অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের পরিচিতি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শপথ গ্রহণের নির্ধারিত সময়ে রাষ্ট্রপতি ঘোষিত বাকী ১৬ উপদেষ্টার মধ্যে ৩জন অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে প্রধান উপদেষ্টাসহ মোট ১৪ উপদেষ্টা শপথ গ্রহণ করেছেন। এক নজরে প্রধান উপদেষ্টাসহ সব মনোনীত এবং শপথবদ্ধ সব উপদেষ্টাদের পরিচয় তুলে ধরা হলো।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস:

প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারীর জোবরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি গ্রামিণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। দারিদ্র দূরীকরণে তার ‘ক্ষুদ্রঋণ মডেল’ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। এরজন্য তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ সম্মাননার তিনটি পুরস্কার— নোবেল, আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ড ও মার্কিন কংগ্রেশনাল অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত বিশ্বের ১২ জন ব্যক্তির একজন। সম্প্রতি তিনি ‘সামাজিক ব্যবসা’ শীর্ষক নতুন একটি মডেল তৈরি করেছেন। যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এশিয়ার মালয়েশিয়া ও ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়েছে। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানজনক অনেক ডিগ্রি দিয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন:

১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব বাংলার বরিশালের একটি সুপরিচিত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত। পাকিস্তানের ইসলামিয়া সায়েন্স কলেজ (করাচি) থেকে ১৯৬৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) অর্জন করেন । ১৯৭৯ সালে কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশে পাস করেন এবং পিএসসি প্রতীক (PSC) লাভ করেন। তিনি ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি কমান্ড অ্যান্ড জেনারেল স্টাফ কলেজ (USACGSC— ১৯৮১-১৯৮২) থেকে স্নাতক হন। এরপর পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৌশলগত অধ্যয়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, পাকিস্তান থেকে এনডিসি প্রতীক পেয়ে যোগ্যতা অর্জন করেন। সফলতার সাথে এমফিল ডিগ্রিও অর্জন করেন। ১৯৬৬ সালেই তিনি কাকুল থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। পরে ১৯৭২ সালে দেশের স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। বাংলাদেশ আর্মির একটি আর্টিলারি ইউনিট এবং বাংলাদেশ রাইফেলস (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এর একটি সেক্টরের নেতৃত্ব দেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ বিরোধী অভিযানে দুটি আর্টিলারি ব্রিগেড এবং একটি পদাতিক ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন। ২০০৬-২০০৮ সালের রাজনৈতিক সংকটের পর তিনি ২০০৭ সালে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনে কমিশনার হিসাবে নিযুক্ত হন এবং ২০১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক জীবন থেকে অবসরের পর থেকে তিনি নিয়মিত জাতীয় নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সম্পক ও রাজনীতি এবং নির্বাচন বিশ্লেষক ও সামরিক গবেষক হিসে খ্যাতি লাভ করেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র ও জার্নালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে কলামিস্ট হিসেবে ৩০০টিরও বেশি নিবন্ধ লিখেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৪০টির মতো বই লিখেছেন তিনি।

এ এফ হাসান আরিফ

বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ ১৯৪১ সালের ১০ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টে একজন আইনজীবী হিসেবে নথিভুক্ত হন। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে প্রাক্টিস শুরু করেন। ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। জানুয়ারি ২০০৮ থেকে জানুয়ারি ২০০৯ পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তিনি আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন সেন্টার (BIAC) এবং সার্ক আরবিট্রেশন কাউন্সিল (SARCO) এর পাশাপাশি আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব আরবিট্রেশনের কোর্ট মেম্বার।

ড.সালেহউদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শ্রীরামপুর (দরিশ্রীরামপুর) গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। দেশের এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর।

তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৬৩ সালে এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। পরে ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ অনার্স পাস করেন এবং ১৯৬৯ সালে একই বিষয়ে এমএ পাস করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির লেকচারার হিসেবে যোগ দেন।

তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) ক্যাডারে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে কানাডার হ্যামিল্টন শহরে অবস্থিত ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

ড. ফখরুদ্দীন আহমদ দায়িত্ব ত্যাগের পর তিনি ২০০৫ সালের ১ মে গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন এবং ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।

আসিফ নজরুল:

১২ জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে কুমিল্লায় জন্ম নেওয়া আসিফ নজরুলের পারিবারিকভাবে দেওয়া নাম মো. নজরুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনবিদ্যার ওপর শিক্ষালাভ শেষে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপনায় যুক্ত হন।

অধ্যাপনার পাশাপাশি আসিফ নজরুল একজন লেখক, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট। টিভি টক-শো ও তার কলামে সাহসী রাজনীতি বিশ্লেষণের জন্য তিনি বিশেষভাবে খ্যাত। তিনি দশের অধিক গ্রন্থের রচয়িতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পূর্বে ১৯৯১ সালে আসিফ নজরুল সাপ্তাহিক পত্রিকা বিচিত্রায় কাজ করতেন। তিনি কিছু সময় বাংলাদেশ সরকারের একজন সরকারি কর্মকর্তা (ম্যাজিস্ট্রেট) হিসেবেও কাজ করেছেন।

২০১২ সালের ১২ মার্চ একটি টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোতে আসিফ নজরুল তার বক্তব্যে অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে একটি রিট হয়। এরপর তাকে হাইকোর্টে তলব করা হয়েছিল।

২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অফিসকক্ষ কেরোসিন তেল দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আসিফ নজরুলকে ২০১৩ সালের মে মাসে টেলিফোন করে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ধারণা করা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করার জন্যই তাকে এই হুমকি দেওয়া হয়েছিলো। ২০১৭ সালে মাদারীপুর আদালতে আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে ৫০০ ও ৫০১ নম্বর ধারায় মানহানির মামলা করেছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের চাচাতো ভাই জেলা পরিষদের সদস্য ফারুক খান।

ব্যক্তিজীবনে আসিফ নজরুল প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে শীলা আহমেদকে বিয়ে করেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর শীলাকে বিয়ের আগে অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী ছিলেন তার প্রথম স্ত্রী। তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক কয়েক বছর স্থায়ী ছিলো।

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন:

পুরো নাম আবুল ফয়েজ মুহাম্মদ খালিদ হোসেন। একাধারে অধ্যাপক, লেখক, গবেষক, মুহাদ্দিস ও ইতিহাস-রাজনীতি বিশ্লেষক। ১৯৫৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত সাতকানিয়া উপজেলার মাদার্শা ইউনিয়নের মক্কার বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ একজন ইসলামি পণ্ডিত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের ওমরগণি এমইএস কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করেন। আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষণা বিভাগে চার বছর, জামেয়া দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়ায় ‘ওসিলাতুল ইলাম’ বিষয়ে এক অধ্যাপনা করেন। সর্বশেষ তিনি চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কুরআনিক সায়েন্সেস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করছেন। এছাড়াও এখন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জিরি মাদরাসার মুহাদ্দিস ও নায়েবে মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ এবং ওয়াআইসির পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘মুসলিম বিশ্ব লীগ’ এর মুখপাত্র ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড মুসলিম লীগ জার্নাল’সহ বিভিন্ন সাময়িকীতে তার দুই শতাধিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ইসলামী বিশ্বকোষ দ্বিতীয় সংস্করণের ৩ থেকে ৯ খণ্ড ও সীরাত বিশ্বকোষ সম্পাদনা করেছেন। তার নিজের লেখা প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টি। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকেও তিনি নিয়মিত লিখেন।

তৌহিদ হোসেন:

মো. তৌহিদ হোসেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। তার জন্ম ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার ছিলেন। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি ২০০০ সাল পর্যন্ত ফরেন সার্ভিস একাডেমির প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন। ২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ৮ জুলাই ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন। অবসরের পর দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও জার্নালে জাতীয়-আন্তর্জাতিক সম্পক, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত কলাম-নিবন্ধ লিখছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উন্নয়নের অভাবের জন্য তিনি ভারতের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেন।

আদিলুর রহমান খান:

হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন ঘিরে ২০১৩ সালে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান। তিনি মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার স্বীকৃতি স্বরুপ রবার্ট এফ কেনেডি মানবাধিকার পদক এবং গুয়াংজু মানবাধিকার পুরস্কার পান।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান:

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ‘হিরোজ অফ এনভায়রনমেন্ট’ খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশি আইনজীবী ও পরিবেশকর্মী। পরিবেশ আইনজীবী হিসেবে বাংলদেশে পরিচিত মুখ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী। চট্টগ্রামের চুনারুঘাট পৈতৃক নিবাশ হলেও তিনি জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার ধানমন্ডিতে ১৯৬৮ সালের ১৫ জানুয়ারি। রিজওয়ানা হাসান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রথমে লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হলেও আইনের প্রতি আগ্রহ থেকে বিভাগ পরিবর্তন করে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ব্যাচেলর ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে এলএলএম সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশের বাইরে বেশ কয়েকটি ফেলোশিপ কোর্স সম্পন্ন করেছেন। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আইজেনহাওয়ার ফেলোশিপ করেন সৈয়দা রিজওয়ানা। ওই বছরই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রথমবারের মতো আয়োজিত ‘পরিবেশ পুরস্কার’-এ ভূষিত হোন। তার পরিচালিত সংগঠন বেলা ২০০৩ সালে জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম ঘোষিত গ্লোবাল ৫০০ রোল অফ অনার্স পুরস্কারে ভূষিত হয়। এছাড়া প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০০৯ সালে তিনি পরিবেশের নোবেল খ্যাত ‘গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ’-এ ভূষিত হন।

মো. নাহিদ ইসলাম:

সাম্প্রতিক সময়ের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নাহিদ ইসলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে আলোচনায় আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে থাকেন। সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভতিয়ে হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে৷

নাহিদের স্থায়ী ঠিকানা ঢাকার বাড্ডা এলাকার বেরাইদ ইউনিয়নে। বদরুল ইসলাম জামির। বর্তমানে পরিবারের সঙ্গেিই রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রী এলাকায় থাকেন। গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির সদস্য সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই মুখ্য সমন্বয়ক।

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া:

আসিফ মাহমুদও সাম্প্রতিক সময়ের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির সমন্বয়ক হিসেবে আলোচনায় আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ঢাাবির বিজয় একাত্তর হলে থাকেন।

নাখালপাড়া হোসাইন আলী হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন আসিফ। বাবার নাম মো. বিল্লাল হোসেন।

আসিফ মাহমুদের স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলায়। তিনি বর্তমানে গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ফরিদা আখতার:

ফরিদা আখতার একজন লেখক, গবেষক ও আন্দোলনকর্মী। তার জন্ম চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার হারলা গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন তিনি। ছাত্রী থাকার সময় অধ্যাপক ইউনূসকে সরাসরি শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন।

বর্তমানে বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) নির্বাহী পরিচালক তিনি।

অন্যদিকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের অবস্থা জানা এবং পরিবর্তনের জন্য নীতিনির্ধারণী গবেষণা ও লেখালেখিই তার কাজের প্রধান জায়গা। নারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য সম্পদ, তাঁত শিল্প, গার্মেন্টস শিল্প ও শ্রমিক, জনসংখ্যা এবং উন্নয়নমূলক বিষয়ে নিবিড়ভাবে দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করছেন। তিনি বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘নারী ও গাছ’, ‘কৈজুরী গ্রামের নারী ও গাছের কথা’।

নূরজাহান বেগম:

নূরজাহান বেগম গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যে দায়িত্ব তিনি পেয়েছিলেন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে। এছাড়াও গ্রামীণ পরিবারের একটি অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শিক্ষার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৭৬ সালে যখন তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্প শুরু করেন তখন তিনি প্রফেসর ইউনূসের প্রথমসারির সহযোগীদের একজন ছিলেন।

তিনি বিভিন্ন দেশে মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রামের পরামর্শদাতা, প্রশিক্ষক এবং মূল্যায়নকারী হিসেবে কাজ করেছেন এবং বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মেলন এবং সেমিনারে বক্তৃতা দিয়েছেন।

তিনি গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, ইউএসএসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার বোর্ডেও দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি গ্রামীণ ফাউন্ডেশন কর্তৃক সুসান এম. ডেভিস লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ওয়ার্ল্ড সামিট মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস অ্যাওয়ার্ড ২০০৯ এবং ভিশন অ্যাওয়ার্ড ২০০৯-এ ভূষিত হন। তিনি ২০০৭ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত ফরচুন মোস্ট পাওয়ারফুল উইমেন সামিটে অংশগ্রহণ করেন এবং স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় অনুষ্ঠিত ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিস পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতি নিযুক্ত হন ২০০৭ সালে।

শারমিন মুরশিদ:

শারমিন মুরশিদ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি সমাজ কল্যাণমূলক অধিকার ভিত্তিক সংগঠন— ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সংস্থাটি ২০০১ সাল থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি বিশেষ করে আদিবাসী জনগনের অধিকার আদায়ে কাজ করে আসছে।

তিনি শেখ হাসিনা সরকারের সময় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার নানা অনিয়ম নিয়ে কথা বলেন। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে তার মতামত ও পরামর্শ গুরুত্ব সহকারে প্রচার হয়।

যারা শপথ নেননি এখনো—

ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার:

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইএমএইচ) পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার অতি সম্প্রতি অবসরে গেছেন। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ড্রাগ আসক্তি ও যৌন রোগ বিষয়ে তিনি সমাদৃত। মানসকি রোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াটিস্টস’ (বিএপি) এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

ক্লিনিকাল অনুশীলনের বাইরে, অধ্যাপক ডা. পোদ্দার গবেষণা, শিক্ষাদান ও পরামর্শের মাধ্যমে মনোচিকিৎসার উন্নতিতে সক্রিয়ভাবে অবদান রেখেছেন। গবেষক-লেখক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। তার বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সামাজিক চেতনার মনস্তত্ত্ব; এপিকুরস আধুনিকতা ও আমরা; ‘শতবর্ষে দেবীপ্রসাদ, সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং অফ্রয়েডীয় ফ্রয়েডবাদীগণ। তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি হাইস্কুল থেকে ১৯৭৯ সালে এসএসসি ও ১৯৮১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন।

ফারুক-ই-আজম:

মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র সমন্বিত যুদ্ধাভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’। সারা দেশে একই সময়ে সব বন্দরে একযোগে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে আক্রমণের জন্য ২০ সদস্যের তিনটি দল নির্বাচন করা হয়। একটি দল চট্টগ্রামে এসে পৌঁছাতে পারেনি। বাকি দুটি দলের ৩৭ জন সদস্য অংশ নেন। ওই দলের উপ-অধিনায়ক ফারুক-ই-আজম। তখন মাত্র উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন ফারুক ই আজম।

সেসময় তিনি খুলনায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তিনি চট্টগ্রামে পৌঁছান। ৬ মে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের হরিণা ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন।

এই অবস্থায় তিনি একদিন শুনলেন, নৌবাহিনীর জন্য মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা হবে। তিনি লাইনে দাঁড়ালেন। টিকে গেলেন। পলাশিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ১ আগস্ট অপারেশনের জন্য তাকে মনোনীত করা হয়। ফারুক-ই-আজম এরপর বেশ কয়েকবার অপারেশনে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত হন।

ফারুক-ই-আজম চট্টগ্রাম শহরের ১৯ মেহেদিবাগ সড়কে বাস করেন। স্ত্রী শামিম আরা বেগম। তাদের চার মেয়ে।

সুপ্রদীপ চাকমা:

সুপ্রদীপ চাকমার জন্ম ১৯৬১ সালে খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৮৫ ব্যাচের সপ্তম বিসিএসে পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী থেকে প্রথম ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন এবং পরবর্তীকালে সচিব পর্যায়ে প্রথম চাকমা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। চাকরি জীবনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রশাসন, কনস্যুলার রাজনৈতিক অনুবিভাগে এবং প্রটোকলে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বিভিন্ন শাখায় সহকারী সচিব, পরিচালক ও মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

পরবর্তীতে মেক্সিকো ও ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূত হিসেবে এবং মরক্কোর রাবাত, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস, তুরস্কের আঙ্কারা এবং শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে বাংলাদেশ মিশনেও বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন ছিলেন সুপ্রদীপ চাকমা।

সর্বশেষ গত বছর জুলাই মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে দুই বছরের জন্য সচিব পদমর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে সুপ্রদীপ চাকমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যা আগামী বছর জুলাইয়ে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।