যে ১০টি জাপানি অ্যানিমেশন সিনেমা না দেখলেই নয়
অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র জাপানিদের কাছে নতুন কিছু নয়। ১৯৪৪ সালে ‘মোমোতারোস ডিভাইন সী ওয়ারিয়র্স’ নামের ফিচার অ্যানিমেশন সিনেমাটি দিয়ে শুরু করে তারা তাদের এই জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এর আগেও অবশ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে। জাপানে বিখ্যাত অ্যানিমেশন সিনেমা যেগুলো, সর্বকালের সেরা তালিকাতেও তাদের নাম পাওয়া যাবে।
অ্যানিমেশন সিনেমা বলতে যদি আমরা কার্টুন ধরে নিই, তবে মস্ত বড় ভুল হবে! প্রতিটি চলচ্চিত্রের সাধারণ সব কথোকপনে লুকিয়ে আছে গোপন আর গভীর বার্তা। এই যে ‘মোমোতারোস ডিভাইন সী ওয়ারিয়র্স’ চলচ্চিত্রের কথাই ধরা যাক। পরিচালক ওসামু তেজুকা জাপানি রূপকথা মোমোতারোকে সিনেমার পর্দায় তুলে আনলেন। ছোট্ট মোমোতারো দৈত্যদের সাথে লড়াই করতে যায়। আসলে এটি ছিল বিশ্বযুদ্ধে জাপানের তরুণ প্রজন্মকে অংশ নেওয়ার আহ্বান। অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় জাপান পৃথিবীকে কম কিছু দেয়নি। ওসামু তেজুকা তো কেবল শুরু! এরপর হায়াও মিয়াঝাকি, ইসাও তাকাহাতা, কাতসুহিরো ওতমো- এমন আরো কত নামই রয়ে গেছে বাকি।
আপনার যদি অ্যানিমেশন সিনেমা ভালো লেগে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। আপনার খুব সিরিয়াস ধরনের সিনেমাখোর বন্ধুটি যিনি অ্যানিমেশনকে শুধু কার্টুনই ভাবেন, তাকেও যদি ধরে-বেঁধে দেখিয়ে দেওয়া যায় নিচের তালিকার যেকোনো একটি, তিনিও আর “ওহ অ্যানিমেশন?” বলে কখনো মুখ ঘুরিয়ে নেবেন না। জাপানের উল্লেখযোগ্য অ্যানিমেশনের নাম বলতে গেলে এতোগুলো চলচ্চিত্র এসে পড়ে যে তা থেকে বাছাই করে নেয়াটা বেশ কঠিন। আর যদি বলা হয় যেকোনো পাঁচটি কি সাতটি, সে তো রীতিমতো নিজের সাথে যুদ্ধ।
১০.ফাইভ সেন্টিমিটারস পার সেকেন্ড
চেরি ফুলের পাঁপড়ি ঝরে পড়ার গতি সেকেন্ডে ৫ সেন্টিমিটার। তিনটি এপিসোডে ভাগ করা এই ড্রামা সিনেমার শুরু হয় নায়িকা আকারির কথা দিয়ে। শৈশবের ভালো বন্ধু আকারি আর তাকাকি। কৈশোরে আকারি স্কুল ছেড়ে অনেক দূরের একটা স্কুলে ভর্তি হল। তাকাকি কি তাকে বলতে পারবে না বলা কথাগুলো? নাকি মেনে নেবে সময় ঝরে পড়ার গতির সাথে কাছের মানুষের হারিয়ে যাওয়া? সব মানুষ কি দূরত্ব আর সময়ের সাথে হারিয়ে যায়? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে দেখতে হবে মাকোতো শিনকাইয়ের ৬৩ মিনিটের রোমান্টিক ড্রামাটি। সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং ৭.৮।
৯. দ্য টেল অব প্রিন্সেস কাগুয়া
যদি সৌন্দর্যের বিচারে অ্যানিমেশন সিনেমার তালিকা করা হয়, তবে এটি থাকবে একদম প্রথমের দিকে। জলরঙা পটভূমিতে পরিচালক ইসাও তাকাহাতা জাপানের রূপকথাকে জীবন্ত করেছেন। বাঁশ কেটে জীবনযাপন করেন মিয়াতসুকো। একদিন বাঁশ কাটতে গিয়ে বাশের অংকুরে খুঁজে পেলেন অতিশয় ক্ষুদ্রাকারের এক বাচ্চা মেয়ে। সাথে অফুরন্ত সম্পদ। মেয়েটির বেড়ে ওঠার গতি আবার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। মেয়ের নাম রাখলেন কাগুয়া। তার সাথে আসা সম্পদ দিয়ে শহরে উঁচু শ্রেণীর মানুষের মাঝে গিয়ে বাসা করলেন। কাগুয়া এখন প্রিন্সেস হলো। কিন্তু এই জীবন কি সে চেয়েছিল? কে এই কাগুয়া? শেষ পর্যন্ত কি আছে তার ভাগ্যে? এর আইএমডিবি রেটিং ৮.১। এই অসাধারণ চলচ্চিত্রটি আপনার কাছে শুধুই রূপকথা হয়ে থাকবে না, হয়তো কাগুয়ার সাথে মিলও খুঁজে পেতে পারেন নিজের জীবনের!
৮. দ্য গার্ল হু লেপ্ট থ্রু দ্য টাইম
একদিন যদি হুট করে টের পান আপনি লাফ দিয়ে অতীতে যেতে পারেন? নিশ্চয়ই আগের দিনের ভুলগুলোকে শুধরে নিয়ে আজকের দিনটাকে আরো সুন্দর করে তুলতেন। মাকোতো, গল্পের নায়িকাও তা-ই করেছিল। কিন্তু নিজের ছোট ছোট সুখের জন্য অজান্তেই সে কি করে চলেছে অন্য কারো ক্ষতি? এই সময় পেরোনো লাফ দেবার ক্ষমতা সে কোথায় পেল? মামোরো হোসদা পরিচালিত ৭.৮ আইএমডিবি রেটিংয়ের সায়েন্স ফিকশন, অ্যাডভেঞ্চার, রোমান্স জনরার এই চলচ্চিত্রটি এক্ষেত্রে হতে পারে আপনার উত্তর।
৭. মাই নেইবার টটরো
ছোট্ট দুই বোন সাতসুকি আর মে। তাদের মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। প্রফেসর বাবা তাদের বাসা বদলে এলেন জঙ্গলের কাছের এক গ্রামে। জাপানি দানব ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে চলচ্চিত্রটি অচিরেই জায়গা করে নিয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পারিবারিক চলচ্চিত্রের তালিকায়।
১৯৮৮ সালে হায়াও মিয়াঝাকি পরিচালিত আইএমডিবি ৮.১ রেটিংয়ের এই চলচ্চিত্রটি আসার পর মোটাসোটা টটরো হয়ে গেল স্টুডিও ‘ঝিবলি’র প্রতীক। সিনেমাটি আপনাকে নিয়ে যাবে কল্পনার গন্ধ মেশা মধুর শৈশবে, যেখানে আছে ভাইবোনের খুনসুটি, মাটির ছোঁয়া, বাড়িজুড়ে পিচ্চি পিচ্চি একদল ভূতের হুড়োহুড়ি। কিংবা জঙ্গলে টটরোর মতো দৈত্য, যাকে বিছানা বানিয়ে একবেলা ঘুমিয়ে নেয়া যায়!
৬. ওলফ চিলড্রেন
তারপর? তারপর রাজকুমার রাজকুমারীকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকল। এই গল্পটা কিন্তু এখান থেকেই শুরু হয়। হানা বিয়ে করলো ওকামিকে। ওকামি হলো যাকে বলে ইচ্ছাধারী নেকড়ে। দুটো বাচ্চাও হলো তাদের। আর তারপর থেকেই জীবনের টানাপোড়েন শুরু। ইয়ুকি আর এমি যেখানে আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশু নয়, কীভাবে তাদের মানুষ করবে হানা? নাকি তারা হবে নেকড়ে? এই ছবিটিও পরিচালনা করেছেন মামোরো হোসদা। এর আইএমডিবি রেটিং ৮.২।
৫. আকিরা
২০১৯ সাল, নিও-টোকিও। জাপানজুড়ে চলছে অলিম্পিক আয়োজনের উন্মাদনা। তবে শেষবারের পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষত পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি তারা। এমনই এক রাতে দেখা মেলে উচ্ছ্বল একদল তরুণের, যারা বাইক চালাতে খুব ভালোবাসে। রাস্তায় তাদের সাথে বেশ ঝামেলা হলো অন্য গ্যাংয়ের। তরুণদলের সদস্য টেটসুও গুরুতরভাবে আহত হলো। ঘটনাক্রমে দলটির সাথে পরিচয় হয় এক অতিমানবীয় শিশুর, যে কিনা গোপন ল্যাব থেকে পালিয়েছে! তার চিৎকারে কাঁচ ভেঙে গুঁড়ো হয়। আসলে কী চলছে দেশজুড়ে? শুধুই অস্থিরতা, নাকি গভীর কোনো ষড়যন্ত্র? এই অতিমানবীয় শক্তির সাথে পারমাণবিক বিস্ফোরণের কোনো যোগাযোগ নেই তো? থাকলে এর শেষ কোথায়? নিজের বিজ্ঞান কল্পকাহিনীভিত্তিক মাঙ্গা সিরিজ আকিরাকে নিয়ে ১৯৮৮ সালে সিনেমাটি নির্মাণ করেন কাতসুহিরো ওতমো। সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং ৮.১।
৪. প্রিন্সেস মনোনোকে
না, এটি একদমই মনোনোকে নামে কোনো রাজকুমারীর গল্প নয়, বরং এর শেকড় চলে গেছে আরো গভীরে। ইমিশি জাতির গ্রামটিতে আক্রমণ করতে এল এক দৈত্য, ইমিশিদের শেষ রাজকুমার গ্রামে ঢোকার আগেই তাকে হত্যা করে। কিন্তু তার উপর নেমে আসে দৈত্যের অভিশাপ। এই অভিশাপ কাটানোর জন্য যাত্রা শুরু করে সে। জঙ্গলের আত্মা ও বনের সম্পদ গ্রাসকারীদের যুদ্ধের মাঝে পড়ে সে। হায়াও মিয়াঝাকি তার চলচ্চিত্রে প্রতীক ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত হয়ে থাকবেন। গল্পটা কি শুধুই রূপকথা, নাকি সবসময়ের কোনো সত্য লুকিয়ে আছে এতে? হায়াও মিয়াঝাকির ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ আসার আগ পর্যন্ত এটিই ছিল জাপানের সর্বোচ্চ আয়ের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র। ঝিবলি স্টুডিওর এই চলচ্চিত্রটির আইএমডিবি রেটিং ৮.৪।
৩. ইয়োর নেইম
একদিন সকালবেলা ঘুম ভেঙে দেখলেন, আপনি আছেন অন্য কারো শরীরে, অর্থাৎ আপনি আর আপনি নেই, কেমন হবে তখন? তারা খসার দিনের পর থেকে মিতসুহা আর তাকি দুজন নিজেদেরকে মাঝেমধ্যেই আবিষ্কার করতে থাকে একে অন্যের শরীরে। দুজন মাঝে মাঝেই একে অন্যের জীবন কাটাতে গিয়ে হয়তো মনের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলে দুজনকে। কিন্তু কে মিতসুহা, আর কে-ই বা তাকি? তাদের দুজনের এই শরীর পরিবর্তন কি শুধুই নিয়তির এক নির্মম খেলা? ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া মাকোতো শিনকাইয়ের সিনেমা ‘ইয়োর নেইম’ টুইস্টের পর টুইস্ট এনে দর্শকদের দুমড়ে মুচড়ে রেখে যায়। বক্স অফিস আর সিনেমাপাড়াও সরগরম, আইএমডিবি রেটিং ৮.৫। হায়াও মিয়াঝাকির ‘স্পিরিটেড এওয়ে’কে ছাড়িয়ে জাপানের সর্বোচ্চ আয়ের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের স্থান এখনো ‘ইয়োর নেইম’ এর।
২.গ্রেইভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস
সিনেমার পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আমেরিকা বিমান নিয়ে বম্বিং করছে জাপানের সর্বত্র। এর মাঝে কিশোর সেঈতা আর তার ছোট্ট বোন সেতসুকোর বেঁচে থাকার যুদ্ধের গল্প। সদ্য সামরিক কর্মকর্তা বাবাকে হারিয়ে বোনকে বুকে নিয়ে বাঁচতে চায় সেঈতা। পুরোনো বাংকারের ভেতর তাদের কাটানো দিনগুলো দেখে কাঁদেনি এমন লোক মেলা ভার। তারা কি পার করতে পারবে এই কঠিন সময়? নাকি তাদেরও অবস্থা হবে দিনশেষের জোনাকির মতো? সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং ৮.৫। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটি অন্যতম পরিচিত অ্যানিমেশন। ইসাও তাকাহাতার সিনেমায় মুন্সিয়ানার প্রতীক হয়ে থাকবে চলচ্চিত্রটি।
‘পনিয়ো’, ‘পর্কো রসো’, ‘কিকি’স ডেলিভারি সার্ভিস’ বা ‘হাউলস মুভিং ক্যাসল’ এর মতো চলচ্চিত্রগুলোর প্রতি ভালোবাসা রাখি, প্রথম নামটি ঘোষণার আগেই। এবং প্রথম নামটি অবশ্যই –
১. স্পিরিটেড অ্যাওয়ে
২০০১ সালে প্রিন্সেস মনোনোকে আসার পর আরো এক বার সিনেমা পাড়া কাঁপতে বাধ্য হলো। ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ দেখার সময় আপনি কী দেখবেন জানেন? ১০ বছরের চিহিরো তার বাবা মায়ের সাথে ঘুরতে যায়। অতি লোভে বাবা-মা জন্তুতে রূপান্তরিত হন। তারপর নানান আকারের দৈত্য-দানো আর কল্পনার জগতের কারবার। খুশি মনে বলবেন, বাহ, এ তো বাচ্চাদের সিনেমা। কিন্তু সত্যি কি তা-ই? নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন যে এটি শুধু কল্পকথাই, বরং জাপানের পতিতালয়ে শিশুর ব্যবহারের কথা এখানে বলা হয়নি? বাথ হাউজগুলোর অর্থ পতিতালয় নয়? বাথ হাউজের মালিক এই রুবাবাই বা কে? হায়াও মিয়াঝাকি এখনো পর্যন্ত তার শ্রেষ্ঠ কাজটি করেছেন স্পিরিটেড অ্যাওয়ে দিয়ে, আইএমডিবির ৮.৬ রেটিংয়ের এই চলচ্চিত্রটি ২০০৩ সালে অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম ক্যাটাগরিতে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়।
আপনি সিনেমার জগতে ডুব দেবেন অথচ জাপানি এনিমেশন দেখবেন না, তাহলে কিন্তু বলা চলে আপনার সিনেমাখোর জীবনের ১৬ আনাই মিছে। তাই আর দেরি না করে দেখে ফেলুন চলচ্চিত্রগুলো। তথ্যসূত্রঃroar.media