প্রকৃত নাম আজিজুল হক বাচ্চু হলেও স্থানীয়দের কাছে বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত তিনি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলা শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি এবং তৎকালীন পাক সরকারের ভাতা ভুক্ত তালিকায় ২৬ নম্বরে স্থান ছিলো বলে নিশ্চিত করেন নোয়াখালীর স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রবীণ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা।
তালিকা ভুক্ত রাজাকার পরিবার নোয়াখালী জেলা সদরে জেলা স্কুলের সামনে প্রায় ৪০ শতক সরকারি জায়গা দখল করে মার্কেট ও বসত বাড়ি বানিয়েছেন। যার আনুমানিক বাজার দর প্রায় ৪০ কোটি টাকা। অনেক আগে থেকেই রাজাকার পরিবারের দখলে এই সরকারি সম্পত্তি থাকলেও বর্তমানে জায়গা ভোগ-দখলে প্রধান ভূমিকা পালন করছে বাচ্চু রাজাকারের বড় ছেলে মওলা জিয়াউল হক লিটন।
সরকারি সম্পত্তি রাজাকার পরিবারের দখলে থাকায় ক্ষোভ জানিয়েছেন নোয়াখালী জেলার একাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী এবং আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।
খোজ নিয়ে জানা যায়, আনুমানিক ৬ শতক সরকারি জমি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে (অস্থায়ি দখল) করে সেই জমির সাথে থাকা আরো ৩২ শতক মোট প্রায় ৪০ শতক সরকারি জমি দখল করে রেখেছে এই রাজাকার পরিবার।
এই ৪০ শতক সরকারি জমির এক অংশের উপর নির্মাণ করা হয়েছে মওলা প্লাজা নামের বিশাল একটি মার্কেট। আর বাকি জমিতে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছে রাজাকার পরিবারের সব সদস্য। এই মওলা প্লাজার দোকানের অ্যাডভান্স হিসেবে দোকান মালিকদের কাছ থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা নিজেদের কব্জায় নিয়েছেন রাজাকার পরিবারটি। ভাড়া পান বছরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। আর এই টাকা দিয়ে নোয়াখালী জেলায় হয়ে উঠেছেন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এমনকি ভোল পাল্টিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের পদও ভাগিয়ে নিয়েছেন রাজাকার পুত্র লিটন। তবে বাচ্চু রাজাকারের অন্য ছেলেরা কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে না। বাচ্চু রাজাকারের ছেলে সুমন সাবেক জেলা ছাত্র দলের নেতা। সুমন তখন ছাত্রদলের ক্যাডার হিসেবে নোয়াখালী জেলায় ত্রাসের সৃষ্টি করেছিলো। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে এই সুমনের হাতে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মী একাধিকবার মার খেয়েছে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেন। এক নেতা অভিযোগ করে বলেন, সুমনের হাতে আহত এবং নিগৃহীত হয়নি আওয়ামী লীগের এমন নেতা-কর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সরকারি জায়গায় দোকান মার্কেট করে কোটি কোটি টাকা আয় করে বর্তমানে এই পরিবার এতটাই প্রভাবশালী হয়েছেন যে, মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের প্রবীন নেতারাও এই রাজাকার পরিবারে বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন।
রাজাকার পরিবারের ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীন এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে কষ্টের জীবন-জাপন করছি। আর আমাদের সামনেই রাজাকারের ছেলে সরকারি জায়গা ভোগ করে মার্কেট বানিয়ে সেখান থেকে কোটি কোটি আয় করে আমাদের সাথেই খবরদারি করছে এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক ও চরম অবমাননাকর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অসম্মানজনক। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে স্বাধীন দেশে এমন অনাচার মেনে নিতে পারছি না। কিন্তু টাকা আর ক্ষমতার দাপটের কাছে আমরা ভীতু ও দুর্বল তাই প্রতিবাদ করার ইচ্ছা থাকলেও প্রতিবাদ করতে পারছি না। তিনি বলেন, আজিজুল হক বাচ্চু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। একাত্তরে নোয়াখালী জেলা শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। এলাকায় তিনি বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত। মানুষ তাকে বাচ্চু রাজাকার বলে ডাকে। যদিও তিনি এখন আর বেঁচে নেই তবে তারা ছেলেদের দাপট দেখলে কষ্ট ও লজ্জা পাই।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাম না প্রকাশের শর্ত জুড়ে দিয়ে অসন্তোস প্রকাশ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে শুনি আজিজুল হক বাচ্চু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন । সেই রাজাকারের ছেলেদের দখলে সরকারি সম্পদ এটা মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের সম্পদ পেলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার পাবে । রাজাকার পরিবার কেনো সরকারি সম্পদ ভোগ করবে। এবিষয়টি নজরে নিয়ে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা রাজাকারের সন্তানদের সরকারি জমি দেওয়ার জন্য আমরা দেশটা স্বাধীন করিনি।
অন্য এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধার ভালো ঘরবাড়ি নেই, কষ্ট করে জীবন-জাপন করছে কিন্তু বাচ্চু রাজাকারের পরিবার সরকারি জমি দখলে রেখে ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠান খুলেছে এবং বসত বাড়ি বানিয়েছে। স্বাধীন দেশে এমনা হবে তা ভাবতে পারিনা। তবে এর জন্য নোয়াখালী জেলার আওয়ামী লীগ দলীয় এক সংসদ সদস্য দায়ী। তিনি এই রাজাকার পরিবারকে আওয়ামী লীগে পদ দিয়ে ক্ষমতা দিয়েছেন। তাই আমরা কিছুই বলতে পারি না। আগে প্রতিবাদ করে অমানবিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েছি। তাই এখন চুপ করে আছি। সরকারের কাছে আবেদন করবো- সরকার যেনো বিষয়টার প্রতি গুরুত্ব দেয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক নেতা ও সাবেক জনপ্রতিনিধি বলেন, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগে একজন বিশেষ ব্যক্তির হাত ধরে রাজাকার পরিবার প্রবেশ করেছে। অন্য দল থেকে আশা অনুপ্রবেশকারীরাই প্রধান্য পাচ্ছে। ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়ে একটি রাজাকার পরিবার সরকারি সম্পদ দখল করে হয়ে উঠেছেন প্রভবশালী। যাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধারাই নির্যাতিত হচ্ছে। আমি আশাকরি সরকার এবিষয়ে যথাযথো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় রাজাকার পরিবারের এভাবে উত্থান হতে পারে না।