ফুটবল ও বাংলাদেশ

ফুটবল ও বাংলাদেশ

ফুটবল  এগারো জনের দুটি দুলের মধ্যে একটি বায়ুপূর্ণ চামড়ার বলকে পা ও মাথার সাহায্যে পরস্পরের গোলসীমানার দিকে নিক্ষেপের খেলা।

বাংলাদেশে ফুটবল বলতে অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল বা সকারকেই বোঝানো হয়ে থাকে। ফুটবল মাঠ আয়তাকার এবং দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে তার মাপ ৯০-১১০ মিটার × ৪৫-৯০ মিটার। মাঠের দুইপ্রান্ত রেখা বা গোললাইনের মাঝামাঝি স্থানে ৭.৩২ মিটার ব্যবধানে দুটি খুঁটি বা গোলপোস্ট থাকে। গোলপোস্টের উচ্চতা ২.৪৪ মিটার এবং এর ওপরে আড়াআড়িভাবে একটি ক্রসবার থাকে। প্রতিটি গোলপোস্ট থেকে ৫.৫ মিটার দূরত্বে স্থাপিত এবং ৫.৫ মিটার দীর্ঘ দুটি সরল রেখাকে আরেকটি সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করে চিহ্নিত করা হয় গোল এরিয়া। একইভাবে গোলপোস্ট থেকে ১৬.৫ মিটার দূরত্বে চিহ্নিত এলাকাকে বলা হয় পেনাল্টি এরিয়া। একটি আদর্শ ফুটবলের পরিধি ৬৮.৫-৭১ সেন্টিমিটার এবং এর ওজন ৪০০ থেকে ৪৫০ গ্রাম। মাঠের খেলায় প্রত্যেক দলে এগারো জন করে খেলোয়াড় থাকেন। এদের মধ্যে একজন থাকেন গোলকিপার, নিজেদের পেনাল্টি সীমানার ভেতর তিনিই কেবল হাত দিয়ে বল ধরতে পারেন। এক পক্ষের গোলবারের ভিতর দিয়ে বল চলে গেলে প্রতিপক্ষ একটি গোল পায়। এভাবে ৯০ মিনিটের খেলায় যে পক্ষ বেশি গোল পায় তাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। বল মাঠের বাইরে গেলে লাথি মেরে বা হাত দিয়ে নিক্ষেপ করে আবার খেলা শুরু করতে হয়। খেলা পরিচালনার জন্য একজন রেফারি ও দুজন সহকারী রেফারি থাকেন।

ফুটবল খেলা কোন দেশে কখন প্রথম চালু হয় সে সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা একমত নন। কেউ বলেন চীন, কেউ গ্রিস, কেউ রোম, কেউবা ইংল্যান্ডকে ফুটবল খেলার আবিষ্কারক মনে করেন। তবে রোমানরাই ফুটবল খেলাকে ইউরোপের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় এবং এ খেলার বিস্তৃতি ও জনপ্রিয়তা দান করে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফুটবল ইংল্যান্ডে প্রবেশ করার পর থেকে এর প্রচার, প্রসার ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৮৪৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম ফুটবলের জন্য আইন-কানুন প্রণয়ন করে। পরবর্তীকালে এর আরও পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন ঘটে এবং ফুটবলের জন্য একটি পরিপূর্ণ নীতিমালা তৈরি হয়। তাই ইংল্যান্ডকে আধুনিক ফুটবলের জনক বলা হয়। তারাই ফুটবলকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় এবং জনপ্রিয় করে তোলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পৃথিবীতে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ১৯০৪ সালের ২১ মে প্যারিসে ইউরোপের ৭টি দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠকে ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল দ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ফিফা) গঠিত হয়। ১৯৩০ সালে আয়োজন করা হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের। উরুগুয়ে প্রথম বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে। অলিম্পিকে ফুটবল অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯০৮ সালে, এশিয়ান গেমসে ১৯৫১ সালে, ইউরোপিয়ান কাপ চালু হয় ১৯৬০ সালে, বিশ্ব ক্লাবকাপ ১৯৬০ সালে এবং এশিয়ান ক্লাব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ১৯৬৭ সালে।

বিশ্ব ফুটবলে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য যাদের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্রাজিলের পেলে, আর্জেন্টিনার দিয়াগো ম্যারাডোনা, নেদারল্যান্ডসের ইয়োহান ক্রুইফ, হাঙ্গেরির ফেরেংক পুসকাস, জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনি, পর্তুগালের ইউসেবিও, ইংল্যান্ডের স্ট্যানলি ম্যাথুজ, প্রমুখ। মহিলা ফুটবলারদের মধ্যে রয়েছেন ইংল্যান্ডের বেভারলি রেঞ্জার, যুক্তরাষ্ট্রের মিয়া হ্যাম প্রমুখ।

ভারতীয় উপমহাদেশের ফুটবল খেলা প্রথম চালু করে ইংরেজরা। ঐতিহাসিকরা দাবি করেন যে, মৌর্য রাজত্বকালে সেলুকাসের দূত মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্রে বা পাটনায় এসে স্বচক্ষে এই খেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখেছিলেন। এদেশে ইংরেজ বণিকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ খেলোয়াড় ও সৈনিক ফুটবলদল সুশৃঙ্খলভাবে ফুটবল খেলার চর্চা করে এবং তাদের প্রচেষ্টাতেই ফুটবল খেলা উপমহাদেশের ক্রীড়াজগতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮২১ সালে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত মিলিটারি বনাম মুম্বাই আইল্যান্ডের খেলাটিকে উপমহাদেশের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসেবে গণ্য করা হয়। এ জন্য মুম্বাইকে উপমহাদেশের ফুটবলের জন্মভূমি বলা হয়। অনেকের মতে মুম্বাইয়ের আগে এলাহাবাদ, কলকাতা ও ঢাকায় ফুটবল প্রচার লাভ করে। বস্ত্তত, ১৮৯৩ সাল থেকে ঢাকা ও কলকাতায় বাঙালিদের মধ্যে ফুটবল খেলার উদ্দীপনা ও উৎসাহ দেখা দেয় এবং একই বছর আইএফএ শিল্ডের খেলা শুরু হয়।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ফুটবল নতুন উদ্যমে শুরু হয়। ফুটবলের উন্নয়নের জন্য গঠিত হয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বাফুফের তত্ত্বাবধানে ১৯৭২ সালে ঢাকায় ফুটবল লীগ শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে জাতীয় ফুটবল ও ১৯৭৪ সালে জাতীয় যুব ফুটবল শুরু হয়। ১৯৮০ সালে শুরু হয় ফেডারেশন কাপ ফুটবল। ২০০৭ সালের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের ফুটবল কাঠামো মূলত অপেশাদার ছিল, তখন ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ফুটবল লিগই ছিল দেশের সেরা ঘরোয়া আসর। ২০০৭ সাল থেকে চালু হয়েছে পেশাদার ফুটবলের আসর। শুরুতে এ টুর্নামেন্টের নাম ছিল বি-লিগ, তবে ২০১০ সাল থেকে এ আসরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ লিগ। দেশের ফুটবল ক্লাবগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, আবাহনী ক্রীড়া চক্র লিমিটেড, ব্রাদার্স ইউনিয়ন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের উদ্যোগে এক সময় প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ নামে একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়মিত আয়োজন করা হতো। এছাড়া বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ নামেও একটি টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়েছে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তীযুগ থেকে নিয়মিত আয়োজিত হতো আগা খান গোল্ড কাপ নামে একটি ক্লাবভিত্তিক টুর্নামেন্ট। বর্তমানে এসব টুর্নামেন্ট আর আয়োজিত হয় না। তবে বাংলাদেশ সার্ক অঞ্চলের দেশগুলিকে নিয়ে আয়োজিত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট সাফ ফুটবল এবং ফিফা ও এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) আয়োজিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশ নেয়। বাংলাদেশের ক্লাবগুলি অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় এএফসি প্রেসিডেন্টস কাপ টুর্নামেন্টে। ১৯৯৯ এবং ২০১০ সালের দক্ষিণ এশিয়ান গেমস-এ ফুটবলে স্বর্ণপদক এবং ২০০৩ সালের সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় ফুটবলে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য।  সূত্রঃ বাংলাপিডিয়া