সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ মনসুর এবং কামারুজ্জামান এই চারটি নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জল।১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে ঘাতকের ব্রাশ ফায়ারে নিহত হন এই মহান নেতারা। স্বাধীন বাংলাদেশের এই চার সূর্যসন্তানদের পারিবারিক তথ্য ও রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার
বাংলাদেশের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি এবং মুক্তিযুদ্ধকালে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের পাঁচ সন্তানের মধ্যে একমাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। তার অন্য চার সন্তানের মধ্যে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম ও সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ব্যবসা করছেন, এ ছাড়া দুই মেয়ের কেউ-ই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর পর দীর্ঘদিন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দলীয় কার্যক্রমে দৃশ্যমান সক্রিয় ছিলেন না তিনি।২০০৭ সালে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়ে দলের হাল ধরেন। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন পর পর দুই কাউন্সিল অধিবেশনে। এ সময়ে রাজনীতিবিদদের নিয়ে জনমনে নানা নেতিবাচক মনোভাব থাকলেও আওয়ামী লীগের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ সম্মানের জায়গা তৈরি করতে পেরেছেন তিনি।
শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম বলেন: জেল হত্যাকাণ্ডের পর তাদের পরিবারের অবস্থা বেশ নাজুক ছিল। তিনি জানান তাদের বরাদ্দকৃত সরকারি বাড়িটির ভাড়া নির্ধারণ করা হয় প্রায় ১ লাখ টাকা। ভাড়ার পরিমাণ এত বেশি নির্ধারণ করা হয়েছিল যে, তাদের পরিবারের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব ছিল না। নিরুপায় হয়েই মা দুই বোন এক ভাইকে নিয়ে ময়মনসিংহে অবস্থান নিয়েছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আগাগোড়াই একজন তুখোড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন, মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি ও ছেলে তানজীব আহমদ সোহেল তাজ সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তাজউদ্দীনের অন্য দুই মেয়ে নিজেদের রাজনীতিতে জড়াননি। জোহরা তাজউদ্দীন মারা গেছেন ২০১৪ সালে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলে ছত্রভঙ্গ আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক কাঠামের ওপর দাঁড় করানোর জন্য আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেনাশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করেন এবং প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে মিলাদের আয়োজন করেন।
তাজউদ্দিনের একমাত্র ছেলে তানজীম আহমদ সোহেল তাজ গাজীপুর থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সংসদ সদস্যপদ এবং মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান। পরবর্তী সময়ে ওই আসনে তার বড় বোন সিমিন হোসেন রিমি উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দশম জাতীয় সংসদেও রিমি নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। জাতীয় চার নেতার অন্য কারও পরিবারের এত সদস্য সক্রিয় এবং আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হননি।
এম মনসুর আলীরের পারিবার
বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর এম মনসুর আলীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তার দুই ছেলে ও এক নাতি রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। এম মনসুর আলীর তিন ছেলের মধ্যে মোহাম্মদ নাসিম এবং ড. মোহাম্মদ সেলিম এবং নাতি তানভীর শাকিল জয় সংসদ সদস্য হয়েছেন। ড. মোহাম্মদ সেলিম মারা গেছেন। এদের মধ্যে মোহাম্মদ নাসিম আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণ ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৬ সালে সিরাজগঞ্জ সদর ও কাজীপুর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে কাজীপুরের আসন ছেড়ে দিলে সেখানে তার ভাই ড. মোহাম্মদ সেলিম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনগত কারণে মোহাম্মদ নাসিম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। সেবার তার ছেলে তানভীর শাকিল জয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দশম সংসদ নির্বাচনে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম।
মোহাম্মদ নাসিম জানান রাজনৈতিক জীবনে তার পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। সারাজীবন দেশের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। তাই তার মৃত্যুর পর তারা অস্বাভাবিক রকমের অভাব-অনটনে পড়ে যায়। তাদের ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা ছিল না। সরকারি বাসভবন ছাড়ার পর ধানমন্ডিতে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকতেন। তার বড় ভাই লন্ডন থেকে কিছু টাকা পাঠাতেন, তা দিয়েই তাদের সংসার চলত।
এ এইচ এম কামরুজ্জামানের পারিবার
বাংলাদেশের প্রথম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানের ৬ সন্তানের মধ্যে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন শুধু খায়রুজ্জামান লিটন। দুই ভাই এবং চার বোনের মধ্যে লিটন চতুর্থ। এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মও এরই মধ্যে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। তিনি হলেন খায়রুজ্জামান লিটনের মেয়ে আনিকা সাদিয়া অর্ণা। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গত কমিটির (২০১১-১৫) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক উপ-সম্পাদক ছিলেন।
খায়রুজ্জামান লিটন গত এক যুগ ধরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আওয়ামী রাজনীতিতে পা রাখেন ১৯৮১ সালে। তখন রাজশাহী যুবলীগের একটি ওয়ার্ডের সহ-সভাপতি পদে আসীন ছিলেন। ১৯৮৬ সালে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত টানা ২৬ বছর রাজশাহী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে প্রথমবারের মতো দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর অনুষ্ঠিত সব কাউন্সিলে তার এই পদটি অপরিবর্তিত আছে।