হঠাৎ করে নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এবং নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সমূহকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সংবাদ সম্মেলন করেছেন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি (BACI)।
বুধবার (২৩ মার্চ) সকালে ঢাকা রিপোর্টস ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এ সংবাদে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলন বলা হয়, উন্নয়ন বান্ধব বর্তমান সরকারের দূরদর্শিতা এবং কার্যকরি পদক্ষেপ সমূহের কারণে বিশ্ব দরবারে আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাতারে সমাসীন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক ও সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে আমাদের প্রাণ প্রিয় জন্ম ভূমিকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর জন্য সরকার বদ্ধ পরিকর। অবকাঠামোগত উন্নয়ন সময়মত বাস্তবায়ন না হলে দেশের উন্নয়ন মারাত্মক ভাবে বাধা গ্রন্থ হবে। চলমান ভয়ানক সংক্রামক কোভিড-১৯ এর কারণে আমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্থ হতে বাঁচানোর জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধরনের Stimulus Package দিয়ে সরকার সহায়তা করে যাচ্ছেন। এজন্য BACI’র পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামোসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহায়ক হিসাবে BACI’র সদস্যগণ বিভিন্ন প্রকল্প সাফল্যের সাথে বাস্তবায়ন করে আসছেন। অত্যন্ত পরিতাপ ও দুঃখের বিষয় এই যে, বিগত ১ বৎসরের অধিক সময় ধরে নির্মাণ প্রকল্পের মূল উপকরণ সমূহ যেমন- লৌহ এবং লৌহ জাতীয় দ্রব্য, সিমেন্ট, পাথর, ইট, বিটুমিন, ডিজেল, এ্যালুমিনিয়াম, বিল্ডিং ফিনিশিং আইটেম ইত্যাদি দ্রব্যাদি সহ এ খাতের প্রায় সকল প্রকার নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক ও লাগাম-হীনভাবে বৃদ্ধি পেয়ে অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। প্রতিটন রডের বর্তমান মূল্য ৯০,০০০ টাকা থেকে ৯৫,০০০ টাকা, যা ২০২১ সালের মার্চ মাসে ছিল ৫৫,০০০ টাকা থেকে ৬০,০০০ টাকা। অর্থাৎ শতকরা বৃদ্ধির হার ৬০% এর অধিক। পানি সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, ইলেক্ট্রো ম্যাকানিক্যাল দ্রব্য সমূহের মূল্যও ৪০% – ৯৪% এর অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়াও এ শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক, সুপারভাইজার ও দক্ষ জনবলের মজুরীও শতকরা ৬০-৭০% বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেলের মূল্য ৬৫ টাকার স্থলে বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ টাকা হওয়ার ফলে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন ও যন্ত্রপাতি চালনা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমদানিকৃত সকল নির্মাণ মালামালের ও যন্ত্রপাতির মূল্যও ক্রমান্বয়ে আশংকাজনক-ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ ছাড়াও নির্মাণ প্রকল্পে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুৎ বিল চুক্তিকৃত Rate এর সাথে সন্নিবেশিত না থাকায় ঠিকাদারকে তা পরিশোধ করতে হয়। গত অর্থ বছরে দরপত্র দাখিলের সময় ৫% হারে AIT ধার্য ছিল এখন তা ৭% করা হয়েছে এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পের অগ্রগতিতে অতি মন্থরতা দেখা দিয়েছে, বাস্তব অগ্রগতি খুবই হাতাশাব্যঞ্জক। কাজের স্বাভাবিক অগ্রগতি অর্জিত না হওয়ার ফলে ঠিকাদারগণ বিল পাচ্ছেন না। ফলে গৃহীত ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বিধায় ব্যাংক হতে আর্থিক সহায়তা প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে এবং ঠিকাদার গণের আর্থিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। নির্মাণ সামগ্রীর সীমাহীন অসহনীয় ঊর্ধ্বগতিতে ঠিকাদারগণ মারাত্মকভাবে আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। কার্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা চলমান প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে পারছি না এবং নূতন কোন দরপত্রেও অংশ গ্রহণ করার সাহস পাচ্ছি না। এমতাবস্থায় চলমান অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির প্রবণতা রোধ করে সকল নির্মাণ সামগ্রী ও নির্মাণ যন্ত্রপাতি সমূহের দর সহনীয় পর্যায়ে না আনতে পারলে প্রকল্পের সকল নির্মাণ কাজে স্থবিরতা দেখা দিবে এবং প্রকল্প বান্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তরা বলেন, ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের/অধিদপ্তরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচীর মাত্র ৩৫ (পয়ত্রিশ) শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। যদি এ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে তা হলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষমাত্রা অর্জন তো দূরের কথা সরকারের উন্নয়ন খাতে খরচের পরিমাণ অর্ধেক নেমে আসবে। ফলশ্রুতিতে মানুষের জীবন যাত্রার মান নিচে নেমে আসবে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে করে বর্তমান সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচী ব্যহত হবে এবং সকল ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজকে অস্থির করে তুলবে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাষ্ট্রি (BACI)’র পক্ষ কিছু সুপারিশ জানানো হয়। সুপরিস গুলো হলো:
১. বর্তমান চলমান কাজ গুলো যেহেতু Fixed Rate Contract এ সম্পাদিত হচ্ছে; তাই বিশেষ ব্যবস্থায় প্রজ্ঞাপন জারী করে PPR এ সন্নিবেশিত ফরমূলা অনুযায়ী Price Adjustment ধারা সকল চুক্তিতে অন্তর্ভূক্ত করা হউক।
২. এখন থেকে প্রতিটি দরপত্রে কাজ বাস্তবায়নের সময় বিবেচনা ব্যতিরেকে পিপিআর অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় মূল্য সুপ্রয় ধারা (Price Adjustment Clause) নিবেশিত করে কার্যকর করণ সহ এ ব্যাপারে বিভিন্ন নির্বাহী প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারী, অজ্ঞতা প্রসূত এবং পিপিআর ২০০৮ (সংশোধিত ২০১০) এর সহিত সাংঘর্ষিক আরোপিত শর্তাবলী দরপত্রে প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হউক।
৩. বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী PWD সহ সকল দপ্তরের Rate Schedule হালনাগাদ করা হউক।
৪. প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত খরচ সকল Rate Schedule এ সন্নিবেশিত করা হউক।
৫. বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ববাজার পরিস্থতিতে, বৈশ্বিক অর্থ মন্দার প্রভাবে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির বিপরীতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিটি নির্মাণ কাজের প্রাক্কলনে Price Contingency এর আওতায় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা হউক।
৬. সরকারের পরিপত্র ও বিধি নিষেধ আরোপের কারনে নির্মাণ সামগ্রীর দরের পরিবর্তনের প্রভাব এবং নির্মাণ ব্যয় সমন্বয় সংক্রান্ত পিপিআর এ বর্ণিত ধারা “Adjustment for changes in legislation” কার্যকরী করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত নির্বাহী প্রতিষ্ঠানকে জরুরী আদেশ প্রদান করা হউক।
৭. আমদানি নির্ভর নির্মাণ সামগ্রীর কাঁচা মালের আমদানি শুল্ক সাময়িক ভাবে হলেও স্থগিত করা হউক।
৮. চলমান নির্মাণ চুক্তি গুলির ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়ন নির্বাহী প্রতিষ্ঠান যেমন- গণপূর্ত, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি মূল্য সংশোধন সেল তৈরি পূর্বক চুক্তিবদ্ধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা হউক।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, বিএসিআই’র পরিচালক রফিকুল ইসলাম, বিএসিআই’র পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আফতাব উদ্দিন আহমেদ, বিএসিআই’র উপদেষ্টা ইঞ্জিনিয়ার সফিকুল আলম ভূঁইয়া, বিএসিআই’র উপদেষ্টা মীর নাসির , বিএসিআই’র পরিচালক (প্রশাসন) হাসান মাহমুদ বাবু, বিএসিআই’র সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সফিকুল হক তালুকদার, বিএসিআই’র সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার বিমর চন্দ্র রায়।