সেগুলো সংযুক্ত করে আবেদনপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হবে।
খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম গতকাল সোমবার নয়া দিগন্তকে বলেন, মুক্তির সময়সীমা বাড়ানোর জন্য অবশ্যই আবেদন করা হবে। তবে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান তিনি। জানা গেছে, বিএনপি খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে কোনো রাজনীতি করতে চায় না। তবে চিকিৎসা ছাড়াই তাকে আবারো কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলে, পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
বিএনপির নেতারা বলেছেন, সরকার ভালো করেই জানে, উন্নত চিকিৎসা দূরে থাক, করোনাভাইরাসের কারণে খালেদা জিয়াকে এখনো কোনো হাসপাতালে পর্যন্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। সে কারণে বাস্তÍবতা মেনে নিয়েই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সুচিকিৎসার জন্য মুক্তির সময়সীমা বাড়াতে হবে। কিছু দিন আগে আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সরকার অনুমতি দিলে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়েও চিকিৎসা দেয়া যাবে। খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি নেতাদের বিশ্বাস, সেই অনুমতি তারা পাবেন। ফলে সাময়িক মুক্তির মেয়াদের ছয় মাস শেষে কারাগারে যেতে হবে না খালেদা জিয়াকে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে বলেছেন, সাজা স্থগিতের সময় বাড়াতে পরিবার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। অতীতের মতো পরিবারের পক্ষ থেকে এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যেহেতু তারা আগেও আবেদন করেছিলেন। এখনো যেহেতু ম্যাডাম সুস্থ হননি, তিনি একেবারেই একই (আগের) অবস্থাতেই আছেন। সুতরাং সাজা স্থগিতের সময়টা বাড়ানো এখন জরুরি প্রয়োজন।
‘সময় মতোই’ পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হতে পারে বলে জানান তিনি।
৭৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়া হাতে ও হাঁটুতে আরথ্রাইটিসের ব্যথা, ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যাসহ নানা রোগে আক্রান্ত। তিনি নিজে হাঁটতে পারেন না, অন্যের সহযোগিতায় তাকে চলতে হয়।