শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, “শেখ মুজিবকে আমরা ঈর্ষা করেছি আমাদের অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। সবদিকে বড়। তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালোবাসায় এবং দুর্বলতায়, সবদিকে এবং সেই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাঁকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটি বুঝিনি যে, ঈর্ষায় পীড়িত হয়ে ঈর্ষিতের স্থান দখল করা যায় না। তাইতো এই ভূখণ্ডে মুজিবের স্থায়ী অবস্থান মধ্যগগনে এবং তাঁর নাম শুনে শোষকের সিংহাসন কাঁপে।”
আজ ১৫ আগস্ট। আজ বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে গৌরবদীপ্ত জাতি হিসেবে বাঙালি প্রতিভাত হয়। অথচ স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই জাতিই তার আপন মুক্তিদাতাকে, স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যার মধ্য বিশ্বের বুকে একটি কলঙ্কিত জাতি হিসেবে নাম লেখায়। বাংলা মায়ের কতিপয় অকৃতজ্ঞ কুসন্তানের বর্বরতায় বিশ্ববাসী স্থম্ভিত হয়, বঙ্গবন্ধুহীন বাংলার সাধারণ মানুষ হয়ে যায় দিশেহারা। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালি হারিয়েছে তাদের জাতির পিতাকে, তাদের অভিভাবককে; আর বিশ্ববাসী হারিয়েছে বঞ্চিত মানুষের মুক্তির পক্ষের উন্নতশির এক সুমহান নেতাকে।
আগস্ট আমাদের সব হারানোর মাস। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমাদের সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। যখনই আগস্ট আমাদের সামনে আসে- তখন নেমে আসে অন্ধকার। সামনে আসে এক রক্তাক্ত বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, আগস্ট আসলেই আমরা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাই।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর আদর্শের সৈনিক হিসেবে শপথ নিয়েছিলাম- যদি কেউ পিতার হত্যার প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের আহ্বান করেন, তাহলে ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সেদিন কেউ এ আাহ্বান জানায়নি। সেদিন আমরা বিছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন করেছি। যতটুকু পারি হত্যার প্রতিশোধের নেশায় প্রতিরোধের সংগ্রামে হাজির হয়েছিলাম।
সেদিন ওই ঘাতকেরা বলেছিল- বাংলার মাটিতে কোনোদিন শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার হবে না। ওই খুনিচক্ররা সেদিন বলেছিল- এমন কোনো শক্তি নেই, যারা বাংলার মাটিতে নতুন করে জয় বাংলার শ্লোগান দেয়। এমন কোনো শক্তি নেই যারা বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চাারণ করবে। সেদিন তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু নিজ কর্মগুণে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ে তিনি স্থান করে নিয়েছেন।
যেসব দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে, তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করেছিল, যারা জয় বাংলার শ্লোগান বন্ধ করেছিল, ওই খুনের বিচার হবে না বলে যারা দাম্ভিকতা দেখিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ইস্পাত-দৃঢ় নেতৃত্বে তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। আজ বাংলার ঘরে ঘরে জয় বাংলার শ্লোগানের ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। বাংলার আকাশ বাতাস কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার তারই সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত হয়েছে, বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কখনোই একক কোন ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না। ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে তিনি এক আদর্শের নাম- অনির্বাণ চেতনার প্রজ্জ্বলিত শিখা। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আর বেদনাকে ধারণ করে তিনি ছিলেন এক বিশাল মহীরুহসম ব্যক্তিত্ব; ছিলেন অধিকারহারা জাতির জেগে ওঠার সঞ্জীবনী শক্তি, এক চেতনার বাতিঘর। বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই নিজের সারাটি জীবন তিনি রাজনীতিতে উৎসর্গ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষের আস্থার মূর্তপ্রতীক।
এই আস্থা একপাক্ষিক ছিল না। এই আস্থা ছিল পারস্পরিক। বাংলার আপামর মানুষের হৃদয়নিঃসৃত অপার ভালোবাসাই ছিল তাঁর শক্তি ও সাহসের একমাত্র উৎস। প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের ভাষা বুঝে নিতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা ও মানসিকতা তাঁকে গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। তাইতো এক অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে ক্রমেই তিনি সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। রাজনীতি যদি মানুষের জন্য হয়, বঙ্গবন্ধু সারাজীবন সেই রাজনীতি করেছেন। জীবনের ১৪টি বছর কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। বাংলার মানুষের অধিকারের প্রশ্নে কখনো এতটুকু আপস করেননি।
১৯৭২ সালের ১৮ই জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে একটি সাক্ষাৎকার দেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। নিউইয়র্ক টেলিভিশনে “ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়। ওই সাক্ষাৎকারে ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, What is your qualification? আপনার যোগ্যতা কি? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, I love my people. আমি আমার দেশবাসীকে ভালোবাসি। ডেভিড ফ্রস্ট আবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, What is your disqualification? আপনার অযোগ্যতা কী? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- I love them too much. আমি তাদের বড্ড বেশি ভালোবাসি। এই বাংলার মানুষের প্রতি গভীর ও নির্মোহ ভালোবাসার প্রমাণ তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দিয়ে গেছেন। তাঁর হৃদয়ের ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতা তাঁকে মানুষ হিসেবে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। জেনেশুনে অনেক অপরাধীকে, এমনকি শত্রুকেও তিনি ক্ষমা করেছেন। তারাই একদিন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। এমনকি তাঁর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
ওই একই সাক্ষাতকারে ডেভিড ফ্রস্ট ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের প্রেফতার প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেছিলেন- সে রাতের কথা বলুন। সেই রাত যে রাতে একদিকে আপনার সঙ্গে যখন আলোচনা চলছিল এবং যখন সেই আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই রাতের কথা বলুন। আমরা শুনেছিলাম আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল কিন্তু আপনি নিজের বাড়ি পরিত্যাগ করলেন না। আপনি গ্রেফতার হলেন। কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অপর কোথাও গেলেন না এবং গ্রেফতার বরণ করলেন? কেন এই সিদ্ধান্ত?
বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরুনো না বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম পাকিস্তান বাহিনী বর্বর বাহিনী। আমি জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে ওরা দেশের সমস্ত মানুষকে হত্যা করবে। এক হত্যাযজ্ঞ ওরা সমাধা করবে। আমি স্থির করলাম, আমি মরি তাও ভালো তবুও আমার দেশবাসী রক্ষা পাক।’
পৃথিবীর অন্য যেকোনো জাতির স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেখানে যৌথ নেতৃত্ব ছিল অথবা সর্বোচ্চ নেতার কাছাকাছি প্রহণযোগ্য পর্যায়ের নেতা অনেকেই ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়ে মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতির পিতা। যদিও তাঁর পাশাপাশি পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু, সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, সুভাষ চন্দ্র বসুরা ছিলেন। গান্ধীজী ভারতের একক নেতৃত্বে ছিলেন না। আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদার ৭ জন। তাদের ৪ জন ক্রমান্বয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্টও হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এই জায়গাটিতে তিনিই নেতা এবং একমাত্র। তাঁর একটি ইশারায় সারা বাংলা এমনকি বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশিও উচ্ছ্বসিত গর্জনে কেঁপে উঠত।
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকেই বোঝা যায়, একজন রাজনৈতিক নেতা কতটা আত্মবিশ্বাস ভেতরে ধারণ করতে পারেন, মানুষের হৃদয়কে কতটা আন্দোলিত করতে পারেন। এক অভাবনীয় সম্মোহনী শক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরশ্রীকাতর একটি জাতিকে একটি সমুদ্রের মোহনায় এনে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই মাটিতে একজন শেখ মুজিবুর রহমান জন্মেছিলেন বলেই বাঙালি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখতে পেরেছিল এবং তার সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল। নেতার প্রতি পূর্ণ আস্থা না থাকলে এটা কোনভাবেই সম্ভব হতো না। কেন-না, এই মাটিতেই জন্মায় মীর জাফর, মোহাম্মদী বেগ অথবা খন্দকার মোশতাক।
তিনি কখনো বিশ্বাস করতেন না যে, কোন বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে। নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সতর্ক করতে গেলে, গভীর আত্মবিশ্বাসের সাথে তা বলেছেনও। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানিরা আমাকে হত্যা করতে সাহস পায়নি। কোন বাঙালি আমাকে হত্যা করবে না। যে কারণে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের তাঁর প্রিয় বাড়ি ছেড়ে গণভবনের সুরক্ষিত ব্যবস্থার মধ্যে তিনি থাকতে চাননি। তিনি বলতেন, আমার বাংলার সাধারণ মানুষ আর আমার কর্মীরা যতটা সহজে আমার সাথে দেখা করতে পারে, গণভবনে থাকলে তা সম্ভব হবে না। নিরাপত্তার প্রশ্নটি তিনি সবসময় উড়িয়ে দিয়েছেন। বাংলার মানুষের প্রতি তাঁর এই বিশ্বাসের মর্যাদা বাঙালি রাখতে পারল না। এই বাংলারই কতিপয় ক্ষমতালোভী বিশ্বাসঘাতকের ক্ষমতালিপ্সা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরিবারের প্রায় সকল সদস্যসহ তাঁকে জীবন দিতে হলো। পৃথিবীর ইতিহাসে আরও অনেক রাষ্ট্রপ্রধানকে আততায়ীর হাতে জীবন দিতে হয়েছে কিন্তু এমন নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ আর ঘটেনি। আর কাউকেই তাদের পরিবারের সকল সদস্যসহ এভাবে নির্বংশ করার চেষ্টা করার নজির নেই। আমরা সেই কলঙ্কিত জাতি। জাতি হিসেবে আমাদের এই কলঙ্কতিলক কোনদিনই মোছা যাবে না।
১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ আবু নাসের, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল, সুলতানা কামাল খুকী, শেখ জামাল, পারভীন জামাল রোজী এবং বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেল। শেখ মনির বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন শেখ ফজলুল হক মনি, বেগম আরজু মনি (বেগম সামসুন্নেসা)। আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, নাঈম খান রিন্টু, পোটকা (গৃহভৃত্য), লক্ষীর মা (গৃহভৃত্য)। সেদিন অন্যান্যদের মধ্যে নিহত হয়েছিলেন সিদ্দিকুর রহমান (পুলিশ কর্মকর্তা), সামছুল হক (পুলিশ কর্মকর্তা), কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ (বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা কর্মকর্তা)। শেরশাহ সুরী রোডের ৮ ও ৯ নং বাড়ি এবং শাহজাহান রোডের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ি (মর্টারের গোলার আঘাতে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে নিহত): রেজিয়া বেগম, নাসিমা, হাবিবুর রহমান, আনোয়ারা বেগম, আনোয়ারা বেগম (২), ময়ফুল বিবি, সাবেরা বেগম, আবদুল্লাহ, রফিকুল, সাফিয়া খাতুন, শাহাবুদ্দিন, কাশেদা, আমিনউদ্দিন এবং হনুফা বিবি। আহত হয়েছিলেন বেগম আবদুর রব সেরনিয়াবাত, বেগম আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, বিউটি সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, হেনা সেরনিয়াবাত। বিদেশে অবস্থানের কারণে সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
এটি স্পষ্ট যে, এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর গোটা বংশের অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল এই জাতি যেন আর কোনোদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেতনায় ঘুরে দাঁড়াতে না পারে।
১৯৮১ জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরে এসে দেশবাসীকে সাথে নিয়ে আবারও নতুন এক সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। সে সংগ্রাম- গণমানুষের অধিকার তথা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। সে সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আবার তার কক্ষপথে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। পিতা বঙ্গবন্ধুর সুমহান নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দামে অর্জিত স্বাধীন স্বদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রাম। শত ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে সেই সংগ্রামে তিনি ক্লান্তিহীনভাবে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মাধ্যমে জাতির কিছুটা দায়মোচন হয়েছে মাত্র। ওপারে বসে বঙ্গবন্ধু হয়তো তাঁর ঔদার্য দিয়ে তাঁর ঘাতকদেরও ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস কোনদিনও তাদের ক্ষমা করবে না।
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের কাজ বলে চালিয়ে দেওয়াটা মূর্খতা। ক্যান্টনমেন্টের ভিতরেই হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে অকৃতজ্ঞ জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট অনেকের এবং খুনিদের ভাষ্যে উঠে এসেছে। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বেঈমান খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে। ওই অধ্যাদেশের প্রথম অংশে বলা হয়েছে- ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।’ দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হল।’ পরবর্তীতে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান এই অধ্যাদেশকে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করে আইনি বৈধতা দেয়। এর ফলে মুসলিম লীগ জামায়াতে ইসলাম, পিডিপি, নেজামে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মের নাম ভাঙিয়ে আবার তাদের অপতৎপরতা শুরু করে। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনীর সদস্যরা রাজনীতিতে ও সমাজে পুনর্বাসিত হয়। এর সবই করা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। অথচ বঙ্গবন্ধুর কৃপায় তাকে মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে মেজর থেকে মেজর জেনারেল র্যাংক উপ-সেনাপ্রধান করা হয়েছিল। অবৈধ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে নেবার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে।
৭৫-এর ষড়যন্ত্রের কুশীলবরা এখনো সক্রিয় ও তৎপর আছে। এখন নানাদিক থেকে ৭৫-এর চেয়েও অনেক বেশি ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা সবাই জানি, বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সমগ্র বিশ্বজুড়ে একটি অর্থনৈতিক টানাপোড়েন চলছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এদেশের স্বাধীনতা ও অগ্রগতির বিরোধী শক্তিটি কায়মনে প্রার্থনা করছে, দেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হোক। একটি জাতির জন্য এরচেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। নানাবিধ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যেকোনো মূল্যে তারা আমাদের প্রাণের বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তানি ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নেবার জন্য নানাবিধ সক্রিয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও সতর্ক পদক্ষেপের কারণে তারা সফল হতে পারছে না। কাজেই আমাদেরকে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, একজন শেখ মুজিবুর রহমান জন্মায় হাজার বছরে মাত্র একবার। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলার, দুর্ভাগ্য বাঙালির- এদেশের উর্বর মাটিতে মীর জাফর বা খন্দকার মোশতাকরা যুগে যুগে জন্মায় বছর বছর জন্মায় !
১৫ আগষ্টের প্রত্যক্ষ খুনিদের বিচারিক রায় হয়েছে, কয়েকটি রায় কার্যকর হয়েছে, বিদেশে পালিয়ে থাকাদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু এখানেই সমাপ্তি ঘটলে হবে না। ১৫ আগষ্ট হত্যাকান্ডের একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশন গঠনের দাবি আমরা জানিয়ে আসছি। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ নিয়ে কথা বলেছেন। কাজেই এ বিষয়ে একটি কমিশন গঠিত হবে, এ আশা আমরা করছি। পনেরো আগষ্টের হত্যাকান্ডের মতো ঘটনায় সরাসরি এভিডেন্সই সবকিছু নয়। হত্যাকান্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক সংযোগ রয়েছে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কারা জড়িত এটা যেমন একটা ফাইন্ডিং তেমনি আরেকটা ফাইন্ডিং জরুরী- কেন জড়িত? কেন এই হত্যাকান্ড? এই হত্যাকাণ্ডে কাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা ছিল? যে সকল কারণে এই হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছিল, রাষ্ট্র ও সমাজ সেসব কারণ থেকে এখন নিরাপদ আছে কিনা সেটাও নিশ্চিত হওয়া জরুরী। ৭৫-এর ষড়যন্ত্রের কুশীলবরা এখনো সক্রিয় আছে। এখন ৭৫-এর চেয়েও অনেক বেশি ষড়যন্ত্র চলছে। কাজেই আমাদেরকে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের সকল সহযোগী ও বন্ধু সংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দেশের সাধারণ জনগণকেও এ ব্যাপারে সার্বক্ষণিকভাবে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ষড়যন্ত্রকারীদের সকল প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সংবিধানের চার মূলনীতির বিরুদ্ধে- বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে।
যে চেতনার আলোকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, সেই চেতনার পতাকাকে সমুন্নত রাখার দায়িত্ব আমাদেরকে নিতে হবে। জাতির যেকোন ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মী ও দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত প্রতিটি নাগরিক মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত অতীতের ধারাবাহিকতায় নিজেদেরকে দেশ ও জনগণের প্রতি সমর্পিত রাখবে- এই প্রত্যাশা।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।