উচ্চ রক্তচাপে সাবধান!
রক্তচাপ আসলে কী?
রক্তস্রোত রক্তনালীর দেওয়ালে যে চাপ সৃষ্টি করে সেটিই রক্তচাপ। স্বাভাবিক অবস্থায় এর পরিমাপ ১২০/৮০। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ খানিক বাড়তে থাকে। তখন এই পরিমাপের থেকে আর একটু বেশি চাপকেও স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। কিন্তু ওপরের চাপ ১৪০-এর বেশি বা নীচের চাপ ৯০-এর বেশি হয়ে গেলে মুশকিল।
রক্ত চাপ দু’ভাবে বাড়তে পারে। অ্যাকিউট আর ক্রনিক। হঠাৎ কোনও উত্তেজনার বশে বা অন্য কোনও কারণে দুম করে রক্তের চাপ খুব বেশি বেড়ে গিয়ে বিপত্তি ঘটতে পারে। এটি অ্যাকিউট হাই ব্লাড প্রেসার। এতে আচমকা হার্ট ফেলিওর হতে পারে। স্ট্রোকও হতে পারে।
ক্রনিক হাই ব্লাড প্রেসারের ক্ষেত্রে চাপের পরিমাপ হয়তো হঠাৎ করে খুব বেশি থাকে না। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে রক্তের উচ্চচাপ পুষে রাখার জন্য হার্টের পেশির ক্ষতি হতে পারে। কারণ, বেশি রক্ত পাম্প করতে হার্টের ওপর বেশি চাপ পড়ে। তা ছাড়া অনেক দিন ধরে রক্তচাপে ভুগলে রক্তনালীগুলো শক্ত হয়ে যায়। সেগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়। রক্তনালীর ভেতরের দেওয়াল মোটা হয়ে যায়। ফলে ব্লক তৈরি হয়। সব মিলিয়ে হার্ট ফেলিওর বা হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়।
আবার রক্তনালীতে ‘ব্লক’ তৈরি হওয়ার জন্য বা বেশি রক্তচাপের কারণে নালীর মধ্যে রক্ত দলা পাকিয়ে যেতে পারে। সেই দলা বা ক্লট মাথায় পৌঁছে স্ট্রোক হতে পারে। আবার রক্তের চাপ সহ্য করতে না পেরে কোনও ধমনি ছিঁড়ে গিয়েও স্ট্রোক হতে পারে।
অতএব, রক্তচাপ পুষে রাখার মাসুল হতে পারে মারাত্মক!
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ
এমনতি এর তেমন কোনও লক্ষণ নেই। তাই তলে তলে যে রক্তের চাপ বেড়ে গিয়েছে, এটা অনেকেই টের পান না। এ জন্য ৩৫ বছরের পর থেকে মাঝে মাঝেই ব্লাডপ্রেসার মাপা দরকার। আর দীর্ঘ দিন ধরে রক্তচাপের সমস্যায় ভুগলে ফি-হপ্তায় এক বার প্রেসার মেপে দেখা উচিত। বাড়িতেই রাখতে পারেন প্রেসার মাপার যন্ত্র।
প্রেসার কেন বাড়ে
১) বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। বয়সের সঙ্গে রক্তচাপ সমানুপাতিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যা জানাচ্ছে, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে হলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জন। আর পঞ্চাশের কোঠায় বয়স হলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন প্রতি ১০ জনে ৫ জন। বয়স ৭০ বা তার বেশি হলে প্রতি দুই জনের মধ্যে এক জনের উচ্চ রক্তচাপ থাকবে।
২) খাবারে বেশি নুন খাওয়ার জন্য প্রেসার বাড়তে পারে।
৩) ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসার বাড়ে।
৪) শারীরিক পরিশ্রম না করে বসে বসে থাকলে ওজন বাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে রক্তচাপ।
৫) মানসিক চাপ বা উত্তেজনা বাড়লে অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থি থেকে নরঅ্যাড্রিনালিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।
খাবার ও রক্তচাপ
রক্তচাপের সমস্যায় ভুগলে প্রথমত ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ওজন বাড়লে হার্ট বেশি পাম্প করবে। ফলে রক্তচাপ বাড়বে। তাই উচ্চতা অনুযায়ী শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সুতরাং খাবার এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এমনিতে উচ্চ রক্তচাপের জন্য দরকার ড্যাশ ডায়েট অর্থাৎ উদ্ভিজ্জ খাবার। রোজকার খাবারে থাকবে রকমারি ফল ও প্রচুর শাকসব্জি। কারণ, এ সবের মধ্যে থাকে পটাশিয়াম ও প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং ফাইবার, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। রক্তচাপ জনিত সমস্যায় ভুগলে অ্যানিমাল প্রোটিন কম খেতে হবে।
রক্তচাপ বেশি হলে নুনের কথা মাথায় রাখতে হবে। নুনের সোডিয়াম ব্লাড প্রেসার বাড়ায়। দিনে ২-৩ (ছোট চামচের হাফ চামচ) গ্রামের বেশি নুন খাওয়া উচিত নয়। বাদ দিতে হবে প্রসেসড ফুড, জাঙ্ক ফুড, টিন ফুড, প্যাকেট ফুড, রেডি টু ইট ফুড, আচার, চিপস ইত্যাদি। কারণ এগুলোতে প্রিজারভেটিভ হিসেবে নুন মেশানো থাকে।
প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে। কারণ জল হল ডাইইউরেটিক। জল শরীরের পিএইচ ভারসাম্য বজায় রাখে। জল শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকারক পদর্থগুলোকে বের করে দেয়। এগুলো বেরিয়ে গেলে শরীরে রক্তের চাপ কমে।
স্ট্রেস ও রক্তচাপ
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বাড়লে রক্তচাপ বাড়ে। আবার উল্টোটাও হয়। রক্তচাপ বাড়লে স্ট্রেস বাড়ে। স্ট্রেস বাড়লে নার্ভের ওপর চাপ পড়ে। ফলে প্রেসার বাড়ে। তাই রক্তচাপকে বশে রাখতে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট খুব জরুরি। সোজা কথায় স্ট্রেস বা মানসিক চাপকে প্রশ্রয় না দিয়ে তার স্ট্রেসের মোকাবিলা করা।
কী ভাবে স্ট্রেসের মোকাবিলা করবেন
ইচ্ছে করলেই স্ট্রেসের কবল থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারেন। স্ট্রেসে যিনি ভুগছেন, তিনি চাপে থাকেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর বুদ্ধি মোটেই লোপ পায় না। তাই একটু সচেতন হলেই স্ট্রেসকে কমিয়ে আনা যায়। এর কয়েকটি ধাপ আছে।
প্রথম ধাপটি সত্যিই স্ট্রেসে ভুগছেন কি না তা খতিয়ে দেখা। স্ট্রেসে শারীরিক, মানসিক ও ব্যবহারগত কিছু পরিবর্তন বা সমস্যা হতে পারে। যেমন:
ঘুম একেবারেই চলে যায়। অনেকের আবার ঘুম অনেক বেশি হয়। সারা দিনই ঝিমুনি লাগে।
খিদের ইচ্ছে চলে যাওয়া বা বেশি খিদে পায়।
শরীর-মনে ক্লান্তি। অলসতা দেখা দেয়।
মাথার যন্ত্রণা হতে পারে।
এগুলি সব শারীরিক পরিবর্তন।
মানসিক বা ইমোশনাল পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে
কিচ্ছু ভাল না লাগা।
ঘন ঘন মুড সুইং হওয়া।
মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়া।
ভয় ভীতি তৈরি হওয়া।
খিটখিটে মেজাজ।
অধৈর্য হয়ে যাওয়া।
কিছু ব্যবহারগত পরিবর্তন হয়। যেমন,
সিগারেট খাওয়া বেড়ে যায়।
যাঁরা সিগারেট খেতেন না, তাঁরাও খেতে শুরু করেন।
অ্যালকোহল বেশি খাওয়া হয়ে যায়।
কোনও নির্দিষ্ট ড্রাগের প্রতি আসক্তি বেড়ে যায়।
এই সমস্যাগুলোর কিছু কিছু দেখা গেলে বুঝতে হবে আপনি স্ট্রেসে ভুগছেন।
চিকিৎসা
কেউ কেউ এমনিতেই খুব বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন। কিছু একটা হতে পারে এই ভয়ে। ‘যদি’ হয়, তার ওপর নির্ভর করেই তাঁরা ভেতরে ভেতরে প্রবল মানসিক চাপে থাকেন। সে ক্ষেত্রে দরকার মতো কাউন্সেলিং করে ওষুধ খেতে হতে পারে।
আর কিছু হয় তাৎক্ষণিক স্ট্রেস। কোনও একটা ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা করে করে চাপ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে নিজেই সচেষ্ট হলে স্ট্রেসকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন।
কী ভাবে
স্ট্রেসকে দূরে সরাতে গেলে দরকার স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রা। এতে অভ্যস্ত হলে স্ট্রেস অনেকটা কাটিয়ে ওঠা যায়।
১) নিয়মিত সঠিক এক্সারসাইজ করা। নিজে নিজে ভুলভাল কিছু না করে ট্রেনারের কাছে গিয়ে এক্সারসাইজ শিখলে ভাল হয়। এক্সারসাইজ করলে কিছু হ্যাপি হরমোন ক্ষরণ হয়। যার থেকে একটা ফিল গুড এফেক্ট আসে। অলসতা, ক্লান্তি দূর হয়। শরীর ঝরঝরে লাগে।
২) হেলদি লাইফস্টাইলে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল খাওয়াদাওয়া। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। জাঙ্কফুড, প্যাকেট ফুড একেবারে চলবে না। এতে ওজন বাড়ে। ওজন বাড়লে রক্তের চাপও বাড়ে। বরং মরসুমি ফল আর শাকসব্জি প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে। এর মধ্যে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল নার্ভকে উজ্জীবিত করে। ফলে মন তরতাজা হয়। প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে। জল শরীরের টক্সিন বের করে দেয়।
৩) সারা দিনে ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুম খুব জরুরি। ঘুমের ব্যাঘাত হলে সেটাকে আয়ত্তে নিয়ে আসতে হবে। দরকারে ডাক্তারের পরামর্শমতো স্ট্রেস কমানোর ওষুধ খেয়ে ঘুমকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ বায়োলজিকাল ক্লক ঠিক করতে হবে। শুধু ওষুধ নয়, নির্বিঘ্ন ঘুমের কিছু রেসিপি বা টোটকা আছে। সেগুলি মেনে চললে ভাল ঘুম হয়।
ঘুমের রেসিপি
ঘুমের রেসিপির মূল কথাই হল ঘুমের জন্য শরীর ও মনকে প্রস্তুত হয়। সেগুলি হল:
১) ঘুমের তিন ঘণ্টা আগে থেকে জল খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে। তাতে ঘুমের সময় বার বার বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।
২) ঘুমের আগে টিভি দেখা চলবে না। বরং ম্যাগাজিন বা হালকা কোনও গল্পের বই পড়তে পারেন।
৩) সারাদিনের পাতা বিছানার চাদর তুলে ফেলে ঘুমের জন্য আলাদা কোনও বিছানার চাদর পাতলে ভাল হয়।
৪) ঘুমের আগে জোরালো আলো না জ্বালিয়ে হালকা আলো জ্বালানো
৫) ঘুমের ঠিক আগে কোনও উত্তেজক কথাবার্তায় যাবেন না।
৬) শুয়ে ঘুম না এলে উঠে কোনও বই পড়বেন।
৪) যতই স্ট্রেস থাকুক, মন ভাল না থাকুক, আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না। ভাল লাগছে না বলে যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না।
৫) আর এই হেলদি প্র্যাকটিস ধরে রাখতে একটি ডায়েরি মেনটেন করুন। তাতে সারা দিনে কী কী করলেন, সব লিখবেন। এক সপ্তাহ আগে দু’ঘণ্টাও ঘুমোতে পারতেন না, এখন সাত ঘণ্টা ঘুমোচ্ছেন, এটা লিখলে দেখবেন নিজেই নিজেকে মোটিভেট করতে পারছেন। ডায়েরি লিখলে আপনার হেলদি লাইফস্টাইলকে জিইয়ে রাখতে পারবেন। তাতে স্ট্রেস বশে থাকবে, নিয়ন্ত্রণে থাকবে রক্তচাপ।
সর্বোপরি প্রেসার আয়ত্তে আনতে
নিয়মিত প্রেসারের ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। কোনও ভাবেই প্রেসারের ওষুধ খেতে ভুলবেন না। প্রেসার নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও সেটি বজায় রাখতে ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। নইলে আবার প্রেসার বেড়ে যাবে।
সমস্যা হোক বা না হোক, কয়েক মাস পর পর ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করাতে হবে। দরকারে ডাক্তার ওষুধ বদলে দেবেন।
পাতে নুন খাবেন না। নোনতা খাবার একেবারেই নয়।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট যুক্ত খাবার কমিয়ে দিন। মদ্যপান ধীরে ধীরে কমান। ধূমপান করবেন না।
শুয়ে বসে দিন কাটাবেন না। পরিশ্রম করুন। এতে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ব্যায়াম ও খাবার নিয়ন্ত্রণে এনেও ওজন কমানো দরকার।
টেনশন কমান। প্রয়োজনে প্রাণায়াম আর ধ্যান করুন।
এক বার ডাক্তার দেখিয়ে দীর্ঘ দিন সেই একই ওষুধ খেয়ে যাবেন না।
প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘুম খুব প্রয়োজন। তাই দিনের পর দিন ঘুম না হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।