নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে এ বছরটা যাবে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রয়েছেন কারাগারে। যদিও আজ দুপুরে তাকে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হয়েছে।
খালেদার এ পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রধানমন্ত্রী ও তার আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছে। এ দুজন বাংলাদেশের ‘ব্যাটল অব দ্য বেগমস’-এ একে অপরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী।
এশিয়া টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, রায়ের পর বিএনপি খালেদা জিয়ার নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেগুলো সবই দমন করা হয়েছে। রিজভী আরো বলেন, ‘আমরা সভা করার অনুমতি চেয়েছি, কিন্তু কয়েকবার তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এরপর আমরা যখন নিজেদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি পালন করতে গেছি, পুলিশ আমাদের ওপর জলকামান ও লাঠিসোটা নিয়ে চড়াও হয়েছে।’ রিজভী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেন, বেশ ক’জন বিএনপি নেতা ও কর্মীকে গত পাঁচ বছর ধরে মিথ্যা অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বিএনপির গবেষণা শাখার দাবি, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর দলের বহু সদস্যের বিরুদ্ধে হাজারো মামলা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে ৫ শতাধিক সমর্থককে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে ৭ শতাধিক ব্যক্তিকে। অভিযোগ করা হচ্ছে, এদের কেউ কেউ এখনও নিখোঁজ। তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বলপূর্বক গুমের শিকার হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে দলটি। রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে একটি দল হিসেবে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে।’
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছে যে, খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের আদেশে ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে’ যে, তারা খালেদাকে কারাগারে রাখতে চায়। যেন তিনি ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন।
আদালতের আদেশের কয়েক ঘণ্টা পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘খালেদা জিয়া ও আমরা (বিএনপি) দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছি, যেটা মানুষের সর্বশেষ ভরসার জায়গা।’
চার সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ নিম্ন আদালতের দেয়া খালেদার জামিন আদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন ও সরকারকে আপিল করার অনুমতি দিয়েছেন। আর এ শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন ৮ই মে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদার আইনজীবীদের দাবি, এটা ‘নজিরবিহীন ও ‘অপ্রত্যাশিত’ কেননা সর্বোচ্চ আদালত এর পেছনে কারণও দেখান নি।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী মোট ৩৪টি মামলায় লড়ছেন যার একটি হলো জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। সুপ্রিম কোর্ট যদি খালেদার জামিনের অনুমতি দেনও, তারপরও দলটির নেতাদের শঙ্কা তিনি আইনি জটিলতার কারণে কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারবেন না কেননা তার বিরুদ্ধে এতগুলো মামলা রয়েছে।
বিএনপি ‘নিজেদের আইনজীবী টিমকে সমৃদ্ধ করার জন্য এবং খালেদার মামলাটি বিশ্বমহলে তুলে ধরার জন্য’খ্যাতনামা বৃটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ দিয়েছে। বৃটেনের রাণীর কাউন্সেল (রাষ্ট্রনিযুক্ত ব্যারিস্টার) লর্ড কার্লাইল এশিয়া টাইমসকে বলেন, এখনও ওই মামলার সব নথিপত্র তার পড়া বাকি।
বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বিএনপির অভিযোগগুলো জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করছি বিচারকরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করবেন এবং বিচারপ্রক্রিয়া পক্ষপাতহীন রাখবেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘তারা যদি সেটা না করেন, তাহলে বাংলাদেশের সুনামের ক্ষেত্রে তা হবে বিপর্যয়। বাংলাদেশসহ আমাদের অভিন্ন আইনি সংস্কৃতির যেকোনো দেশের জন্য ক্ষমতার পৃথককরণ মৌলিক একটি নীতি।
‘কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থা’ (অথরিটারিয়ান রেজিম)
এদিকে, জার্মান থিংক ট্যাংক বার্টেলসম্যান স্টিফটুং গত মাসে বলেছে, বাংলাদেশ এখন স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অধীনে। এবং দেশটিতে গণতন্ত্রের মৌলিক মানদণ্ডগুলোও মানা হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, যে দেশটি একসময় বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ছিল, এখন সেটা নির্বাচনের মানে অবনতি হওয়ার কারণে ‘স্বৈরতন্ত্র হিসেবে শ্রেণিভুক্ত’।
কিন্তু বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ওই থিংক ট্যাংকের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। এশিয়া টাইমসকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বৈরতান্ত্রিক বলাটা ‘উদ্দেশ্যমূলক’ এবং এর কোনো ভিত্তি নেই। তিনি আরো বলেন, ‘বিচারবিভাগ ও গণমাধ্যমসহ সত্যিকারের গণতন্ত্রের সকল অঙ্গ এখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন।’
বিএনপির দমন পীড়নের শিকার হওয়ার দাবির জবাবে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় দলটির পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে- ‘কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কর্মকাণ্ডগুলো খতিয়ে দেখবে না যেখানে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়।’
বিএনপির শক্তিমত্তার ঘাটতি (বিএনপি’স ল্যাক অব স্ট্রেন্থ)
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঘাটতি রয়েছে বিএনপির যা বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগকে সামনে ঠেলে দিয়েছে।
ঢাকাস্থ একটি বিদেশি দূতাবাসের রাজনৈতিক পরামর্শক ফারুক হাসান এশিয়া টাইমসকে বলেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পরপরই তিনি বিএনপির একটি ব্রিফিংয়ে যোগ দিয়েছিলেন যেটা ‘বিএনপির জন্য তাদের কারান্তরীণ নেতার প্রতি জনগণের সহানুভূতি কাজে লাগানোর সুবর্ণ সুযোগ হতে পারতো।’
তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, দেশের মানুষের সমর্থন ফিরে পেতে তারা তাদের ভবিষ্যৎ কৌশল ব্যাখ্যা করবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পুরো ঘণ্টাটা ব্যয় করা হয় কারাগারের ভয়াবহ পরিস্থিতির ব্যাখ্য দিতে আর খালেদা জিয়া কতটা কষ্টে আছেন সে প্রসঙ্গে।’
ঢাকাভিত্তিক বিশ্লেষক এবং কলামিস্ট আফসান চৌধুরী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দলীয় প্রধান হিসেবে খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তারেক রহমান বৃটেনে আশ্রয় নিয়েছেন কেননা তিনিও নানা আইনি মামলায় অভিযোগের মুখোমুখি।
তিনি বলেন, ‘একজন পলাতক কিভাবে বিএনপির মতো বড় একটি দলকে নেতৃত্ব দিতে পারে? সত্য কথা হলো খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নেতৃত্ব সংকটে থাকা একটি দল।’
তবে, একথা প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপি নেতা রিজভী। তিনি দাবি করেন, দল ‘আরো শক্তিশালী হয়েছে’ কেননা সাধারণ মানুষ দেখেছে, ‘কিভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপির ওপর তাদের নগ্ন, বেআইনি আগ্রাসন চালায়।’
আওয়ামী লীগ এদিকে, বছরের শুরু থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে সফরকালে ভোট চেয়েছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, ‘তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জেলাগুলোতে উন্নয়নমূলক প্রকল্প উদ্বোধনের জন্য করা সফরে নিজ দলের জন্য ভোট চাইছেন। অন্যদিকে, আমাদের নেত্রীকে পরিকল্পিতভাবে কারাগারে রাখা হয়েছে। তাহলে এখানে ন্যায়বিচারটা কোথায়?’
[লেখাটি হংকংভিত্তিক ইংরেজি সংবাদ ওয়েবসাইট এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের অনুবাদ। ‘বাংলাদেশি পলিটিক্স ইন আ মেস এহেড অব পোল ইন ডিসেম্বর’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি লিখেছেন ফয়সাল মাহমুদ। তিনি এশিয়া টাইমস ছাড়াও আল জাজিরা ও দ্য ওয়ারে লিখে থাকেন।]