
রাজধানীতে প্রতি ২৮ জনের জন্য আছে মাত্র একটি গাছ, যা স্বাভাবিক পরিবেশগত ভারসাম্যের তুলনায় অনেক গুণ কম। দেশে আড়াই লাখ একর বন দখল হয়ে গেছে। ২০১৫ সালের তুলনায় বনায়ন কমেছে এক লাখ একর।
রোববার (৩০ নভেম্বর) বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) আয়োজিত চার দিনব্যাপী ‘কৃষি ও খাদ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানান বন অধিদপ্তরের উপপ্রধান বন সংরক্ষক মো. জাহিদুল কবির। তিনি রাজধানীর তুলা উন্নয়ন বোর্ড মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপ করেন।
জাহিদুল কবির বলেন, প্রতিদিন একজন মানুষের কমপক্ষে ৫৫০ লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন। এ অক্সিজেন সরবরাহ করতে কমপক্ষে তিনটি পূর্ণবয়স্ক গাছ লাগে। কিন্তু ঢাকার বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, ২৮ জনের জন্য মাত্র একটি গাছ রয়েছে। আমরা ভয়াবহ সংকটের মধ্যে বসবাস করছি। মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চোরা শিকার, বনভূমি দখল, আগুন, অবৈধ নির্মাণ, ম্যানগ্রোভ বন বিনষ্টকরণ ও অনিয়ন্ত্রিত নৌযান চলাচলের কারণে বন ও বন্যপ্রাণী ক্রমাগত হুমকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের চাপও এসব বনকে নাজুক করে তুলছে।
উপপ্রধান বন সংরক্ষক জানান, দেশের বনাঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ৩৯৪ মিলিয়ন ঘনফুট কাঠসম্পদ আছে। দেশের মোট গাছের আচ্ছাদন অর্থাৎ বনভূমি ও বনভূমির বাইরে থাকা গাছ মিলিয়ে ৯৭৩ মিলিয়ন টন কার্বন ধারণ করছে। এর মধ্যে শুধু বনাঞ্চলেই রয়েছে ২৫১ মিলিয়ন টন কার্বন।
বন সম্প্রসারণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ব্যক্তি পর্যায়ে চারা বিতরণ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত চার লাখ ১৯ হাজার চারা বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। এ উদ্যোগ মানুষকে বৃক্ষ রোপণে উৎসাহিত করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের কার্বন ধারণক্ষমতা বাড়াবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বনায়নই সবচেয়ে কার্যকর ও স্বল্পব্যয়ী প্রাকৃতিক সমাধান। মানুষের আরাম-আয়েশ যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে জ্বালানি ব্যবহার ও কার্বন নিঃসরণ। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ভবিষ্যতে শিল্পঘন দেশে পরিণত হলে কার্বন নিঃসরণ আরও বাড়বে। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দূষণকারী শীর্ষ দেশের তালিকায় নেই।
তিনি বলেন, পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ রয়েছে যাদের বনায়ন ছাড়াও টিকে থাকা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষ বাস করে। অন্যদিকে বিশ্বের মোট বনভূমির প্রায় ২০ শতাংশ রয়েছে রাশিয়ার মতো দেশে, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র নয় জন। ফলে বাংলাদেশে বনভূমির ওপর চাপ বেশি এবং বননির্ভরতা আরও বেশি।
বিশ্বের অর্ধেক বনভূমি মাত্র পাঁচটি দেশ রাশিয়া, কানাডা, ব্রাজিল, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে উল্লেখ করে প্রধান বন সংরক্ষক বলেন, সেই তুলনায় বাংলাদেশের বনের অবস্থান একেবারে তলানিতে। এক শহরের জন্য ন্যূনতম ২০ শতাংশ সবুজ এলাকার কথা বলা হলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশের একটু বেশি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্টার স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রধান নির্বাহী ও গবেষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশের উর্বর পরিবেশ ও কৃষিতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অসহযোগিতা, মূল্যবোধের সংকট, বণ্টননীতির অভাব এবং সঠিক নেতৃত্বের ঘাটতির কারণে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে সিন্ডিকেট, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, চাঁদাবাজি ও দুর্বল বাস্তবায়নব্যবস্থা কৃষি, বনায়ন ও পরিবেশ উন্নয়নে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি এবং সুশাসন নিশ্চিত হলে খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু খালিদের সঞ্চালনায় সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন সভাপতিত্ব করেন।










