বেগম খালেদা জিয়া
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (Bangladesh Nationalist Party – BNP) বিএনপির প্রধান। খালেদা জিয়া ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট জলপাইগুড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯১-১৯৯৬ সাল এবং ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত দু দফায় মোট ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ও মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী।
খালেদা জিয়ার পরিবার
বেগম খালেদা জিয়ার প্রকৃত নাম খালেদা খানম, ডাক নাম পুতুল। আগস্ট ১৫, ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তিন বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ভাইয়েরা সবার ছোট। তাঁর পিতামহ হাজী সালামত আলী, মাতামহ জলপাইগুড়ির তোয়াবুর রহমান। বাবা জনাব ইস্কান্দর মজুমদার এবং মা বেগম তৈয়বা মজুমদার।
খালেদা জিয়ার স্বামী বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। তার এক ভাই মেজর(অবঃ) সাইদ ইস্কান্দার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল থেকে ফেনী-১ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তার দুই ছেলের মধ্যে বড় তারেক রহমান (জন্মঃ ২০ নভেম্বর ১৯৬৭) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ১ম ভাইস-চেয়ারম্যান। তার কনিষ্ঠ ছেলে আরাফাত রহমান কোকো (১২ আগস্ট ১৯৭০ – ২৪ জানুয়ারি ২০১৫)। আরাফাত রহমান কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি মালায়া হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।আরাফাত রহমান একজন ব্যবসায়ী ছাড়াও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও সিটি ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলেন।
খালেদা জিয়ার স্থায়ী নিবাস
দিনাজপুর শহরের মুদিপাড়া। আদি পিতৃ-ভিটা ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের মজুমদার বাড়ী। বাবা জনাব ইস্কান্দর মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ইস্কান্দর মজুমদার ১৯১৯ সালে ফেনী থেকে জলপাইগুড়ি যান। বোনের বাসায় থেকে মেট্রিক পাস করেন ও পরে চা ব্যবসায়ে জড়িত হন। ১৯৩৭ সালে জলপাইগুড়িতে বিয়ে করেন। জল্পাইগুড়ির নয়াবস্তি এলাকায় ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বসবাস করেন। ১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। মা বেগম তৈয়বা মজুমদার ছিলেন একান্ত ভাবে একজন গৃহিনী।
খালেদা জিয়ার শিক্ষা
খালেদা জিয়ার স্কুলজীবন শুরু হয় পাঁচ বছর বয়সে দিনাজপুরের মিশন স্কুলে। এরপর দিনাজপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তীতে পড়াশুনা করেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে।
খালেদা জিয়ার বিয়ে
১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে জিয়াউর রহমানের সাথে তার বিয়ে হয়। জিয়াউর রহমানের ডাক নাম কমল। জিয়া তখন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডি এফ আই এর অফিসার হিসাবে তখন দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন।
সংসার
১৯৬৫ সালে খালেদা জিয়া স্বামীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে পাকিস্তান)যান। ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত করাচিতে স্বামীর সাথে ছিলেন। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন জয়দেবপুর থাকার পর চট্টগ্রামে স্বামীর পোস্টিং হলে তার সঙ্গে সেখানে এবং চট্টগ্রামের ষোলশহর একালায় বসবাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে খালেদা জিয়া কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। বড় বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ জুন পর্যন্ত থাকেন। ২ জুলাই সিদ্ধেশরীতে জনাব এস আব্দুল্লাহর বাসা থেকে পাক সেনারা তাকে দুই ছেলে সহ বন্দী করে। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি মুক্তি পান। রাজনীতিতে আসার আগ পর্যন্ত বেগম জিয়া একজন সাধারণ গৃহবধু ছিলেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও রাজনীতিতে বেগম জিয়ার উপস্থিতি ছিল না।
রাজনীতিতে বেগম জিয়া
১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভুত্থ্যানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা কর্মিদের আহ্ববানে তিনি ১৯৮২ সালে ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। বেগম জিয়া এর বিরোধিতা করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে পার্টির চেয়ারপার্সন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বেই মূলতঃ বিএনপির পূর্ণ বিকাশ হয়।
আন্দোলন
১৯৮৩ সালের বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই সময় এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। বেগম জিয়া প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে ১৯৮৩ এর সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। একই সময় তার নেতৃত্বে সাত দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনের দলের সাথে যৌথভাবে আন্দোলনের কর্মসূচী শুরু করে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাঁধার সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙ্গে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। এরপর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখান করে। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া “এরশাদ হটাও” এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। এর ফলে এরশাদ সংসদ ভেঙ্গে দেন। পুনরায় শুরু হয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অবশেষে দীর্ঘ আট বছর একটানা নিরলস ও আপোসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন
-
১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার সরকার দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার কায়েম করে। ২ এপ্রিল তিনি সংসদে সরকারের পক্ষে এই বিল উত্থাপন করেন। একই দিন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ কে স্বপদে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে একাদশ সংশোধনী বিল আনেনে। ৬ আগস্ট ১৯৯১ সালের সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দুটি বিল পাশ হয়।
-
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। যা পরবর্তীতে ৯৬ এর একদলীয় নির্বাচন হিসেবে গণ্য হয়। সকল বিরোধীদলের আপত্তির পর ও খালেদা জিয়া ও তার দল এই একক নির্বাচন করেন। আওয়ামী লীগ সহ সব বিরোধী দল এই নির্বাচন বয়কট করে। এই সংসদ মাত্র ১৫ দিন স্থায়ী হয়। খালেদা জিয়া এই সংসদের ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রবল আন্দোলন ও বর্হিবিশ্বের চাপে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন।
-
১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মোট ১১৬ আসনে জয় লাভ করে, যা সরকার গঠনে যথেষ্ঠ ছিলনা। আওয়ামী লীগ মোট ১৪৭ আসন লাভ করে, তারা জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপি সপ্তম সংসদে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহত্ বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের পাঁচ বছর শাসনকালে সংসদে বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন ।
-
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি জামাতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টির সাথে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া এই সংসদেও প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর এই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়।
-
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় ঐক্যজোট বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়। মহাজোটের প্রায় ২৬০ টি আসনের বিপরীতে চার দলীয় ঐক্যজোট মাত্র ৩২টি আসন লাভ করে।
-
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সহ বাংলাদেশের অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে।
গ্রেফতার
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে যোগ দেবার পর থেকে মোট চার বার তিনি গ্রেফতার হন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর গ্রেফতার হন।
সর্বশেষ তিনি ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর ৩ তারিখে দূর্নীতির অভিযোগে পুত্রসহ গ্রেফতার হন। ২০০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বার তিনি হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তার হবার পর দীর্ঘ এক বছর সাত দিন কারাগারে অবস্থানকালে তাঁর বিরুদ্ধে চলতে থাকা কোন মামলারই উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি এবং চলতে থাকা তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি।
সেনানিবাসের বাসা ত্যাগ
১৩ নভেম্বর ২০১০ বেগম জিয়া তার ২৮ বছরের আবাসস্থল ছেড়ে যান। তিনি অভিযোগ করেন তাকে বলপ্রয়োগে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে সরকারি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তিনি স্বেচ্ছায় বাসা ত্যাগ করেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে জিয়াউর রহমানের সাথে শহীদ মইনুল সড়কের ৬ নম্বর বাড়িতে ওঠেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যূত্থানে নিহত হলে ১২ জুন তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার সেনানিবাসের ওই বাড়িটি খালেদার নামে বরাদ্দ দেন।
ভাল নেই খালেদা জিয়া
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে খালেদা জিয়া বিরোধী দলীয় নেত্রির পদ হারান। বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনার কোথাও তার উপস্থিতি নেই। তার দলের অনেক নেতার উপর রয়েছে সরকারের সাথে আঁতাত করে রাজনীতির অভিযোগ। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ২০টি মামলা রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে দিন দিন শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা। যেভাবে দুর্নীতির মামলা চলছে তাতে বিএনপি নেত্রীর সাজা দ্রুত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলার সংখ্যা পাঁচটি। বাকিগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় করা সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির পিটিশন মামলা।
(তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া )