প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত যেন বৃথা না যায়। যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে জাতির পিতাকে ঘাতকের বুলেটে জীবন দিতে হয়েছে, সেই স্বপ্ন পূরণে সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে তিনি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্ট শহীদদের স্মরণে শুক্রবার ৫০ হাজার বার কোরআন খতম উপলক্ষে আয়োজিত দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজ কল্যাণ অধিদফতর এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষ একটা শোক সইতে পারে না। আর আমরা কি সহ্য করে আছি শুধু একটা চিন্তা করে যে, এই দেশটা আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। তিনি এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চান। কাজেই আমার যতটুকু সাধ্য, সেইটুকু আমরা করে দিয়ে যাব যেন তার আত্মাটা শান্তি পায় এবং এই রক্ত যেন বৃথা না যায়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাকে (বঙ্গবন্ধু) যারা হত্যা করেছে, তারা ঘৃণ্য। তাদের বিচার করেছি, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সেই শক্তি দিয়েছেন আমাদের। ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে দিয়ে তাদেরকে বিচার করতে পেরেছি। এতে আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করি।
আওয়ামী লীগকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রেখে দেশসেবার সুযোগ করে দেওয়ায় দেশের মানুষের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণকে, যারা আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন এবং আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনকে, যারা সব সময় আমার পাশে থেকে আমাকে শক্তি জুগিয়েছে, একটা পরিবারের মত আমি পেয়েছি। শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতার আজীবন সংগ্রামের কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘১৫ অগাস্ট আমাদের জাতীয় শোক দিবস। জাতি হারিয়েছে তার নেতাকে, আর আমরা হারিয়েছি, আমার ছোট বোনটি এবং আমি, সেই সাথে আমাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আমরা আপনজনদের হারিয়েছি হঠাৎ একদিন।’
মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ সময়ের মধ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবারের এতিম শিশু এবং ক্যাপিটেশন গ্র্যান্টপ্রাপ্ত ৩৯২৮টি প্রতিষ্ঠানের লক্ষাধিক এতিম শিশুদের মাধ্যমে বর্ষব্যাপী এক লক্ষ বার কোরআন খতমের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ১৫ আগস্টের মধ্যে ৫০ হাজার বার কোরআন খতম হয়ে গেছে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
দোয়া মাহফিলে উপস্থিত সরকারি শিশু পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তোমরা ছোটবেলা থেকে তোমাদের বাবা-মাকে দেখতে পাওনি। অনেকে পিতাকে পাওনি, বা মাকে পাওনি। আবার অনেকে কাউকেই পাওনি। কারো আদর, স্নেহ, ভালোবাসা সেটা যে কি জিনিস, সেটা তোমরা উপলব্ধি করতেই পারোনি।’
নিজের মায়ের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার মা (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) মাত্র তিন বছর বয়সে তার মাকে হারিয়েছিলেন এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার পিতাকে হারান। ছিলেন দাদার কাছে। ৭ বছর বয়সে দাদাও মারা যান। আমার দাদি আমার মাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন।’
ঘাতকের বুলেটে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হারানো শেখ হাসিনা এতিমদের উদ্দেশে বলেছেন, তারা যেন কখনও নিজেদের অসহায় মনে না করে, কারণ তিনি সব সময় তাদের পাশেই আছেন। এতিমদের কষ্ট কেমন, তা নিজে উপলব্ধি করার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এই কষ্টটা আমরা বুঝি। এই কষ্টটা আরও বুঝলাম ১৫ আগস্ট। একদিন সকালে উঠে যখন শুনলাম আমাদের কেউ নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই খুনিরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য এবং কিছু উচ্চপদস্থ ছিল, যারা এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলকেও যে খুনিরা রেহাই দেয়নি, সে কথা মনে করে আবেগ আপ্লুত শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার ছোট্ট ভাইটি- আমি এখনো এই প্রশ্নের উত্তর পাই না, তার মাত্র ১০ বছর বয়স। তার জীবনের স্বপ্ন ছিল সে একদিন সেনাবাহিনীতেই যোগদান করবে। আর নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস, তাকে এই সেনাবাহিনীর সদস্যরাই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করল। তার অপরাধ কী জানা নেই আমার।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড যখন চলছিল, তখন দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এরপর ছয় বছর তাদের নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বাবা-মায়ের লাশও দেখতে পাইনি। কবরও জিয়ারত করতে পারিনি। দেশে আসতেও পারিনি। এভাবে আমাদের বাইরে পড়ে থাকতে হয়েছিল। এতিম হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে বিদেশের মাটিতে রিফিউজি হয়ে থাকার কি কষ্ট, এটা যারা আমাদের মত ছিল তারা জানে।’ নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালে দলীয় নেতাকর্মী ও দেশের মানুষের সমর্থনে দেশে ফিরে আসার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এই বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমার বাবা সারাজীবন কষ্ট করেছেন, সংগ্রাম করেছেন, জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই আমার চেষ্টা ছিল যে এই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কিছু করে যাব। সেটাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য।’
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষার জন্য তৎকালীন সরকারের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ একটা হত্যাকাণ্ড হলে সবাই বিচার চাইতে পারে, মামলা করতে পারে। আমরা ১৫ আগস্ট যারা আপনজন হারিয়েছিলাম, আমাদের কারো মামলা করবার বা বিচার চাইবার অধিকার ছিল না। সেই অধিকার আদায়ের পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। তাদেরকে বিভিন্ন দেশে বিদেশে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। তারা পুরস্কৃত হয়েছিল এই খুন করবার জন্য। নারী হত্যাকারী, শিশু হত্যাকারী, রাষ্ট্রপতি হত্যাকারী- তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, সেই অবস্থার পরিবর্তন তিনি আনতে চেয়েছেন। দেশের সব মানুষ যেন নিরাপদে থাকতে পারে, সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, ন্যায়পরায়ণতা যেন সৃষ্টি হয়, প্রত্যেক মানুষের যেন অধিকার থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বড়লোকেরা তো সব সময় ভালো ভালো খাবার খায়। যে কারণে জন্মদিনে অন্য কাউকে দাওয়াত না করে আমরা তোমাদের মতো শিশুদের দাওয়াত করি। তোমাদের জীবন সুন্দর হোক, সফল হোক। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা নিয়ে তোমরা কাজ করবে। নিজেরা বড় হতে পারলে তোমরা একদিন এই রাষ্ট্রের উপকার করতে পারবে।
অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হিজড়া এবং বিভিন্ন অনগ্রসর জাতিকেও আমরা সহযোগিতা করছি। যারা হিজড়া তারাও তো কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। কেন তাদের দূরে ঠেলে দেয়া হয়, কেন তাদের রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হয়। তারাও পরিবারের সন্তান, তারাও পরিবারেই বড় হবে।
অনুষ্ঠানে গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রান্তে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ উদ্দিন খান খসরু এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জয়নুল বারীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন এতিম খানা ও সরকারি শিশু পল্লী থেকে শিশুরা মোনাজাতে অংশ নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দোয়া মাহফিলে অংশ নেন।