ফুটবলে সর্বকালের সেরারা
ফুটবল ইতিহাসের সেরা ফুটবলার কারা? ব্যাপারটি নিয়ে বিতর্কের কোনো শেষ নেই। ফুটবলাপ্রেমীদের নিরন্তর বিতর্কের উত্স এই প্রসঙ্গটি। আর সর্বকালের সেরাদের নিয়ে যদি একটি একাদশ তৈরির ব্যাপার চলে আসে তাহলে তো কথাই নেই। জামার হাতা গুটিয়ে ফুটবলপ্রেমীরা লেগে পড়বেন সেই কাজে। নিজেদের পছন্দের খেলোয়াড়দের ওই একাদশে জায়গা করে দিতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না তাদের।
বিশ্বখ্যাত ফুটবল সাময়িকী ‘ওয়ার্ল্ড সকার’ সম্প্রতি বিভিন্ন সময়ের সেরা ফুটবলারদের নিয়ে একটি একাদশ গঠন করেছে। সাময়িকীটির দাবি, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সাংবাদিক ও ফুটবল বিশ্লেষকদের ভোটে তৈরি হওয়া এই একাদশটিই সর্বকালের সেরা ফুটবল দল। বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব ফুটবল মাতানো বিভিন্ন পজিশনের ১০৭ জন ফুটবলারের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘সর্বকালের সেরা’ এই এগারো জনকে।
সর্বকালের সেরা এই ফুটবল দলটির একজন কোচও নির্বাচন করা হয়েছে। ৫৬ জন সেরা কোচের মধ্য এই দলের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে।
সর্বকালের সেরা দলের কোচ হিসেবে নির্বাচিত হতে ফার্গুসনকে লড়াই করতে হয়েছে রাইনাস মিশেলস, হোসে মরিনহো, হেলেনিও হেরেরা, পেপ গার্দিওলা, আরিগো সাচ্চি, ভ্যালেরি লেবোনোফস্কি, মারিও জাগালো, ভিসেন্তে দেল বস্ক, অটমার হিজফেল্ডদের মতো সেরাদের সঙ্গে। সদ্যই কোচিং ক্যারিয়ারকে বিদায় জানানো ফার্গুসন ‘সর্বকালের সেরা’ কোচ নির্বাচিত হয়েছেন তাঁর সাফল্য তালিকা, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব ও আধুনিক ফুটবলে তাঁর প্রভাবের বিচারে।
ওয়ার্ল্ড সকারের সর্বকালের সেরা এই দলটিতে অবশ্য মুখ চেনা ফুটবলাররাই আছেন। বর্তমান তারকাদের মধ্যে আছেন লিওনেল মেসিও। রিয়াল মাদ্রিদ ভক্তদের মনে হাহাকার তুলে দেওয়ার মতো ব্যাপারও ঘটে গেছে ওয়ার্ল্ড সকারের এই নির্বাচনে। এই দলে সুযোগ হয়নি মেসির চির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। এই একাদশে নেই হালের জাভি-ইনিয়েস্তারাও। সুযোগ পেয়েছেন পেলে-ম্যারাডোনা দুজনই। আছেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ইয়োহান ক্রুইফ, ববি মুররাও। জিনেদিন জিদান, পাওলো মালিদিনি, কাফুরা এই একাদশে সুযোগ করে নিয়ে প্রমাণ করেছেন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব। আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর অন্তর্ভুক্তি কিংবা গোলপোস্টের নিচে লেভ ইয়াসিন প্রতিনিধিত্ব করছেন ফুটবলের ‘সাদা-কালো’ সময়ের।
সর্বকালের সেরা দলটি সাজানো হয়েছে ৪-৪-২ পদ্ধতিতে
ওয়ার্ল্ড সকারের এই নির্বাচনে ‘প্যানেল’ হিসাবে অংশ নিয়েছেন ৭৪ জন ফুটবল সাংবাদিক। এঁরা বেশিরভাগই বিভিন্ন দেশে সাময়িকীটির প্রতিনিধি। টেলিগ্রাফ, রয়টার্সসহ কয়েকটি ইউরোপীয় টেলিভিশনের সাংবাদিকও ওই ৭৪ জনের নির্বাচনী প্যানেলে ছিলেন। ছিলেন জার্মানির সাবেক ফুটবলার ফ্রেডি ববিচও।
নির্বাচকদের বলা হয়েছিল ৪-৪-২ ফরমেশনে দলটি দাঁড় করাতে। ৭৪ জন প্যানেল সদস্যের প্রত্যেকেই একটি করে একাদশ জমা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে ভোটের মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়েছে এগারে জন খেলোয়াড় ও তাঁদের কোচকে।
প্রিয় পাঠক, আসুন চোখ বোলাই ‘ওয়ার্ল্ড সকারের’ একাদশটিতে। জেনে নেই বিশ্বখ্যাত এই ফুটবল সাময়িকীটির দৃষ্টিতে সর্বকালের সেরা এই ফুটবল দলে সুযোগ পাওয়া এগারো জন ফুটবল ‘গ্রেটে’র
কীর্তিগাথা:
গোলরক্ষক
লেভ ইয়াসিন
বিশ্ব ফুটবলে গোলরক্ষকদের কীর্তিগাথা বর্ণনা করতে গেলেই লেভ ইয়াসিনের নাম চলে আসবে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের এই গোলরক্ষককে সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে অনেক আগেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ১৯২৯ সালে জন্ম নেওয়া ইয়াসিন সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৬৬ বিশ্বকাপে খেলেছেন। ১৯৫৬ সিডনি অলিম্পিকে ফুটবলে সোনাও জিতিয়েছিলেন। ষাট সালে তাঁর নেতৃত্বে সোভিয়েতরা জয় করে প্রথম ইউরোপীয় ফুটবল প্রতিযোগিতার শিরোপা। দেশের হয়ে ৭৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ইয়াসিন তাঁর ফুটবল জীবনের পুরো সময়টাই কাটিয়ে দিয়েছেন ডায়নামো মস্কোয়। ডায়নামোর হয়ে সোভিয়েত সুপ্রিম লিগে ৩২৬টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ইয়াসিন ইহলোক ত্যাগ করেন ১৯৯০ সালের ২০ মার্চ।
রাইট ব্যাক: কাফু
২০০২ সালে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কাফু। অংশ ছিলেন ৯৪’র বিশ্বকাপ বিজয়ী দলেরও। ৯৮’র বিশ্বকাপেও খেলেছেন। টানা তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনালে দেশের হয়ে মাঠে নামার অনন্য কৃতিত্ব এই রক্ষণ সেনার। দেশের হয়ে ১৪২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা কাফু তাঁর ক্যারিয়ারে খেলেছেন সাও পাওলো, জারাগোজা, পালমেইরাস, এসি মিলান ও রোমায়। একজন রক্ষণ সেনাও যে দলের আক্রমণেও অনন্য ভূমিকা রাখতে পারেন, তারই স্বার্থক উদাহরণ এই কাফু।
লেফট ব্যাক: পাওলো মালদিনি
সর্বকালের সেরা একাদশ তৈরি হবে, আর পাওলো মালদিনিকে তাতে রাখা হবে না এমন হিম্মত কজন ফুটবল-বোদ্ধার আছে! ক্যারিয়ারে ২৫টি মৌসুম একই ছন্দে খেলে যাওয়া এই মালদিনি পুরো ফুটবল-জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এসি মিলানে। ৪১ বছর বয়সে ফুটবলকে বিদায় জানানোর আগে দেশের হয়ে খেলেছেন ১২৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
১৯৯০, ১৯৯৪, ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপে খেলা মালদিনি বিশ্বকাপ জয়ের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন ১৯৯৪ সালে। ব্রাজিলের কাছে টাইব্রেকারে ইতালি সেবার হেরে না গেলে হয়তো ক্যারিয়ারকে পূর্ণতা দিতে পারতেন।
সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার: ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার
অধিনায়ক হিসেবে জার্মানিকে বেকেনবাওয়ার বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে। কোচ হিসেবে ডাগ আউটে দাঁড়িয়ে জার্মানিকে আবারও বিশ্বকাপ জেতান ১৯৯০ সালে। বেকেনবাওয়ার ফুটবল ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি কোচ ও অধিনায়ক হিসেবে দেশকে বিশ্ব জয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বায়ার্ন মিউনিখ, নিউইয়র্ক কসমস ও হামবুর্গের হয়ে ক্যারিয়ারে খেলেছেন তিনি।
সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার: ববি মুর
ইংলিশদের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দেওয়া ববি মুর ইংলিশ ফুটবলের এক অবিসংবাদিত নায়ক। পেলে তাঁর ক্যারিয়ারে যতো রক্ষণসেনার বিপরীতে খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে মুরই সেরা। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপের জুলেরিমে ট্রফি হাতে মুরের ওই ‘আইকনিক’ ছবিটির জন্য নয়, ক্রীড়াশৈলির বিবেচনাতেই সর্বকালের সেরা একাদশের অন্যতম ডিফেন্ডার হিসেবে সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
১৯৪১ সালের ১২ এপ্রিল জন্ম নেওয়া ববি মুর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ১৯৯৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি।
আলফ্রেডো ডি স্টেফানো
পৃথিবীতে টোটাল ফুটবল আসার আগেই আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে ‘টোটাল ফুটবলার’ বলা হতো। অফুরন্ত দম ও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ডি স্টেফানো খেলতে পারতেন মাঠের যেকোনো জায়গাতেই।
১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পাঁচবার ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা রিয়াল মাদ্রিদের এই আর্জেন্টাইন সেনানিকে সর্বকালের সেরা এই দলে না এনে কোনো উপায়ই ছিল না ওয়ার্ল্ড সকারের নির্বাচকদের।
জিনেদিন জিদান
কারো কারো মতে, জিদানের শ্রেষ্ঠত্ব ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা পেলের কাছাকাছিই। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক দেশকে বিশ্বজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন ২০০৬ সালেও। কিন্তু সেই কুখ্যাত ‘গুঁতো’ কেলেঙ্কারিতে সেই স্বপ্নের সমাধি রচনা হলেও জিদানের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায় সুযোগ করে নেওয়া কোনো সমস্যাই নয়। বিশ্বকাপের পাশাপাশি ২০০০ সালে ফ্রান্সকে ইউরোপ-সেরা বানিয়েছিলেন আপন কারিশমায়। জুভেন্টাসের হয়ে ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করা জিদান ২০০২ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে। বেয়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে ওই ফাইনালে জিদানের পা থেকে আসা ওই গোলটিকে তো সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা
এই একাদশে ঠাঁই পাওয়াদের মধ্যে যাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই, ম্যারাডোনা তাঁদের একজন। তাঁকে অবিসংবাদিত সেরা হিসেবে মেনে নিতেও আপত্তি নেই অনেকের। সর্বকালের সেরা একাদশ তৈরি হলে ম্যারাডোনা থাকবেন না—এমন ব্যাপার বোধহয় ভাবতে পারেন না খোদ ম্যারাডোনার শত্রুও। আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জিততে ম্যারাডোনা ছিল প্রধান ভূমিকা। পরের বিশ্বকাপেও ভাঙা দল নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন একেবারে ফাইনালে। জীবনভর বিতর্কের কেন্দ্রে থাকলেও তাঁর প্রতিভা নিয়ে কোনো বিতর্কই নেই।
ঈশ্বর-প্রদত্ত প্রতিভার সর্বোত্তম উদাহরণ ম্যারাডোনা আছেন ওয়ার্ল্ড সকারের এই দলটিতেও। ম্যারাডোনার কীর্তি গাঁথার সাক্ষী হয়ে আছে নাপোলির সোনালি অতীতও।
ইয়োহান ক্রুইফ
টোটাল ফুটবলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইয়োহান ক্রুইফের একটা জায়গা বরাদ্দই থাকে যেকোনো নির্বাচিত একাদশে। ফুটবলকে অন্যস্তরে নিয়ে যাওয়ার কৌশলের উদ্ভাবক ক্রুইফ ফুটবল ইতিহাসেরই সর্বকালের সেরা।
দুর্ভাগ্য তাঁর, পরপর দুবার হল্যান্ডকে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে গেলেও বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটি হাত দিয়ে দেখা হয়নি। তারপরেও ক্রুইফকে অবিসংবাদিত সেরা বলতে বোধহয় আপত্তি হবে না কারোরই।
পেলে
ম্যারাডোনা, ক্রুইফ, জিদানের মতোই যেকোনো নির্বাচিত একাদশে পেলে চলে আসবেনই অবিসংবাদিতভাবেই। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার তিনি কিনা, এ নিয়ে তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়ে পড়ার লোকেরও অভাব নেই।
দেশের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জেতা পেলে ব্রাজিলীয় ফুটবলের অন্যতম বিজ্ঞাপনও বটে। ওয়ার্ল্ড সকারের নির্বাচিত সর্বকালের সেরা একাদশে তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলে আসে পেলের নাম।
লিওনেল মেসি
এই একাদশের একমাত্র হাল আমলের খেলোয়াড়। ফুটবলীয় জাদুতে যিনি মাতিয়ে চলেছেন বিশ্বকে। দেশ আর্জেন্টিনাকে তেমন কিছু জেতাতে না পারলেও বার্সেলোনার হয়ে তিনি সম্ভব-অসম্ভব সব কীর্তিই গড়ে ফেলেছেন। ইতিহাসের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে টানা চারবারের ফিফা বর্ষসেরা হয়েছেন।
এই চার বছরে মেসি যা করেছেন, সেটি বোঝাতে প্রয়োজন অসংখ্য বিশেষণ আর বিস্ময়বোধক চিহ্ন। সূত্রঃপ্রথম আলো