অস্কার: চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতির অন্য নাম
‘অস্কার’ শব্দটি মাথায় এলেই চিন্তাতীতভাবে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঝাঁ চকচকে লাল গালিচার উপর দিয়ে কিছু খ্যাতনামা শিল্পী, কলাকুশলী আর পর্দার সামনে ও পেছনের অনেক গুণী লোকের আনাগোনায় মুখরিত এক আলোকোজ্জ্বল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, যা এক বাক্যে সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান। ক’দিন আগেই যে সিনেমাটি দেখা হলো বা যে সিনেমাটি খুব ভাল লাগার একটি অনুভূতি ছিল, টিভির পর্দায় সেই সিনেমার নাম সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হওয়ার উন্মাদনা ও আবেদন অন্যরকম। এর উল্টোটাও যে হয় না, তা কিন্তু নয়। আবার এমন কিছু সিনেমা আছে, যার নামই হয়তো শুনিনি, কিন্তু অস্কার প্রাপ্তির পর সেই সিনেমার খোঁজ পড়ে যায় সাথে সাথেই। সিনেমার এই সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি থাকে সিনেমার সাথে জড়িত সকল কলাকুশলীদের। তবে আজ এক অন্য প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। সেটি হলো চলচ্চিত্রাঙ্গনে অস্কারের আবির্ভাবের হলো কীভাবে?
১৯২০ সালের শেষের দিকের কথা। যুক্তরাষ্ট্রে চলচ্চিত্র যুগের গোড়াপত্তনের সময়। চলচ্চিত্র নির্মাণে মুনাফা প্রাপ্তি বাড়তে থাকায় আর দর্শকদের হলমুখো হওয়ার প্রবণতার কারণে প্রতি বছর প্রায় ৫০০টির মতো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছিলো হলিউডে। চলচ্চিত্র তখন পরিণত হয়েছিল আমেরিকার চার নম্বর গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়। সেই সময় এম.জি.এম বা ‘মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার’ একটি বেশ শক্তিশালী প্রযোজনা সংস্থা।
এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ‘লুইস বি মেয়ার’ চিন্তা করে দেখলেন যে, সিনেমা জগতের গুণী শিল্পীদের আরও বেশি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার ব্যবস্থা করা উচিত। আর সেই লক্ষ্যে প্রতি বছর গুণী শিল্পীদের তাদের কাজের জন্য পুরস্কার প্রদান করার প্রয়োজন। এক নৈশভোজে উপস্থিত আরো তিনজন বিখ্যাত ব্যক্তি, যাদের মাঝে ছিলেন পরিচালক ফ্রেড নিবলো, প্রযোজক ফ্রেড বিটসন এবং অভিনেতা কনরেড নাজেল, তাদের সামনে তিনি তার এই চিন্তার কথা উপস্থাপন করেন।
বলাই বাহুল্য, তাদের সহমতে চারজন মিলে একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেন যেটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবকিছুর দেখাশোনা করবে। ফলশ্রুতিতে ১৯২৭ সালের ৪ মে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অফ মোশান পিকচার আর্টস এন্ড সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে অবশ্য ইন্টারন্যাশনাল শব্দটি বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ‘এ.এম.পি.এ.এস’ নামধারণ করে আর এই একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত বার্ষিক অনুষ্ঠানটিই ‘অস্কার’ নামে পরিচিত।
পুরস্কার হিসেবে একটি ক্রেস্ট প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ক্রেস্টের জন্য সোনায় মোড়া একটি পুরুষ মূর্তির কথা চিন্তা করা হয়, যার হাতে থাকবে একটি তলোয়ার আর মূর্তিটি দাঁড়িয়ে থাকবে একটি ফিল্ম রোলের উপর। এম.জি.এম-এর শিল্প নির্দেশক সেডরিক গিবসন অস্কার পদকের নকশা করেন। লস এঞ্জেলেসের ভাস্কর জর্জ স্ট্যানলি এই নকশা অবলম্বনে ত্রিমাত্রিক ট্রফি নির্মাণ করেন। সাড়ে ১৩ ইঞ্চি উচ্চতার এই পদকটির ওজন সাড়ে ৮ পাউন্ড। ব্রোঞ্জের এই পদকটি ২৪ ক্যারেটের সোনার আবরণ দিয়ে তৈরি করা হয়। হাতের তৈরি প্রতিটি ট্রফি তৈরি করতে সময় লাগে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা আর খরচ পড়ে প্রায় পাঁচশ মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ধাতুর সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে তিন বছর অস্কার পদকটি রঙ করা প্লাস্টারে বানানো হয়। যুদ্ধ শেষে অবশ্য এই পদকগুলো ফেরত নিয়ে নতুন করে ধাতু ও সোনায় মোড়ানো পদক দেয়া হয়।
এবার আসা যাক অস্কারের নামকরণের রহস্যে। যদিও এই রহস্য যে সঠিকভাবে উদঘাটিত হয়েছে, তা কিন্তু নয়। এই পুরস্কারটির নাম আসলে ছিল ‘একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’ বা ‘একাডেমি পুরস্কার’ আর পদকটির নাম ছিল ‘অস্কার’। এখন অবশ্য ‘অস্কার’ নামেই পুরস্কার ও পদক দুটোই পরিচিত। অস্কার নামটি কোথা থেকে এলো তা নিয়ে অনেকগুলো মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলে থাকেন, একাডেমির সাবেক প্রেসিডেন্ট বেটি ডেভিস তার লেখা জীবনীতে লেখেন যে, তার প্রথম স্বামী ‘হারমন অস্কার নেলসনে’র নামানুসারে তিনি অস্কারের নাম করেন।
এমন আরেকটি ধারণাও প্রচলিত আছে যে, একাডেমির নির্বাহী সচিব মার্গারেট হেরিক ১৯৩১ সালে এই পুরস্কার দেখে বলেছিলেন, এই পদকের মানুষটি দেখতে তার চাচা অস্কারের মতো, সেই থেকেই নাকি এই নামকরণ। এই নাম প্রদানের সময় হলিউডের কলাম লেখক সিডনি সোলস্কি উপস্থিত ছিলেন এবং তার লেখায় এমনটাই লিপিবদ্ধ করেন। আরেকটি মত হলো, ১৯৩৪ সালে ৬ষ্ঠ অস্কার প্রদানের কাভারেজে ‘টাইমস ম্যাগাজিনে’ পুরস্কারটিকে অস্কার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তবে মতামত যেমনটাই হোক না কেন, ১৯৩৯ সাল থেকেই মূলত একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’কে অস্কার হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নামকরণ করা হয়। আর ১৯৩৫ সাল থেকে প্রিন্সওয়াটার হাউস (বর্তমানে প্রিন্সওয়াটার হাউস কর্পোরেশন) এই পুরস্কারের জন্য ভোট গ্রহণ করে আসছে।
১৯২৯ সালের ১৬ মে হলিউডের রুজভেল্ট হোটেলের ব্লজম রুমে প্রথম অস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ২৭০ জন দর্শকের সামনে অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। অভিনেতা, পরিচালক ও সহ-অভিনেতা সহ পনেরটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি মাত্র ১৫ মিনিট স্থায়ী হয় যেটি অস্কার ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম আসর হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যদিকে সবচেয়ে দীর্ঘ অনুষ্ঠানটি হয় ২০০২ সালে, যেটি ৪ ঘণ্টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত চলে। তবে ধারণা করা হয়, বিজয়ীদের দীর্ঘতম প্রতিক্রিয়া জানানোর কারণেই এই ব্যাপ্তিকাল। পরবর্তীতে তাই প্রতিক্রিয়া জানানোর সর্বোচ্চ সীমা ৪৫ সেকেন্ড বেঁধে দেয়া হয়।
প্রথম বছরে পুরস্করপ্রাপ্তদের তিন মাস আগেই জানিয়ে দেয়ার ফলে মূল অনুষ্ঠানের কোনো চমক ছিল না। পরের বছর থেকে পুরস্কারের দিন সকালে পত্রিকাগুলোকে জানিয়ে দেয়া হতো। তবে ১৯৪১ সাল থেকেই নিয়ম করা হয় যে, মূল অনুষ্ঠান চলাকালেই খাম খুলে জানতে পারা যাবে কে পুরস্কার পেয়েছে। আজ পর্যন্ত সেই খাম খোলার চমকের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
প্রথম অস্কার প্রাপ্ত সেরা ছবি হলো ‘উইংস’। তবে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারটিকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে। প্রথমে সেরা চলচ্চিত্র বলে কোনো ক্যাটাগরি ছিল না। ‘অনন্য চলচ্চিত্র’ এবং ‘শৈল্পিক মানসম্মত প্রযোজনা’ ছিল প্রথম বছরের মানদণ্ড। পরবর্তী বছর এর নামকরণ করা হয় ‘অনন্য প্রযোজনা’ নামে। ১৯৪১ সালে সেরা ছবির ক্যাটাগরির নামকরণ আবার বদলে হয় ‘অনন্য গতিশীল চলচ্চিত্র’। ১৯৪৪ সালে এই পুরস্কারের নাম হয় ‘শ্রেষ্ঠ গতিশীল চলচ্চিত্র’। ১৯৬২ সাল থেকে এই পুরস্কারের নামকরণ হয় ‘সেরা চলচ্চিত্র’।
বর্তমানে ২৪টি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে। এই ক্যাটাগরিগুলো হলো: কেন্দ্রীয় চরিত্রে সেরা অভিনেতা, পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেতা, কেন্দ্রীয় চরিত্রে সেরা অভিনেত্রী, পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেত্রী, সেরা রূপান্তরিত চিত্রনাট্য, সেরা অ্যানিমেশন চিত্র (২০০১ সালে প্রবর্তিত), সেরা অ্যানিমেশন স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র, সেরা শিল্প নির্দেশনা, সেরা চিত্রগ্রহণ, সেরা পোশাক পরিকল্পনা, সেরা পরিচালক, সেরা তথ্যচিত্র, সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র, সেরা ফিল্ম এডিটিং, সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র, সেরা মেকআপ, সেরা মৌলিক সুর, সেরা মৌলিক গান, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য, সেরা মৌলিক কাহিনী, সেরা চলচ্চিত্র, সেরা শব্দ সম্পাদনা, সেরা শব্দমিশ্রণ এবং সেরা ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট।
প্রথম আসরের সফলতার পর ‘লস এঞ্জেলেস রেডিও স্টেশন’ এগিয়ে আসে অনুষ্ঠানটির রেডিও পার্টনার হিসেবে। ১৯৫৩ সালে প্রথম অস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠানটি টিভি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে। এর সম্প্রচার সত্ত্বটি এ.বি.সি টিভির দখলে।
অস্কারের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে। যেমন:
- অস্কারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অস্কার জিতেছেন ওয়াল্ট ডিজনি। তিনি ৫৯ বার মনোনয়ন পেয়েছেন এবং তার মধ্যে ২৬ বার অস্কার জিতেছেন।
- ১৯৫০ সাল থেকে নিয়ম করা হয়েছে যে, অস্কারজয়ীরা তাদের জেতা পুরস্কার বিক্রি করতে পারবেন না। আর যদি একান্তই বেচতে হয়, তবে তা একাডেমির কাছেই বেচতে হবে।
- অস্কারে মনোনয়ন পাওয়ার বেশ কিছু নিয়মের মধ্যে একটি হলো, ছবির দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৪০ মিনিটের হতে হবে। আরেকটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের ছবিগুলোকে সেপ্টেম্বরের আগেই নিজ দেশে মুক্তি পেতে হবে।
- ১৯২৯ সালে সেরা অভিনেতার তালিকায় যার অস্কার পাওয়ার কথা ছিল সে কোন দুই পা ওয়ালা মানুষ নয়। সেটি ছিল একটি ‘কুকুর’।
- অস্কারের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন আলফ্রেড হিচকক। পুরস্কার হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘থ্যাংক ইউ’।
- মনোনীত ব্যক্তিরা পুরস্কার না জিতলেও যেন অসম্মানিত বোধ না করেন, এ কারণে “অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ…” বাক্যাংশটির বদলে ব্যবহার করা হয়, “অ্যান্ড দ্য অস্কার গোজ টু…“।
অস্কার অনুষ্ঠানের এই অন্তহীন পথচলা তিনবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। প্রথমবার, ১৯৩৮ সালে লস এঞ্জেলেসে ব্যাপক বন্যা হওয়ার কারণে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান স্থগিত হয়। দ্বিতীয়বার, ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নেতা মার্টিন লুথার কিং এর মৃত্যু হয় এবং তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানটি ছিল একই দিনে। আবার ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান আততায়ী দ্বারা আক্রান্ত (বুকে গুলি লাগলেও বেঁচে যান) হলে সে বছরের অস্কার পুরস্কার প্রদানও স্থগিত হয়।
২০১৭ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটারে বসেছিল অস্কারের ৮৯ তম আসর। এবারের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র মনোনীত হয় বেরি জেনকিন্স পরিচালিত ‘মুনলাইট’। ‘লা লা ল্যান্ড’-এর জন্য ডেমিয়েন শ্যাজেল সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান, তিনিই এ পুরস্কার পাওয়ার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ পরিচালক। ১৯২৯ সাল থেকে চলে আসা চলচ্চিত্রাঙ্গনের এই সর্বোচ্চ স্বীকৃতি অর্জন আজও চলচ্চিত্রের সাথে সংযুক্ত সবার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। অধরাকে ধরতে চাওয়ার চেষ্টায় শিল্পীদের চালিয়ে যান নিরলস কষ্টসাধনা। অনেকেই পেয়েছেন, আবার অনেকেই পাওয়ার আশায় পরিশ্রম করে চলেছেন। কেননা এই অস্কার সম্ভাষণে সম্মানিত প্রতিটি শিল্পীর মর্যাদা তো সেই শ্রমেরই প্রতিদান। তথ্যসূত্রঃroar.media