শিশুর মেধা বিকাশে প্রতিবন্ধক ইন্টারনেট

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ বা রাষ্ট্রে’র কর্ণধার। মানুষের জীবনের চারটি কাল রয়েছে, শিশু, কিশোর, যুবক, এবং বার্ধক্য। আর এই চারটি কালের মধ্য সমাজ এবং রাষ্ট্র’কে নিয়ে চিন্তার উপযোক্ত সময় কিশোর এবং যুবক অবস্থায়।

পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের সৃজনশীলতা মূলক কর্মকান্ডে সামনের সারিতে এগিয়ে থাকেন তরুণরা। আর এসব সৃজনশীল মূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে তারা দেশকে বিশ্বের দরবারে সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করে। যদি এই তরুণরা সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করে, তাহলে ভবিষ্যতে দেশের কাঠামো কেমন হতে পারে একবার চিন্তা করে দেখতে পারেন। আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অস্বীকার করার জোঁ নেই, মোবাইল গেম আসক্তি ছোট্ট ছোট্ট শিশু থেকে তরুণ প্রজন্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। যে বয়সে একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা অর্জনে খেলাধুলা কিংবা শারীরিক কসরতে ব্যস্ত থাকার কথা; কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সেই বয়সের একটি শিশু আজকাল ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল গেমে নিমগ্ন থাকে।

বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ, এ যুগের মানুষদের নিত্যপ্রয়োজনীয় যাবতীয় কাজ প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ইন্টারনেট বিশ্বময় এক জাদুর নাম। যাতে ছুঁয়ে দিলেই চলে আসে বিশ্বের সব প্রান্তের সব ধরনের তথ্য। ইন্টারনেট মানুষের জীবনকে গতিময় ও সহজ করে দিয়েছে। এর উৎকর্ষতা আমাদের জীবনযাপন প্রণালির সার্বিক খোলনলচেই পালটে দিয়েছে।

অফিসের কাজকর্ম, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া, জ্ঞানচর্চা, দৈনন্দিন কার্য সম্পাদনসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান ও গ্রহণে ইন্টারনেটের ওপর মানুষের নির্ভতা বাড়ছে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসবাসকারী প্রিয়জন, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে অল্প খরচে চ্যাটিং, ভিডিও চ্যাটিংসহ প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান করা যাচ্ছে। জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন ইন্টারনেটের গুরুত্ব বাড়ছে। শুধু তথ্যই নয়, যে কোনো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা বিনোদন চাহিদা পূরণে এখন ইন্টারনেটের জুড়ি নেই।

অবসর সময়ের একাকীত্বের বিরক্তি কাটানোর জন্য ইন্টারনেটের পরতে পরতে সাজানো আছে নানা আয়োজন। আছে সিনেমা, গান, নাটক, কার্টুন, খবর, টকশো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ শত বিনোদনের ঝুলি। বিশ্বের প্রায় ২৭০ কোটিরও অধিক মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।

আর এই বিশাল জনগোষ্ঠী ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দিনের অধিকাংশ সময় ইন্টারনেটের পেছনে ব্যয় করে। যে ইন্টারনেট গোটা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। সেই ইন্টারনেট এখন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা ক্ষেত্রে নানা প্রেক্ষাপটে।

শিশুর সোনালি শৈশব এখন হয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটময়। যাকে বলা হয় ‘আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ’ সে জীবনের যাত্রাপথেই পতিত হচ্ছে এক ভয়াল আসক্তিতে। শিশুদের ইন্টারনেট আসক্তি এখন শৈশবেই ডেকে আনছে সর্বনাশ। এ সমস্যা ক্রমেই শিশুকে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শিশুকে ঠেলে দিচ্ছে এগগুয়েমি দিকে, এমন কি সামাজিক পরিবেশ থেকে বহু দূরে।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। একজন মানুষ দিনে অন্তত ২৬৬৪ বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিণ স্পর্শ করে। আর এই স্ক্রিণ স্পর্শ করার কারণ ফোনের নোটিফিকেশন চেক, কোন এসএমএস আসলো কিনা ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করে। বর্তমানে যারা দ্রুত ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছর অর্থাৎ তরুণ সমাজ। এদের মধ্যে প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, এবং পৃথিবীতে প্রায় ২২০কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ, যাদের মধ্যে ১০ কোটি ৩২ লাখ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট এর সাথে যুক্ত। এই বিশাল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজী নামক ভিডিও গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এসব ভিডিও গেম খেলার ফলে তাদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। কারণ এসব গেমে সাধারণত গোলাবারুদ ব্যবহার করার মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যার ফলে যখন তারা গেমে পরাজিত হয় তখন তাদের মন এবং মেজাজ খিটখিটে হয়, অল্পকথায় একে অপরের সাথে রাগারাগি করে।

এছাড়াও এসব গেমে বিভিন্ন ধাপ থাকে যেসব ধাপ অতিক্রম করতে পারলে অনেক সুবিধা প্রদান করা হয়। আর এসব ধাপ অতিক্রম করার জন্য যারা গেম খেলে তারা একটানা দীর্ঘ সময় গেমের পেছনে ব্যয় করে। গেমিং আসক্তি একটি মানসিক রোগ। এটি অন্যান্য নেশাজাত দ্রবের আসক্তির মতোই। পার্থক্য হলো একটি আচরণগত আসক্তি অপরটি নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি। গেম অপরিমিত ব্যবহার শিশু-কিশোরদের চিন্তা ও আচরণের ওপর মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে।

ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের মাঝে গেমিং আসক্তি বেড়ে যাওয়ার প্রভাবশালী কারণ বর্তমানে অভিভাবকরা সন্তানকে শান্ত রাখতে মুঠোফোনসহ বিভিন্ন ইলেট্রনিক যন্ত্রপাতি তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সন্তানকে নিজের চোখের সামনে রাখতে মুঠোফোন কিংবা ল্যাপটপ তুলে দিয়ে আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। অনেকে কর্মস্থলে ব্যস্ততার দরুনও শিশুকে সময় দিতে না পেরে স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপ তুলে দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না এই সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে ভবিষ্যৎ এ না জানি অস্বস্তিকর নিঃশ্বাসে ভুগতে হয় আমাদের। এক বছর যাবত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সময় টুকু এসবের পেছনে ব্যয় করছে।

যেখানে শিক্ষার্থীদের উচিত ছিল এই সময়টুকু কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা। শিক্ষার্থীরা যদি এইভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেটের সময় পার করে তাহলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে জাতি এক মেধা শূন্যতায় ভুগছে। অনলাইন দুনিয়ার করাল গ্রাস থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিশু এবং কিশোর যাদের প্রায় ১৯ শতাংশ ভিডিও গেম এবং ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে সন্তানের সাথে সময় দিতে হবে। কারণ বর্তমানে পিতা-মাতা দুজনে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার ফলে তাদের সন্তানরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে, এবং এই নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনলাইন কে তারা সঙ্গ হিসেবে বেছে নেয়। ইন্টারনেটযুক্ত স্মার্ট ফোন একটি শিশুর শুধু শারীরিক সুস্থতাকে নয় পুরো মনোজগৎ এবং মানসিক বিকাশকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে। তাই পিতা-মাতা সন্তানদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করার মাধ্যমে এই অনলাইন করাল গ্রাস থেকে সন্তান’কে রক্ষা করা একান্ত জরুরি।

লেখক: প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক।