দীর্ঘ সময়ের পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির মাস ডিসেম্বর, বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের সেই স্মৃতি বিজড়িত আজকের এই দিন ১৬ ডিসেম্বর।
মানুষ যুগ যুগ ধরে মা মাটি এবং স্বজনদের স্মৃতি বহন করে বেচেঁ থাকে, এটা তার প্রকৃতিগত স্বভাব। তবে আমরা বাঙালিরা এই বিষয়ে আলাদা। সময়ের ব্যবধানে আমাদের চেতনা সংকুচিত করে ফেলছি। বিজয়ের আনন্দ কমে যাচ্ছে। আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের স্বপক্ষে নেই বিজয়ের আনন্দ এবং বেদনা স্মৃতি বয়ে বেড়ানো স্বভাব।
আজ আমাদের দেশ বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের যাদের ৭১ এর পরবর্তীতে জন্ম, আমরা কিশোর বয়সে আমাদের প্রিয়জন যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে তাদের কাছে থেকে গল্প শুনেছি। তাদের অশ্রুসিক্ত চোখে ইতিহাস জেনেছি, উপলব্ধি করেছি সেই গল্প গুলো কতোটা ভয়ঙ্কর ছিলো তা শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব না।
পঞ্চাশ বার এই বিজয় দিবস উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। আমরা যারা একাত্তরের পরে জন্মেছি তারা হয়তো এই দিবস আরো কম উদযাপন করেছি উদযাপনের দিন হিসাবে আমাদের সন্তানরা আরো কম।কিন্তু নদীর ভাটার মত করে কমে যাচ্ছে বিজয়ের প্রকৃত অর্থটা। আমরা আমাদের তরুণ সময়টা কিভাবে কাটিয়েছি কিভাবে উদযাপন করেছি। এখনকার তরুণরা কিভাবে উদযাপন করতেছে। কতটুকু ভাবায় আমাদের কে আর কতটুকু ভাবে তরুণ প্রজন্ম।
তাহলে তিন শ্রেনিতে ভাগ হয়ে গেলো বিজয়ের আনন্দ? কিভাবে আমাদের সন্তানরা করতেছে। বছর হিসাবে যতোতম হচ্ছে ততই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আমাদের বিজয় এবং আমাদের স্বাধীনতা! ক্রমশ শীতল চেতনার ভুল সমীকরণে বড় হচ্ছে তরুনরা। তারা জানে কি? জয় আর বিজয়ের পার্থক্য! তবে কি এখন ইতিহাসের শান কমে যাচ্ছে? সময়ের স্রোতে আমাদের উদিয়মান তরুণ প্রজন্মের চেতনা হীমঘরে চলে গেছে।
তাহলে প্রশ্ন চলে আসে আমরা যারা একাত্তরের পর পরই জন্মগ্রহণ করেছি, আমরা যেইটুকু শিক্ষা পেয়েছিলাম বাবা মা ও পরিবার শিক্ষক তথা সমাজ সংস্কৃতি থেকে সেভাবে আমরা শিখেছি, আমাদের সন্তানদেরকে আমরা শিক্ষা দিতে পেরেছি মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস? তাদের কে জানাতে পেরেছি কী একটা মানচিত্র মানে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ।
হ্যাঁ নিঃসন্দেহে আমরা হেলা করে গেছি আমাদের পরবর্তীত প্রজন্ম তথা আমাদের সন্তানদেরকে জানাতে স্বাধীনতার বিস্ফোরণ। তাদের কে জানাতে ব্যর্থ একাত্তরের মর্মবানী।
বিজয় মানে উৎসব না দায়িত্ব নেওয়া। বিপুল আনন্দ-উৎসব নিয়ে এ দিবস উদযাপন করলেও এর রয়েছে বেদনায় ভরা ইতিহাস। হ্যাঁ উদিয়মান তরুণ প্রজন্ম জানেনা বলেই তাদের রক্ত এতো শীতল, দেয়ালে পিঠ লেগে যাচ্ছে তাদের কুনো-ব্যাঙের আচরণ বয়ে বেড়ায়ে।
তারা জানে না বলেই দেশের এই ক্লান্তি লগ্নে তরুণরা চুপচাপ বসে আছে। উদাহারণ দেওয়া যায় বাবাব কেনা এক টুকরো জমি কেউ কেড়ে নিলে অপরের সাথে খুনাখুনিতে জড়িয়ে যায় সন্তান। অথচ ত্রিশ লাখ শহীদের এই দেশে এতো অন্যায় অত্যাচার এখনো পাকিস্তানের আগ্রাসন তৈরীর গল্প দেখে তরুণরা চুপচাপ।
হ্যাঁ আমরা আরো ব্যর্থ। এই বিজয়ের সূবর্ণ জয়ন্তীর সবচেয়ে হতাশার বিষয়, আমাদের বাবা মা স্বজনেরা এই বিজয়ের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামদীপ্ত রক্তস্রোতের পথ পাড়ি দিয়েছে। আর আমরা এখন পরিবারের অনেকেই আমাদের সন্তানদেরকে বাংলাভাষা তথা মাতৃভাষা শিখে উঠার আগে ইংরেজি চর্চা চাপিয়ে দেই। দেশের ইতিহাস রক্তের ঋণশোধ করার সুযোগ না দিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করাই। এর ফলে প্রকৃত অর্থে আমাদের সন্তানদের মাঝে দেশ প্রেমে উদাসীনতা ও দায়িত্ববোধ কমে যায়।
আমরা জানাতে পারিনি ১৬ ডিসেম্বরে দুইদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর এক দিনে কি হারিয়ে ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর কিভাবে পেলাম, এটা আসলে কি একটা তারিখ? যার ফলে সারা বছর সংস্কৃতির উগ্রতা ভীনদেশি গানে মত্ত থেকে আমাদের সন্তানরা বিজয় দিবস পালন করে তার মূল চেতনা হারিয়ে। সবুজ-লাল রঙএর পাঞ্জাবিতে বিজয়ের চেতনা ধারণ করে। উদিয়মান প্রজন্মকে রক্তে কেনা বিজয়ের বিস্ফোরণ বুঝাতে আমরা ব্যর্থ।
আমাদের ভুলের কারণে তারা নিজের জন্মকে স্বীকার করতে সংকীর্ণতাবোধ করে। ভুলে যায়, এই মা-মাটি মানুষের একান্ত ঠিকানা হিসাবে তাদের বেড়ে উঠতে হবে। তারা জানেনা এখানে মিশে আছে তাদের স্বজনদের আত্মত্যাগের ঋণ।
হ্যাঁ, সেইসব তরুণরা লাখ শহীদের আত্মত্যাগের মহীমা অস্বীকার করে আমাদের ভুল সমীকরণের জন্য। একাত্তরের পরে জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে বুঝাতে অক্ষম স্বাধীনতা তোমাদের জন্মগত অধিকার হলেও এই স্বাধীনতার জন্য দিতে হয়েছে ৩০ লাখ প্রাণ। স্বাধীনতা বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য। আমাদের এই স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে। পুরো বিশ্বকে বিস্মিত করে এরপর ১৬ ডিসেম্বর আমরা পেয়েছি ।
আমরা জানাতে পারেনি তাদের দায়বদ্ধতা এবং তোমরা যারা একাত্তরের পরে জন্মেছো তারা কতটুকু শোধ করতে পারবে তোমাদের কি করণীয় যদিও শোধ শব্দটা বৃহত্তর অর্থে খুব বেমানান। স্বাধীনতা অর্ধশত বছর বয়সে পা দেবে দেশ এই মাহেন্দ্র সময়ে এসে ফিরে তাকালে ৫০ বছরের স্বাধীনতা আমাদের কী দিয়েছে এবং কী দেয়নি এই সমীকরণে ঋণখেলাপে ভরে যাচ্ছে ডায়রীর পাতা।
বিজয়ের প্রায় অর্ধশত বছর পরও সাংস্কৃতিক মুক্তি আমাদের হয় নাই। তাই আমাদের উচিত পরাধীনতার শিখল ভেঙে একাত্তরে তরুণরা যেভাবে দেশকে মুক্ত করেছিলো।একাত্তরের চেতনা বুকে ধারন করে সঠিক চর্চার মাধ্যমে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে থেকে ক্ষুধা দরিদ্র মুক্ত প্রকৃত স্বাধীন একটা দেশ নির্মাণে শপথ নেওয়া।
আম্বিয়া অন্তরা, লেখক ও পর্যটক, নিউইয়র্ক প্রবাসী।