জলে স্থলে অন্তরিক্ষে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী আজ নারীদের জয়জয়কার।
পুরুষের সাথে সমান্তরালে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা।
গৃহ সামলানো থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনা সব জায়গায় সফল আমাদের জায়া,ভগ্নি,জননী।
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর ‘
কবি কাজী নজরুলের এই অমর বাক্য যেন একবিংশ শতাব্দিতে এসে পূরো সফল।
দেশে দেশে সবকিছুতেই আজ নারীর সফলতার গল্প গুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে চাকরি, অর্থায়ন ও সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে নারীদের পছন্দ, নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বেড়েছে। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শ্রমবাজারে বাংলাদেশের নারীর অংশগ্রহণের হার ২৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৬ শতাংশ।
নারী শিক্ষা বিস্তার ও নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একটি সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার ছিল ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ৭০ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৬ সালে বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর অগ্রগতি ছিল ৬২ শতাংশের বেশি যা গত বছর দাঁড়ায় ৭১ শতাংশ।
ঘরে-বাইরে, রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণ প্রায় নিশ্চিত হয়েছে। এখন দূর গ্রামাঞ্চলেও নারী আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিষয় নয়। কর্মক্ষেত্রে নারীরা দক্ষতা প্রমাণ করছেন, কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন। নারীরা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, পর্বত জয় করছেন, অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও। সব ধরনের খেলায়ও পুরুষের পাশাপাশি নারীরা আজ পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন। নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তো বটেই, উন্নত অনেক দেশ থেকেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। নারী-পুরুষের সমতা (জেন্ডার ইক্যুইটি) প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে বাংলাদেশ।
আর নারীদের এই অর্জনকে স্বীকৃতি প্রদান এবং তার কাজকে উৎসাহ দিতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’-এই প্রতিপাদ্যে আজ পালিত হবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
বৈশিক স্বীকৃতিও কম নয়। নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগে ভূমিকার জন্য গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। এ ছাড়া জাতিসংঘের ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ডেও ভূষিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নারীর ক্ষমতায়নে বেশ কিছু আইন-নীতি ও বিধিমালা তৈরি করেছে সরকার।
বর্তমানে বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। বর্তমানে প্রশাসনের উচ্চপদে ৫৩৫ জন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে এ নারী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব, সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিব রয়েছেন ৬ জন নারী। অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন ৮১ জন, যুগ্ম-সচিবের মধ্যে নারী রয়েছেন ৮৭ জন।
প্রশাসনে ১ হাজার ৮৪০ জন উপসচিবের মধ্যে নারী উপসচিব রয়েছেন ৩৬১ জন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে মোট নারীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৯ জন। মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে গত বছর পর্যন্ত নয় জেলায় নারী ডিসিরা দায়িত্ব পালন করছেন।
দুই দশকে বাংলাদেশে নারীর কর্মসংস্থান প্রায় ৩ ভাগেরও বেশি উন্নতি হয়ে ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
কিন্তু নারীর জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে সরকার। তিনি জয়িতা ফাউন্ডেশনকে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মুজিববর্ষে ৫০ লাখ প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত নারীকে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অনেক অর্জন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও সরকার ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশই বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে সংসদ নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী।
২০২০ সাল নাগাদ সব রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে ১ জন নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
কুসংস্কারকে কাজে লাগিয়ে নারীকে অধিকারবঞ্চিত করার সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার কারণে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নারীর পদচারণা দ্রুত হারে বাড়ছে। সমান অধিকার, মর্যাদার প্রশ্নে নারীরা তৎপর। সার্বিক বিচারে সমাজের প্রতিটি পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী এবং বিভিন্ন কারিগরি ক্ষেত্রে নারীরা উচ্চ পদে রয়েছেন। দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যুক্ত রয়েছেন অনেক নারী। ক্রিকেট, ফুটবলসহ পর্বতশৃঙ্গ জয়েও এগিয়ে এসেছেন নারীরা। নারী পুলিশ সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কাজ করছেন। শিল্প প্রতিষ্ঠায়ও ভালো করছেন নারীরা। সরকার নারী উদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে ও স্বল্প সুদে ঋণ দিচ্ছে। বছরে বিপুলসংখ্যক নারী চাকরি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন।
আজ নারী দিবসে পৃথিবীর সকল নারীর প্রতি শ্রদ্ধা।
আম্বিয়া অন্তরা, প্রবাসী ,লেখক ও পর্যটক নিউইয়র্ক।