এশিয়ার পশ্চিমে ইউরোপ ও আফ্রিকার প্রান্তঘেঁষে অবস্থিত ১৪টি দেশের সম্মিলিত ভৌগোলিক নাম মধ্যপ্রাচ্য। আরব সাগরের প্রান্তে অবস্থিত শুষ্ক, মরুভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চলপ্রধান এ দেশগুলো হলো ইরান, ইরাক, বাহরাইন, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, ওমান, ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, কাতার, ইয়েমেন, সিরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। সভ্যতার শুরু থেকে আজ অবধি বহমান বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই মধ্যপ্রাচ্য। প্রথম ভাষা আবিষ্কার থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু দালান বুর্জ খলিফা- এই অঞ্চলেই। আরব বসন্তের এলাকা থেকে কূটনৈতিকভাবে কাতারকে এক রকম আলাদা করে দেওয়ার এই মধ্যপ্রাচ্যের একাল-সেকাল নিয়ে জানাচ্ছেন- ফয়সাল চৌধুরী স্বরূপ
সুদূর অতীত
মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) সুমেরিয়ানদের হাত দিয়ে এ অঞ্চলে সভ্যতার শুরুটা হয়েছিল প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে সময় প্রায় পুরো মধ্যপ্রাচ্য শাসন করে আসিরীয় সাম্রাজ্য। সর্বপ্রথম লিখিত ভাষার প্রচলন করে এই সুমেরিয়ানরাই। খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকের শুরুর দিকে পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায় এই বিশাল অঞ্চল। এরপর থেকে দ্রুতই হাতবদল হতে থাকে ক্ষমতার।
আলেকজান্ডারের ম্যাসেডনীয় সাম্রাজ্যের পর আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল ছিল রোমান, পার্থিয়ান ও সাসানীয়দের দখলে। ম্যাসোডনীয় সাম্রাজ্য সর্বপ্রথম গ্রিক ভাষা ও সংস্কৃতি এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা সে সময় থেকে শুরু হতে থাকে সক্রিয়ভাবে। রোমান সাম্রাজ্য যা এখন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য নামে পরিচিত, সে সময় এ অঞ্চলে খ্রিস্টান ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যে আলেক্সান্দ্রিয়া, ইরানের মতো অঞ্চল খ্রিস্টান পা-িত্যের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। খ্রিস্টাব্দ সাত শতক পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য খ্রিস্টানদের অধীনে ছিল।
মুসলিম শাসনামল
সাত শতক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিমরা নতুন শক্তি হিসেবে বাইজেন্টাইন রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য দখল করতে থাকে। দ্রুত মুসলিম বিজয়ের ধারায় আরব সৈন্যবাহিনী ইসলামে অনুপ্রাণিত হয়ে খলিফাদের নির্দেশে দক্ষ সামরিক সেনাপতিরা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় আরব সাম্রাজ্যের অধীনে আসে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগর এলাকার অধিকাংশ দখল। প্রায় ৪০০ বছরে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে এ অঞ্চলে। ১১ শতকে মধ্য এশিয়ার তুর্কিরা বর্তমান ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন জয় করলে মুসলিমদের কর্তৃত্ব শেষ হয়ে যায়। এ সময় মধ্যপ্রাচ্য দখলে নামে ইউরোপীয়রাও। তবে তুর্কি ও অন্যান্য শক্তি হটিয়ে ১৩০০ শতকে উসমানীয় সাম্রাজ্য ক্ষমতা দখল করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এ বিস্তর অঞ্চল শাসন করে। বিশ্বের ইতিহাসে উসমানীয় সাম্রাজ্য ছিল, তবে ১৭ শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ইউরোপীয়রা এসব অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
বিংশ শতাব্দীতে হাওয়া বদল
১৯০৮ সালে ইরানে এবং পরে সৌদি আরব, লিবিয়া ও আরব বিশ্বের অন্য দেশগুলোয় ভূগর্ভস্থ তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। মধ্যপ্রাচ্য পরিণত হয় অশোধিত তেলের বিশ্বের বৃহত্তম সহজে প্রবেশযোগ্য মজুদে। ইউরোপ-আমেরিকা তথা পশ্চিমা দেশগুলো ঘাঁটি গাড়ে এসব দেশে। শিল্প উন্নয়নের জন্য প্রায় সব তেল রপ্তানি শুরু হয়, এতে এসব অঞ্চলের শাসকরাও প্রচুর ধনী হয়ে ওঠে। বিনিময়ে তেল ছাড়াও পশ্চিমারা পায় এসব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের পরোক্ষ ক্ষমতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে উসমানি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চলতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের নিয়ে ফিলিস্তিন ভূখ-ে পৃথিবীর একমাত্র স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত এবং আমেরিকা-সোভিয়েতের স্নায়ুযুদ্ধের জের ধরে বিভিন্ন সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়ায়। যার মধ্যে ১৯৪৮-এ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, ১৯৫৬-এ সুয়েজ যুদ্ধ, ১৯৮০ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ারে হামলার পর জঙ্গি উৎখাতের জন্য আমেরিকা ২০০১তে আফগানিস্তান ও ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণ শুরু করে। পরবর্তী সময় মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করলেও ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে এখনো সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধ চলছে। সমাধান হয়নি ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের সংঘাত।
আরব বসন্ত ও তারপর
স্বৈরতন্ত্র, সরকারি দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বেকারত্ব ও চরম দারিদ্র্যের অভিযোগে ২০১০ সালে গণবিক্ষোভের শুরু তিউনিসিয়ায়, এরপর মিসরে। তারপর তা লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। প্রথমে মিসরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পতন হয়। পরে লিবিয়ায় মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি জামানার অবসান হয়। এ পর্যন্ত আলজেরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, মিসর, ইরান, জর্ডান, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ায় বড় ধরনের বিদ্রোহ হয়েছে এবং ইরাক, কুয়েত, ওমান, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান ও সিরিয়ায় ছোট আকারের ঘটনা ঘটেছে। আরব বিশ্বের এই গণ-অভ্যুত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে এবং সরাসরি আঘাত হেনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কের পতন ঘটায়। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়া এই বিপ্লবকে পশ্চিমা গণমাধ্যম আরব বসন্ত নামে অভিহিত করে। তবে আরব বসন্তের পরও এসব দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সিরিয়া, ইয়েমেন, মিসরসহ আরব বসন্তে অংশ নেওয়া কোনো দেশেই স্থিতিশীলতা বা শান্তি নেই, বরং লেগে আছে সংঘাত, সংঘর্ষ আর গৃহযুদ্ধ। সম্প্রতি কাতারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মধ্যপ্রাচ্যকে আরেক দফা অশান্ত করে ফেলেছে অন্যান্য আরব জোট রাষ্ট্র।
সূত্র: আমাদের সময়