মুসলমানদের কিবলা কী এবং কীভাবে নির্ধারণ করা হয়

মুসলমানদের কিবলা কী এবং কীভাবে নির্ধারণ করা হয়

মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় কাজগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রতিদিন পাঁচবার নামাজ আদায় করা। আর নামাজ আদায়ের জন্য অন্যতম পূর্বশর্ত হলো কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো। ছোট থেকেই পশ্চিম দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে অভ্যস্ত হবার কারণে এবং কিবলা নিয়ে বিস্তারিত না জানার কারণে দেশের বাইরে গেলে বা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। আবার অনেক সময় প্রশ্ন জাগে, মেরু অঞ্চলে কিংবা মহাকাশে গেলে কিবলা কোনদিকে হব। কেননা মেরুবিন্দুতে তো সবদিকই হয় উত্তর না হয় দক্ষিণ। চলুন জেনে নেয়া যাক কিবলা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।

কিবলা বলতে কী বোঝায়

কিবলা হচ্ছে নামাজের জন্য মুসলমানদের যেদিকে মুখ করা দাঁড়াতে হয়, সেই দিকটি। অনেক ধর্মেই উপাসনার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিক থাকে। সেরকমই মুসলমানদের জন্য কিবলা হচ্ছে মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম, যা কাবা শরিফ নামে বেশি পরিচিত। তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রথমে কাবা শরিফ কিবলা ছিল না। বরং প্রথম কিবলা ছিল জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা। মদীনায় হিজরতের ষোল মাস পর কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী কিবলা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের কিবলা অর্থাৎ কাবা শরীফ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়।

 “নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর। যারা আহলে-কিতাব, তারা অবশ্যই জানে যে, এটাই ঠিক পালনকর্তার পক্ষ থেকে। আল্লাহ বেখবর নন, সে সমস্ত কর্ম সম্পর্কে যা তারা করে।” (সুরা বাকারা: ১৪৪)

কিবলা কখন কোন দিকে

সুরা বাকারার ১৪৪ নং আয়াত থেকেই এটি পরিষ্কার যে, কিবলা হচ্ছে সেদিকে যেদিকে রয়েছে মসজিদে হারাম অর্থাৎ কাবা। এখানে কিন্তু কোনো দিক নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। কাবা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম দিকে থাকায় কিবলাকে কিবলা না বলে পশ্চিম দিক বলেই ডাকা হয়। কিন্তু কিবলা মানে পশ্চিম দিক না, এটি মনে রাখা জরুরি। কিবলা কখন কোন দিকে এটি আলোচনা করার আগে ভূগোল নিয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার।

পৃথিবী গোলাকার এই তথ্যটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সবাই পড়ে। যদিও নিখুঁত গোলাকার না, তবে বোঝার সুবিধার্থে গোলাকার বলা হয়। সাধারণত যে ধরণের মানচিত্র দেখে আমরা অভ্যস্ত সেগুলো বাস্তবে মহাদেশগুলো সেভাবে অবস্থিত নয়। এ ধরণের মানচিত্র তৈরি করা হয় প্রজেকশনের মাধ্যমে। একটি গ্লোবকে একটি সিলিন্ডারের মধ্যে ঢুকিয়ে যদি গ্লোবের সবকিছুর ছায়া সিলিন্ডারের উপর নেয়া যার, তারপর সিলিন্ডারটিকে কেটে সমতল বানালে যে মানচিত্র পাওয়া যাবে সেটির সাথে আমরা বেশি পরিচিত।

কিন্তু মনে রাখা জরুরি যে, দেখতে সমতল হলেও বাস্তবের পৃথিবী কিংবা গ্লোবের পৃথিবী বেশ আলাদা। দ্বিমাত্রিক সমতল তলে ত্রিমাত্রিক গোলাকার পৃথিবীর বিভিন্ন রকম প্রজেকশন ব্যবহার করে বেশ কয়েকরকম মানচিত্র আছে। আলোচনার জন্য প্রয়োজনীয়গুলো জায়গামতো আলোচনা করা হবে। সাধারণ সমতল মানচিত্রে এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকা থেকে কিবলা নির্ধারণ খুব একটা কঠিন না। নিচের ছবির মানচিত্রটি খেয়াল করুন।

এ মানচিত্র অনুযায়ী এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপের যে কোনো জায়গা থেকে কাবার দিকে একটি সরলরেখা টানুন। সরলরেখাটি যেদিকে সে স্থানের কিবলা মোটামুটি সেদিকেই হবে, কয়েক ডিগ্রী এদিক সেদিক হতে পারে পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির জন্য। কিন্তু উত্তর আমেরিকা থেকে বিশেষ করে কানাডা, আলাস্কা থেকে কিবলা নির্ধারণে আপনাকে গোলাকার পৃথিবীর আকৃতির কথা মাথায় আনতে হবে বেশ গুরুত্ব দিয়ে। সমতল ম্যাপে এসব এলাকা থেকে কিবলা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। কিন্তু পৃথিবী তো সমতল না। সুতরাং এসব জায়গা থেকে কিবলা নির্ধারণ করতে হবে কিছুটা ভিন্নভাবে।

উপরের মানচিত্রটি থেকে গোলাকার পৃথিবীকে সমতলে রাখলে কোন স্থান কোন দিকে ফিরে থাকতো তার ধারণা পাওয়া যায়। সাধারণ সমতল মানচিত্র অনুযায়ী আলাস্কা কিংবা উত্তর আমেরিকার অন্যান্য জায়গা থেকে কিবলা দক্ষিণ-পূর্ব মনে হলেও বাস্তবে কিবলা উত্তর কিংবা উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত! সাধারণ সমতল মানচিত্রের ধারণা থেকে বের হতে না পারলে এটি পুরোপুরি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে আমেরিকা থেকে কিবলা উত্তর কিংবা উত্তর-পূর্ব দিকেই হয়ে থাকে। [১]

এছাড়া ১৯০৯ সালে মিশরে কাজ করার সময় জেমস ক্রেইগ কিবলা নির্ধারণ সহজ করার জন্য একটি বিশেষ প্রজেকশন তৈরি করেন। এটিকে ‘ক্রেইগ রেট্রোজিমিউথাল প্রজেকশন’ বা ‘মক্কা প্রজেকশন’ বলা হয়। এ ম্যাপ দিয়ে পৃথিবীর যেকোনো জায়গাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য জায়গাগুলো কোন দিকে অবস্থান করে সেটি দেখানো হয়। [২] এর সাহায্যেও উত্তর আমেরিকার যেকোনো জায়গার কিবলা সহজে বের করা যায়।

কিবলা নির্ধারণে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে দূরত্ব। কোনো জায়গা থেকে মক্কার সর্বনিম্ন দূরত্বের দিকটিকে কিবলা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এখানেও একটি ব্যতিক্রম আছে। মক্কার প্রতিপাদ বিন্দু প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত, যেখান থেকে মক্কার দূরত্ব সব দিকে সমান। মজার ব্যাপার, সে জায়গায় কোনো দ্বীপ নেই, পুরোটাই পানি। ফলে সেখানে দূরত্বের নিয়ম অনুসরণ না হয়ে ভ্রমণের নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।

সূর্য ব্যবহার করে কিবলা নির্ধারণের উপায়

সূর্যকে ব্যবহার করে খুব সহজে কিবলা বের করা যায়। প্রতি বছর ২৮ মে গ্রিনিচ সময় সকাল ৯ টা ১৮ মিনিট এবং ১৬ জুলাই গ্রিনিচ সময় সকাল ৯ টা ২৭ মিনিটে সূর্য ঠিক কাবার উপরে অবস্থান করে অর্থাৎ সূর্য আর কাবা একই সরলরেখায় অবস্থান করে। এ সময়ে একজন নিজ অবস্থান থেকে সূর্য যেদিকে দেখব সেদিকেই হবে তার কিবলা। একইভাবে ২৮ নভেম্বর গ্রিনিচ সময় রাত ৯ টা ৯ মিনিটে এবং ১৩ জানুয়ারি গ্রিনিচ সময় রাত ৯ টা ৯ মিনিটে সূর্য থাকে মক্কার প্রতিপাদ বিন্দুর ঠিক উপরে। এ সময় যে জায়গা থেকে সূর্য দেখা যায় তার ঠিক উল্টো দিকে কাবা অবস্থিত। এভাবেও কিবলা কোনদিকে তা নির্ধারণ করা যায়। সূর্যের এই অবস্থান করাকে আবার মিরাকেল মনে করবেন না, কেননা ২৩.৫ ডিগ্রী উত্তর অক্ষরেখা থেকে ২৩.৫ ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষ রেখার মাঝামাঝি কোনো না কোনো জায়গার ঠিক উপরে প্রতি মূহুর্তে অবস্থান করে।

কিন্তু এখানেও একটি সমস্যা থেকে যায়। যে সময় সূর্য কাবার ঠিক উপরে অবস্থান করে, সে সময় পৃথিবীর সব জায়গায় দিন থাকে না স্বাভাবিকভাবেই। আবার দিন থাকলেও খারাপ আবহাওয়ার জন্য সূর্য নাও দেখা যেতে পারে। তবে গণিত আর ভূগোলের জটিল হিসেবনিকেশ করে কিবলা বের করা যায়। এই পদ্ধতি প্রায় হাজার বছর আগে মুসলিম গণিতবিদরাই বের করেছেন। তাছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন কিবলা কম্পাস পাওয়া যায়, যা দিয়ে সহজেই অজানা জায়গায় কিবলা খুঁজে বের করা যায়।

যারা সমতল পৃথিবীতে বিশ্বাসী তাদের জন্য

অসংখ্য প্রমাণের পরেও কিছু মানুষ এখনো মানতে রাজি না পৃথিবী গোলাকার। আপনি যেই যুক্তি দেখান না কেন, তারা মানতে রাজি না। তাদের জন্য দুটি উপায় আছে। তবে এর জন্য আরেকজনের সাহায্য লাগবে।

১. উপরে উল্লেখিত তারিখ ও সময়ে (মক্কার সময় GMT +3) মক্কায় যান বা ফোন দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন সূর্য কাবার ঠিক উপরে কিনা।

২. একইসময়ে উত্তর আমেরিকার কোনো জায়গায় যান বা ফোন দিয়ে নিশ্চিত হন সূর্য কোন দিকে উঠছে।

চাইলে Stellarium সিমুলেটর ব্যবহার করে নিজেই ঘরে বসে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। নিচের ছবি দুইটি এই সিমুলেটরের সাহায্যে নেয়া।

মেরু বিন্দুতে কিবলা

যদি মেরুতে থাকি, তাহলে কোন দিকে মুখ ফেরাতে হবে? উত্তর মেরুতে গেলে সব দিকেই দক্ষিণ আবার দক্ষিণ মেরুতে গেলে সবদিকেই উত্তর। সুতরাং গোলমাল মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু মেরুবিন্দুতে যখন থাকবেন তখন দিক নয় বরং আপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে কাবার দূরত্ব। কারণ আপনি সব দিকে দিয়েই আপনি যেতে পারবেন কাবায়, কিন্তু মেরু বিন্দুতে দিকের সাথে সর্বনিম্ন দূরত্বের ব্যাপারটি হিসেবে আনতে হবে। যেদিকে মুখ করলে সর্বনিম্ন দূরত্ব হয় সেদিকটিই হবে মেরু বিন্দুর কিবলা। মেরুতে সাধারণ চৌম্বক কম্পাস কাজ করবে না। সেখানে আপনাকে জাইরোস্কোপ নামের চুম্বকবিহীন একধরণের কম্পাস এবং তারার অবস্থান হিসেব করে কিবলা ঠিক করতে হবে। একই নিয়ম দক্ষিণ মেরুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

ভ্রমণের সময় কিবলা

এতোক্ষণ পর্যন্ত স্থির অবস্থায় কিবলার কথা আলোচনা করা হলো। ভ্রমণের সময় কিবলা নির্ধারণ করা একটু কঠিনই বটে, কেননা রাস্তা আঁকাবাঁকা থাকে। আবার আকাশপথে ভ্রমণের সময় দিক বোঝা তো আরো কঠিন। ভ্রমণের সময় যদি ভ্রমণ বিরতি দিয়ে নামাজ পড়া যায়, তাহলে তো সহজেই স্থানীয় কিবলা অনুসরণ করা যায়। কিন্তু যদি ভ্রমণ বিরতি নেয়া না যায়, তবে কাউকে জিজ্ঞাসা করে বা কম্পাস ব্যবহার করে কিবলা নির্ধারণ করে নামাজ শুরু করলেই হবে। যদি এটাও সম্ভব না হয়, তাহলে যেদিকে কিবলা হতে পারে মনে হয় সেদিকে ফিরেই নামাজ শুরু করা যাবে।

মহাকাশে কিবলা

এতক্ষণ যতো নিয়ম কানুন আলোচনা করা হলো সেগুলো সব পৃথিবীতে থেকে। যদি কোনো মহাকাশচারী মহাকাশে থাকা অবস্থায় নামাজ আদায় করতে চান, তাহলে তিনি কীভাবে তা করবেন? এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তের জন্য ২০০৬ সালে মালয়শিয়ান ন্যাশনাল স্পেস এজেন্সি একটি কনফারেন্সের আয়োজন করে বিজ্ঞানী ও আলেমদের নিয়ে। এই কনফেরেন্সে সিদ্ধান্ত হয় মহাকাশচারী তার ক্ষমতা অনুযায়ী কিবলা নির্ধারণ করবে। এই ব্যাপারে আরো একটা মত আছে, সেটা হল মহাকাশচারী পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকলেই হবে।

ফুটনোট

১. Abdali, S. Kamal (1978). Prayer Schedules for North America, American Trust Publications, Indianapolis.

২. Lev M Bugayevskiy; John Parr Snyder (1995). Map Projections: A Reference Manual. Bristol: Taylor and Francis. p. 133  তথ্যসূত্রঃroar.media